সহিংসতায় জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে : প্রধানমন্ত্রী

আবু সাঈদসহ নিহত ৩৪ জনের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আর্থিক সহায়তা । কোটা আন্দোলনে ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াত-শিবির পরে ছিল ভয়ঙ্কর

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ২৯ জুলাই, ২০২৪ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় খুনের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাদের বিচার করতে হবে, তা না হলে মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া যাবে না। গতকাল রোববার দুপুরে গণভবনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আর্থিক সহায়তা তুলে দেওয়ার সময় এ কথা বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার চেষ্টা থাকবে, যারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত, খুঁজে খুঁজে বের করে তারা অবশ্যই যেন শাস্তি পায়, সেটাই আমার প্রচেষ্টা থাকবে, আমি সেটাই করব। মানুষ কী দোষ করল যে, এভাবে মানুষ খুন করতে হবে! মানুষ খুন করে সরকার পতন, এটা কবে হয়, কখন হয়? সাধারণ মানুষ কী দোষ করেছে?

এদিকে গতকাল গণভবনে ঢাকায় নিযুক্ত স্পেনের রাষ্ট্রদূত গাব্রিয়েল মারিয়া সিসতাগা ওচোয়া দ্য চিনচেত্রু সৌজন্য সাক্ষাতে এলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুরুতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে জামায়াতশিবির সন্ত্রাসীরা ঘাপটি মেরে থাকলেও পরে ভয়ানকভাবে সামনে আসে। খবর বিডিনিউজের।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস হয়ে ওঠে। ২১ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনে নজিরবিহীন সহিংসতার মধ্যে অনেক মানুষ হতাহত হয়। সরকার বলছে, রোববার পর্যন্ত তাদের কাছে ১৪৭ জন নিহতের খবর এসেছে। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংখ্যাটি দুই শতাধিক বলা হচ্ছে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনে বিএনপিজামায়াতের সন্ত্রাসীরা ঢুকে সহিংসতা ও প্রাণহানি ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করছে সরকার।

আন্দোলনের মধ্যে সহিংসতা হতাহতের খোঁজখবর নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল গণভবনে তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ নিহত ৩৪ জনের পরিবারের সদস্যরা। শোকাহত স্বজনদের সান্ত্বনা দিয়ে খুনে জড়িত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে তাদের সহযোগিতা চান প্রধানমন্ত্রী, বলেন, আপনাদেরও সাহায্য চাই। যদি আপনারা কিছু জানেন, আমাদের জানাবেন। কারণ, এভাবে বারবার বাংলাদেশটাকে নিয়ে খেলা; এটা আর হতে দেওয়া যায় না। কাজেই আমি আপনাদেরই সাহায্য চাই। মানুষ মেরে লাশ ঝুলিয়ে রাখার মতো এই বর্বরতা, জানোয়ারের মতো ব্যবহার এটা কি কেউ করতে পারে? একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের লাশ ঝুলিয়ে রাখবে পা বেঁধে! যারা এগুলোর সঙ্গে জড়িত অবশ্যই তাদের বিচার হবে। তাদের বিচার করতে হবে, তা না হলে মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া যাবে না।

সরকারপ্রধান বলেন, আপনারা দেখেছেন, প্রত্যেকটা জিনিস পুড়িয়েজ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে। যেখানে মানুষ সেবা পাবে সেই জায়গাগুলো। সেই কোভিড হাসপাতাল থেকে শুরু করে যে যে জায়গায় আমরা মানুষের জন্য কাজ করব, সেই জায়গা, প্রত্যেকটা জায়গা একে একে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এইভাবে গুলি করে মানুষকে মারা।

স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের শেখ হাসিনা বলেন, আপনাদের কাছে শুধু এইটুকু বলব, আপনারা সবর করেন। আর আল্লাহকে ডাকেন, যেন এই সমস্ত খুনিজালেম; এদের হাত থেকে আমাদের দেশটা যেন রেহাই পায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের দাবি মানা এবং ধৈর্য্য ধরে তাদের বোঝানো হয়েছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ধৈর্য্য ধরে সব সময় তাদের বোঝানো, তাদের সঙ্গে কথা বলা, সব চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজকে চারদিকে এই হাহাকার। এটা তো সহ্য করা কষ্টকর।

শেখ হাসিনা বলেন, যারা আন্দোলন করেছে, তাদের সব দাবিই তো মেনে নিয়েছি। তাতেও নাকি দাবি শেষ হয় না। একটা মানি তো আরেকটা। তারপর আরও দুইটা। আবার চারটা। আবার আটটা। এ কী? বারবার বলেছি যে, ঠিক আছে, আমরা দেখছি। যা দাবি সবই তো মানলাম।

সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদের পরিবার ও আহতদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যতক্ষণ বেঁচে আছি আপনাদের পাশে আছি। আমি আসলে আপনাদের কী বলে সান্ত্বনা দেব? শুধু এটুকু বলব যে, আমি আপনাদের মতোই একজন। বাবামা, ভাই হারানো সেই এতিম। কাজেই আপনাদের কষ্ট আমি বুঝি। আমি আছি আপনাদের জন্য, আপনাদের পাশে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বজন হারানোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমি তো বুঝি আপনাদের কষ্ট, আপনাদের বেদনা। প্রতিনিয়ত বাপমাভাইবোনদের হারানোর ব্যথা নিয়ে আমাদের চলতে হয়। এমনকি লাশটাও তো দেখতে পারিনি, কাফনদাফনটাও করতে পারিনি। দেশেও ফিরতে পারিনি, ছয় বছর আসতে দেয়নি আমাকে। যখন (দেশে) এসেছি, সারা বাংলাদেশ ঘুরছি। চেয়েছি যেন এ দেশের মানুষের একটু, আমার বাবা বলতেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাব। আমি সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বারবার এই ধরনের ঘটনা ঘটাবে, এই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাবেএটা তো কাম্য নয়।

নিহতদের স্বজনরা গণভবনে আসায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাই এসেছেন কষ্ট করে, দুঃসময়ে। আজকে যদি ভালো সময় হতো কত হাসিখুশি করে সবাই যেতে পারতেন। আর এখন আমারও আপনাদের চোখের পানি দেখতে হচ্ছে। এটিই সবচেয়ে কষ্ট।

প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহত স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের খোঁজখবর নেন। অনেকে প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অশ্রু সজল হতে দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় গণভবনের ব্যাংকোয়েট হলে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বক্তব্যের সময় শেখ হাসিনাকে বারবার আবেগাপ্লুত হতে দেখা যায়।

নিহতদের পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সময় অশ্রুসিক্ত প্রধানমন্ত্রী তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, আমাকে দেখেন, আমি কত শোক নিয়ে বেঁচে আছি। আন্দোলনে সহিংসতায় নিহত ৩৪ জনের পরিবারের সদস্যদের হাতে আর্থিক সহায়তা হিসেবে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র এবং নগদ অর্থ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।

বাসস লিখেছে, আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন ও মা মনোয়ারা বেগমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা শনিবার রংপুর থেকে ঢাকায় পৌঁছে গণভবনে আসেন। ১৬ জুলাই রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিআরইউ) দ্বাদশ ব্যাচের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ মারা যান। শুক্রবার সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয় বিআরইউআর প্রশাসন। রংপুরের পীরগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিনিধিদল তার বাবামায়ের কাছে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার চেক হস্তান্তর করে।

কোটা আন্দোলনে ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াতশিবির পরে ছিল ভয়ংকর : শুরুতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে জামায়াতশিবির সন্ত্রাসীরা ঘাপটি মেরে থাকলেও পরে ভয়ানকভাবে সামনে আসে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল গণভবনে ঢাকায় নিযুক্ত স্পেনের রাষ্ট্রদূত গাব্রিয়েল মারিয়া সিসতাগা ওচোয়া দ্য চিনচেত্রু সৌজন্য সাক্ষাতে এলে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান বৈঠকের বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রাথমিকভাবে জামায়াতশিবিরের সন্ত্রাসীরা লোপ্রোফাইলে (ঘাপটি) থাকলেও একটা পর্যায়ে ভয়ংকরভাবে আর্ভিভূত হয়। যে প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সফলতা ও উন্নয়নের প্রতীক, জনসেবামূলক এবং যেখানে যেখানে সাফল্য, সন্ত্রাসীরা সেসব প্রতিষ্ঠানে হামলা করে।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড হাসপাতাল, মেট্রোরেল, এঙপ্রেসওয়ে, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন ও ডেটা সেন্টারসবগুলো আমাদের উন্নয়নের প্রতীক। এসব প্রতিষ্ঠান জনগণকে সেবা দেয় এবং প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসে তারাই আসলে ক্ষতিগ্রস্ত। সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, সেনা সদস্যরা সর্বোচ্চ ধৈর্য্য দেখিয়েছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সাম্প্রতিক সংঘাতে তার দল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ২১ জন মারা গেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগুরুতর আহত ছাত্রলীগ নেতাদের দেখতে গেলেন প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধঅপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান সেনাবাহিনীর