
ভোরের আলো যখন শহরের জানালা ছুঁয়ে নিঃশব্দে নেমে আসে, তখন মনে হয়–আজকের দিনটাও আমাদের একসাথে চলার জন্যই অপেক্ষা করে আছে। কর্মস্থলের পথটা যেন প্রতিদিন নতুন এক গল্প নিয়ে ডাক দেয়। বাইরে যত ব্যস্ততা, যত বাস্তবতা–এই পথটায় এসে মানুষ আপনার চোখে চোখ রেখে বলে, “চলো, আজকের দিনটাও আমরা একসাথে সামলাই।”
কাজের জায়গা শুধু কাজের জায়গা নয়–অনেকটা পরিবারের মতোই হয়ে ওঠে। যেমন ঘরে পাশের ঘরে হাঁটার শব্দে পরিচিতি তৈরি হয়, তেমনি অফিসে ডেস্কের পাশেই যখন মানুষগুলো বসে, তাদের নিঃশ্বাস, হাসি, গুছিয়ে নথি সরানোর শব্দ, কিংবা চায়ের কাপে টোকা দেওয়ার টুংটাং– এসব মিলেই তৈরি হয় এক নিঃশব্দ ঘনিষ্ঠতা। এ ঘনিষ্ঠতা এমন যে সামান্য মনোমালিন্যও অনেক সময় শব্দ হয়ে ওঠে, আবার সামান্য হাসিই সব ভুল ভাঙিয়ে দেয়।
কারণ আমরা একটি চেইন সিস্টেমে চলি–একজন একটু থেমে গেলে পুরো সিস্টেমই খানিকটা দুলে ওঠে। তাই মানিয়ে চলাটাই এখানে বড় কথা। ছোট ভুলে রাগ জমিয়ে না রেখে যদি একটু বোঝাপড়া, একটু হাসি, একটু কথা–এই তিনটে উপহার দিতে পারি, তাহলে দিনগুলো অনেক সহজ হয়ে যায়।
কর্মস্থলে সহকর্মীরা আসলে নীরব আপনজন। বিশাল শহরে যখন প্রত্যেকে নিজের জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত, তখন প্রতিদিনের আট–দশ ঘণ্টা কাটে যাদের পাশে, তারা–ই হয়ে ওঠে দিনের সঙ্গী। সেখানে কেমন আছেন আপনি, মুখ দেখে আজ আপনার মন খারাপ কি না–এসব অন্যরা নাও বুঝুক, কিন্তু সহকর্মী ঠিকই টের পায়।
সকালে হাসিমুখে কুশল জিজ্ঞেস করা যে কতটা শক্তি দেয়, সেটা শুধু অনুভব করা যায়। বলার ভঙ্গি, চোখের চাহনি আর একচিলতে হাসি–এই ছোট্ট তিনটি বিষয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দিনের অর্ধেক শান্তি।
মানুষ মানুষকে আপন ভেবে কথা বললে কাজও সহজ হয়। কাগজের ভার কমে, ক্লান্তিও আশ্চর্যভাবে হালকা লাগে। সহকর্মীর খোঁজ রাখা–এটা কোনো দায়িত্ব নয়, এটা সম্পর্কের নীরব সৌন্দর্য। কেউ একটু চুপচাপ থাকলে আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন– “কিছু হয়েছে নাকি?” সে প্রশ্ন কখনো কখনো মানুষকে ভরসা দিয়ে দেয়, শক্তি দিয়ে দেয়। কাজের চাপ, বাড়ির দুশ্চিন্তা, জীবনের ঝড়–সবকিছু ঠিক করে দিতে না পারলেও পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা মানুষকে ভালো থাকতে শেখায়।
তবে যতটা কাছাকাছি থাকা দরকার, ঠিক ততটাই প্রয়োজন ব্যক্তিগত সীমা মানা। প্রত্যেকের জীবন আলাদা, তার ব্যথা–বোঝাও আলাদা। কেউ যা বলতে চায়, সে–ই শুধু বলুক– জোর করে কিছু জানার চেষ্টা বা গসিপ– এসব সম্পর্ককে নোংরা করে দেয়, কর্মস্থলের পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে। যেখানে প্রতিদিন এত ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করতে হয়, সেখানে সম্মানটাই সবচেয়ে বড় বিষয়।
কাজের জায়গায় গল্প থাকবে–এটাই স্বাভাবিক। হাসি থাকবে, ঠাট্টা থাকবে, ছোটখাটো খুনসুটি থাকবে–কারণ এগুলো মানুষকে মানুষ রাখে। তবে গল্প যেন কাজকে থামিয়ে না দেয়, বরং কাজের মাঝে একটু গল্প হোক, ক্লান্তির মাঝে একটু হাসি হোক। একটা টিম তখনই শক্তিশালী হয়, যখন সবাই বুঝে কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কার কী চাপ আছে, আর কার একটু বিরতি দরকার। ভুল বোঝাবুঝি–এটা যে হয় না, তা নয়। কিন্তু ভুল যত দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যায়, সম্পর্কের দেয়াল তত কম উঁচু হয়। রাগ জমিয়ে রাখলে দিনের আলোও কালো হয়ে যায়। কিন্তু কথা বলে, ধৈর্য দিয়ে, বোঝাপড়া দিয়ে ভুল ভাঙালে দিনের শেষে মানুষ বুঝতে পারে – একসাথে চলার পথটাই আসলে সবচেয়ে সুন্দর। কর্মস্থল এমন এক জায়গা, যেখানে মানুষ শুধু কাজ করে না– এখানে মানুষ ধৈর্য শেখে, বোঝাপড়া শেখে, সহমর্মিতা শেখে। একজনের কাজ আরেকজনকে প্রভাবিত করে; একজনের মুড পুরো টিমকে বদলে দিতে পারে। তাই এই সম্পর্কটাকে যত্নে রাখাই সবচেয়ে জরুরি। জীবনের এই দীর্ঘ পথে চাকরি হয়তো বদলায়, ভবন বদলায়, ডেস্ক বদলায়– কিন্তু কোনো কোনো সহকর্মী মানুষের জীবনে এমনভাবে জায়গা করে নেন যে তারা বন্ধু হয়ে যান, আপন হয়ে যান, পরিবারের একজন হয়ে যান। দিনশেষে আমরা সবাই চাই– শান্তিতে কাজ করতে, হাসি মুখে দিন শেষ করতে, একসাথে এগোতে। আর তাই এই সম্পর্কগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে লাগে–একটু মায়া, একটু আন্তরিকতা, কিছু ভালোবাসা, আর একটু মানবিকতা। এই একফোঁটা মমতা– কর্মস্থলকে শুধু কর্মস্থল না রেখে একটি পরিবারের মতো করে তোলে।
লেখক : শিক্ষক, কবি ও আবৃত্তিশিল্পী












