সস্তায় তেল এনে চড়া দামে বিক্রি

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় সক্রিয় চোরাচালানি চক্র ট্যাংক ভর্তি করে তেল আনছে জাহাজগুলো

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৩ এপ্রিল, ২০২৩ at ৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় তেল চোরাচালান বেড়েছে। বিদেশে তেলের দাম কমে যাওয়ায় দেশে বাংকারিংয়ের চাহিদা কমেছে। তবে চোরাচালান বেড়ে যাওয়ায় সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে আসা দেশি বিদেশি জাহাজের পাশাপাশি প্রভাবশালী চোরাচালানি চক্র নিজেদের মতো করেও তেল নিয়ে আসছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, দেশে জ্বালানি তেল সেক্টর প্রায় পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। আমদানিকৃত তেল দিয়েই দেশি বিদেশি জাহাজে তেল বিক্রি (বাংকারিং) করা হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) পদ্মা অয়েল কোম্পানি, যুমনা অয়েল কোম্পানি এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মাধ্যমে দেশব্যাপী জ্বালানি তেল বাজারজাত করে থাকে। বাংকারিংয়ের জন্য বিপিসির আমদানিকৃত লো সালফার ফার্নেস অয়েল সরবরাহ দেয়া হয়। এর বাইরে কিছু কিছু জাহাজে ডিজেলের সীমিত ব্যবহার রয়েছে। সরকারের অনুমোদিত বাংকারিং ব্যবসায়ীরা দেশি বিদেশি বিভিন্ন জাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহ করে থাকেন।

সূত্র বলেছে, জ্বালানি তেল সরবরাহের আড়ালে সংঘবদ্ধ একটি প্রভাবশালী চক্র কোটি কোটি টাকার তেল চোরাচালানের সাথে জড়িত। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় চক্রটি সুকৌশলে দেশে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল নিয়ে আসে। বিপিসির মতো ব্যাপক হারে না হলেও সংঘবদ্ধ চক্রটি নিজেদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চোরাচালান নির্ভর অনেক বড় একটি বাজার গড়ে তুলেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় চক্রটির সস্তায় তেল এনে চড়া দামে বিক্রি করছে এবং কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিদেশ থেকে চোরাপথে তেল আনার ঘটনা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, চট্টগ্রাম এবং মোংলা বন্দরে আসা বিভিন্ন জাহাজের মাধ্যমে এসব তেল নিয়ে আসা হচ্ছে। বন্দরে আসা নির্দিষ্ট জাহাজগুলো ট্যাংক ভর্তি করে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল নিয়ে আসে। সিংগাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে নিয়ে আসা তেল কিছুটা বাড়তি লাভে চট্টগ্রামের দাগি চোরাকারবারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। ফিরতি যাত্রায় সিংগাপুর পৌঁছার মতো প্রয়োজনীয় তেল রেখে বাড়তি তেল বিক্রি করে দেয়া হয়। কোনও শুল্ক পরিশোধ করা হয় না বিধায় তুলনামূলক সস্তায় তেলগুলো কিনতে পারে চোরাকারবারিরা। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প কিংবা স্থানীয় লাইটারেজ জাহাজ, ছোট ছোট নৌযানসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিক্রি করে। কোনও ধরনের শুল্ক পরিশোধ করতে হয় না বিধায় চক্রটি বাজার দরের চেয়ে কমে তেল বিক্রি করে।

সিংগাপুরে গতকাল প্রতি টন ডিজেলের দাম ছিল ৭৫০ ডলার। এরসাথে জাহাজভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচসহ টন প্রতি ১০০ ডলার যোগ করলে মূল্য দাঁড়ায় ৮৫০ ডলার। দেশিয় বাজারে যে ডিজেল বিক্রি হচ্ছে তার দর টন প্রতি প্রায় ১২শ’ ডলার। মোটা অংকের মুনাফা থাকায় প্রভাবশালী চক্রটি চোরাপথে কোটি কোটি টাকার তেল নিয়ে আসে বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে। গতকালের হিসেব কষে সূত্র জানায়, লিটার প্রতি গড়ে ২৫ টাকা ব্যবসা করে চোরাচালানিরা। প্রতি টনে (প্রায় ১২শ’ লিটার) গড়ে ৩০ হাজার টাকা মুনাফা করায় একাধিক চোরাচালানির আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এক প্রভাবশালী চোরাচালানি বর্তমানে পুরো সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।

সংঘবদ্ধ চক্রটি বেশ কৌশলে তেল চোরাচালান করে বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, গভীর সমুদ্রে নোঙর করা বিদেশি জাহাজের পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট অয়েল ট্যাংকারটি এমনভাবে ভিড়ায় যে তাতে সন্দেহ করার কোনো উপায় থাকে না। খোলা চোখে দেখলে মনে হবে জাহাজটি বাংকারিং করছে। ছোট জাহাজটি বড় জাহাজের কাছে তেল বিক্রি করছে। তাদের কাছে তেল বিক্রির করার অনুমতিসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রও থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। ছোট জাহাজটিই বড় জাহাজের তেল নিয়ে নেয়। বড় এবং ছোট জাহাজের তেল দেয়া নেয়ার এই কর্মকাণ্ড সাধারণতঃ বাইরে থেকে বুঝার বা ধরার সুযোগ থাকে না বলেও সূত্র জানিয়েছে।

বাংকারিং ব্যবসার মূল উপাদান হচ্ছে ফার্নেস অয়েল। লো সালফার ফার্নেস অয়েল জাহাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে ডিজেলের। হাজার হাজার ছোট নৌযান, নৌকা, মাছ ধরা ট্রলার, উন্নয়ন প্রকল্পের ইক্যুইপমেন্ট সবই চলে ডিজেলে। আর ডিজেলের বিশাল বাজারটি চোরাচালানিদের নিয়ন্ত্রণে। লিটার প্রতি দুয়েক টাকা কমে তেল দেয়ায় বিশাল এই বাজারটি ক্রমে চোরাচালানিদের হাতে চলে গেছে। চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত দাগি তেল চোরাচালানিরা সরকারকে কোটি কোটি টাকার শুল্ক এবং রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিজেরা কালো টাকার পাহাড় গড়ছে বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কিছুটা কমেছে। তবে চোরাচালানিরা তেল নিয়ে আসছে এমন কোনও তথ্য আমাদের কাছে নেই। জাহাজে যদি তেল এনে এখানে রাতের আঁধারে বিক্রি করে দেয়া হয় তাহলে সেটি ঠেকানো কঠিন। গভীর সমুদ্রে রাতের আঁধারে কোন জাহাজ কোন জাহাজকে তেল দেবে কি নেবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা আসলে কঠিন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

র‌্যাব বছর কয়েক আগে তেল চোরাচালানিদের একটি তালিকা করেছিল। চট্টগ্রামে তেল চোরাচালানের বড় একটি ঘটনা ধরা পড়ার প্রেক্ষিতে তালিকাটি করা হয়েছিল। ওই তালিকার দাগি চোরাচালানিরা দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিলেও পরবর্তীতে আবারো অপতৎপরতা শুরু করে। দিনে দিনে চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলেও সূত্র জানিয়েছে। রাতের আঁধারে জাহাজের পাশে অয়েল ট্যাংকার ভিড়ালে নজরদারি বাড়ানোর জন্য কোস্টগার্ডের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

কোস্টগার্ড এবং নৌ পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা কর্ণফুলী নদী থেকে বিভিন্ন সময় চোরাচালানের বিপুল পরিমাণ তেল আটক করেছে। কিন্তু ক্ষতি পোষাতে চক্রটি পরের চালানে আরো বেশি তেল চোরাচালান করে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, নগরীর পতেঙ্গা, ইপিজেড, কর্ণফুলী, বাকলিয়া, কোতোয়ালী, সদরঘাট এবং বন্দর এলাকা ঘিরে তেল চোরাচালানি সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা চলে। কর্ণফুলী নদীর ১১ নং মাতব্বর ঘাট, ১২ নং তিন টেইগ্যার ঘাট, ১৩ নং ঘাট, ১৪ নং কালু মাঝির ঘাট, ১৫ নং মেরিন একাডেমি ঘাট, জুলধা ইউনিয়েনের ঘাট, চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের বাংলাবাজার ঘাট, অভয়মিত্র ঘাট, চরপাথরঘাটা পুরনো ব্রিজ ঘাট, চাক্তাই ঘাট, সদরঘাট ও ফিশারিঘাটসহ বিভিন্ন পয়েন্টে তেল চোরাচালানি কারবার চলে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্যবসায়ীকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ৯ কোটি টাকা জরিমানা
পরবর্তী নিবন্ধষষ্ঠ ও সপ্তমের সব বইয়ে সংশোধনী আসছে