সর্বজনীন পেনশন শুরু এক বছরের মধ্যে

পেনশন কীভাবে, সুবিধাই বা কেমন

| বৃহস্পতিবার , ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

আগামী এক বছরের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব সব নাগরিকের জন্য অবসরকালীন সুবিধা বা পেনশন চালু করতে যাচ্ছে সরকার; তবে নিবন্ধিতরা এর প্রত্যক্ষ সুফল পাওয়া শুরু করবেন ১০ বছর পর থেকে। গতকাল বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত ও অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন সুবিধার বিভিন্ন তথ্য সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে এই পেনশন সুবিধা চালু করা হবে। সেজন্য আইন ও বিধি তৈরি করা হবে এই সময়ের মধ্যেই। একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করে তার অধীনে চলবে এই পেনশন সুবিধা। এর আওতায় নিবন্ধিতরা ৬০ বছরের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পেনশন ভোগ করতে পারবেন। যাদের বয়স এখন ১৮ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, আপাতত তাদের এ সুবিধার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। খবর বিডিনিউজের।
কেন সর্বজনীন পেনশন : সংবিধানের ১৫ ঘ অনুচ্ছেদ থেকে উদ্ধৃত করে মন্ত্রী বলেন, বার্ধক্যজনিত কারণে অভাবগ্রস্ত হলে তাদের অভাবের কারণে যাদের সাহায্য প্রয়োজন, তাদের সাহায্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেই আলোকে এই পেনশন স্কিম নেওয়া হচ্ছে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা শিরোনামে ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে : ১৫। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায় : (ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।
মন্ত্রী বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় নির্বাচনী ইশতিহারে সর্বজনীন পেনশনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এসবের ধারাবাহিকতায় এটা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। এটি একটি অসাধারণ অর্জন হবে। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। কারণ ধারণাটি ছিল তার এবং তিনি বার বার এটি বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছিলেন। এটি বাস্তবায়িত হলে প্রতিটি মানুষ উপকৃত হবে এবং লাভবান হবে, বলেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাংলাদেশে এখন গড় আছুষ্কাল ৭৩ বছর, যা ২০৫০ সালে ৮০ বছর এবং ২০৭৫ সালে ৮৫ বছর হবে। এতে বোঝা যায় আগামী তিন দশকে একজন কর্মজীবী ব্যক্তি অবসর গ্রহণের পরেও ২০ বছর বেঁচে থাকবে। কিন্তু ওই সময় তাদের আয় থাকবে না। সেজন্য তাদের দায়িত্ব কেবল সরকারই নিতে পারে।
বর্তমানে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ওপর শিশু ও বৃদ্ধদের নির্ভরতার যে হার, আগামী দিনে তা বাড়তে থাকবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এই ডিপেন্ডেন্সি রেশিও বা যাদের কর্মক্ষমতা নেই তাদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব কে বহন করবে? সেই দায়িত্বটি সরকার নিচ্ছে এই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার মাধ্যমে।
পেনশন সুবিধার প্রস্তাবে যা আছে : ১. ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল কর্মক্ষম নাগরিক এই পেনশন সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হবেন। প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিরাও এতে অংশ নিতে পারবেন। তবে সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বিষয়ে পরে বিবেচনা করা হবে, কারণ এখন তারা সরকারিভাবেই একটি পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আছেন। ২. জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিক পেনশন হিসাব খুলতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে এটা হবে ঐচ্ছিক। পরে তা বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। ৩. ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা জমা দিলে সাপেক্ষে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন একজন। প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি পেনশন অ্যাকাউন্ট থাকবে। ফলে চাকরি বা পেশা পরিবর্তন করলেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। মাসিক সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসীদের ক্ষেত্রে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দেওয়ার সুযোগ থাকবে। ৪. সুবিধাভোগীর বছরে ন্যূনতম বার্ষিক জমা নিশ্চিত করবেন। তা না হলে তাদের হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত থাকবে। পরে বিলম্ব ফিসহ বকেয়া চাঁদা পরিশোধের মাধ্যমে হিসাব সচল হবে। ৫. পেনশনের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা (৬০ বছর) পূর্ণ হলে পেনশন তহবিলে পুঞ্জিভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিতহারে পেনশন দেওয়া হবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতি মাসে এই পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। ৬. নির্ধারিত চাঁদা জমাকারী পেনশনে থাকাকালে ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি সেই মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। মূল জমাকারীর বয়স যে বছর ৭৫ বছর পূর্ণ হত, ওই বছর পর্যন্ত নমিনিকে এই পেনশন দেওয়া হবে। ৭. পেনশন স্কিমে জমা করা অর্থ কোনোভাবেই কোনো পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের প্রেক্ষিতে জমা অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তোলা যাবে, যা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। ৮. কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগেই নিবন্ধিত চাঁদাপ্রদানকারী মারা গেলে জমা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। ৯. পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচনা করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে। পেনশন বাবদ মাসিক যে অর্থ পাওয়া যাবে তা পুরোপুরি আয়কর মুক্ত থাকবে। ১০. পেনশন কর্তৃপক্ষের খরচসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয় সরকার বহন করবে। পেনশন কর্তৃপক্ষ তহবিলে জমা অর্থ নির্ধারিত গাইডলাইন অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে এবং সর্বোচ্চ লাভের ব্যবস্থা করবে।
মন্ত্রী বলেন, এটা হচ্ছে প্রাথমিক প্রস্তাব, এর সঙ্গে আরও বাস্তবসম্মত সংশোধন ও পরামর্শ যুক্ত হবে। যখন একটা সময় আসবে, দেখা শোনা করার কেউ থাকবে না। তখন এই স্কিমটি কার্যকর হিসাবে বিবেচিত হবে।
আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে এর বাস্তবায়ন শুরুর আশা প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, আইন করব, আইনের মধ্যেই সব কিছু থাকবে। আইন ও বিধি একসাথেই প্রণয়ন করা হবে। এরপরে বাস্তবায়নকালীন সময়ে প্রয়োজন হলে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যাবে। অংশগ্রহণকারীরা যতটুকু দেবেন, সরকারও সেখানে ততটুকু দেবে এবং সেখানে লাভসহ সরকার ফেরত দেবে। প্রতিবেশী দেশগুলো যেভাবে চালায়, সেখান থেকে দেখে আমরা আরও সংযুক্ত করব।
একটি লাভের হিসাব : এই পেনশন ব্যবস্থায় লাভের একটি আনুমানিক হিসাব সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, যদি মাসিক চাঁদা ১০০০ টাকা, মুনাফা ১০ শতাংশ ও আনুতোষিক ৮ শতাংশ ধরা হয়, ১৮ বছর বয়সে যদি কেউ চাঁদা দেওয়া শুরু করে এবং ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তা চালু থাকে, তাহলে ওই ব্যক্তি অবসরের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা করে পেনশন পাবেন।
যদি ৩০ বছর বয়সে চাঁদা দেওয়া শুরু হয় এবং ৬০ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে, তাহলে অবসরের পর প্রতিমাসে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন। তবে চাঁদার পরিমাণ ১০০০ টাকার বেশি হলে আনুপাতিক হারে পেনশনও বেশি হবে। মন্ত্রী বলেন, এটি একটি আনুমানিক হিসাব। আইন ও বিধি প্রণয়ন এবং পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার পর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅর্থ আত্মসাৎ মামলায় সাবেক প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি কারাগারে
পরবর্তী নিবন্ধডিআইজি মিজানের ৩ বছর সাজা, দুদকের বাছিরের ৮ বছর