দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে দেওয়া ইশতেহারে সরকারি-বেসরকারিসহ সকল ধরনের অনানুষ্ঠানিক খাতের জন্য পেনশন ব্যবস্থার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শ্রদ্ধেয় আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে এ সংক্রান্ত একটি রূপরেখা দিয়ে পাইলট প্রকল্প উপস্থাপন করেছিলেন। ধারাবাহিকতায় বিশ্বপরিমন্ডলে উন্নয়ন-অগ্রগতির রোল মডেলে মর্যাদাসীন বাঙালি জাতি রাষ্ট্র-সরকার ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী নাগরিকের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ অর্থমন্ত্রণালয় কর্তৃক আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার আলোকে প্রণীত ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’র উপর কৌশলপত্র উপস্থাপনকালে মুক্তির মহানায়ক জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর নির্দেশনা এবং এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন। সম্মানিত অর্থমন্ত্রী আগামী ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে এটি কার্যকর করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তুতকৃত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি পেনশন একাউন্ট এবং মাসিক সর্বনিম্ন জমার অর্থ নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসীরা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে অর্থ জমা দিতে পারবে। সঠিক সময়ে অর্থ জমাদানের ব্যর্থতায় হিসাব সাময়িকভাবে বন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে জরিমানাসহ বকেয়া পরিশোধ করে হিসাব সচল করা যাবে। ন্যূনতম ১০ বছর কিস্তি জমা অব্যাহত থাকলে পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হবে। ৬০ বছর পূর্তির পর নির্ধারিত হারে আমৃত্যু পেনশন পাওয়া যাবে। ৭৫ বছর বয়সের পূর্বে কেউ মারা গেলে তার মনোনীত নমিনি ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন পাওয়ার অধিকার রাখবে। কিন্তু জমাকারীর অবর্তমানে এককালীন টাকা তোলার সুযোগ থাকবে না। আবেদনের প্রেক্ষিতে পেনশনের বিপরীতে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সুদহারে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। ১০ বছর অর্থ জমা দেওয়ার পর কেউ মারা গেলে টাকা পাবে তার নমিনি। পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ-পরিচালনার জন্য একটি আলাদা পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন এবং পৃথক আইন প্রণয়ন প্রস্তাবে তদারকি-জবাবদিহিতার উর্বরক্ষেত্র নির্মিত হবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত জমা দেওয়া অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত ও মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে।
সর্বজনীন এই পেনশন ব্যবস্থা হবে সম্পূর্ণ স্থানান্তরযোগ্য এবং সহজগম্য। কেউ স্থান পরিবর্তন করলেও তার অবসর হিসাবের স্থিতি, চাঁদা ও অবসর সুবিধা চলমান থাকবে। দরিদ্র নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক জমার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পেনশন কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের জমাকৃত অর্থ নির্ধারিত গাইডলাইন অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে। এছাড়াও সংস্থাটির পক্ষ থেকে অনুমানভিত্তিক এক হিসাবে বলা হয়েছে, কেউ ১৮ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা জমা দিলে ১০ শতাংশ মুনাফা এবং আনুতোষিক ৮ শতাংশ ধরে ৬০ বছর বয়সের পর ৮০ বছর পর্যন্ত প্রতিমাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা পেনশন পাবে। কেউ ৩০ বছর বয়সে অর্থ জমা দিয়ে ৬০ বছর পর্যন্ত নিয়মিত রাখলে অবসরের পর প্রতি মাসে পেনশন পাবে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা। জমাকৃত অর্থ এক হাজারের বেশি হলে আনুপাতিক হারে পেনশনের পরিমাণও বেশি হবে। উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে পেনশন সুবিধা ভোগকারী সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এই কর্মসূচির বাইরে থাকবেন।
দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদরা সরকারের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর গণমাধ্যমে জানান; ‘নরওয়ে, সুইডেনের মতো উন্নত দেশগুলোতে অনেক আগে থেকেই এ ধরনের পেনশন স্কিম চালু রয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। কারণ আমাদের দেশের বেসরকারি খাতের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা তেমন কিছুই নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই পেনশন স্কিমের নিয়মকানুনগুলো খুবই সরল এবং সবার জন্য পালনীয় করে তৈরি করতে হবে। তা ছাড়া আমাদের দেশে বেসরকারি খাতের চাকরিতে আনেক অস্থিতিশীলতা রয়েছে। অনেকেই হয়তো মাঝপথে চাকরিহারা হয়ে যেতে পারেন, সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন না। কিন্তু তারপরও যেন এককালীন পরিশোধের মাধ্যমে স্কিমটি সচল রাখা যায়; সে বিষয়ে অনেক নমনীয় নীতিকাঠামো তৈরি আবশ্যক। সরকারি কর্মীদের পেনশন তোলার ক্ষেত্রে যে ধরনের হয়রানি দেখা যায়, তেমনটাও যাতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে না ঘটে সেজন্য আগে থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তহবিল ব্যবস্থাপনায় দক্ষ একটি গোষ্ঠীকে দিয়ে এই স্কিম পরিচালনা করা হলে তা টেকসই রূপ পরিগ্রহ করবে। কারা এই সুবিধা পাওয়ার যোগ্য তা নির্বাচনেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।’ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা বলেন, ‘বেসরকারি খাতে পেনশন স্কিমটি খুব ভালোভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য। তবে এ জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। আইন প্রণয়ন ও কর্তৃপক্ষ গঠনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মতামত গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।’
স্মরণযোগ্য বিষয় হচ্ছে, সর্বজনীন পেনশন প্রথা বিশ্বে নতুন কিছু নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই ইতিমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। বর্তমান বিশ্বের সর্বোত্তম পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনার খ্যাতিশীর্ষে রয়েছে আইসল্যান্ড। ভালো করছে নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুরসহ প্রভৃতি দেশ। সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, বয়স্ক সব জনগোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত অবসর সুবিধার আওতায় আনা এবং রাষ্ট্রীয় উদার আর্থিক সমর্থন নিশ্চিতের কারণেই দেশগুলো বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। বিশ্বে সাধারণত আনফান্ডেড, ফান্ডেড, ডিফাইন্ড বেনিফিটস (ডিবি), ডিফাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস (ডিসি)- এই চার ধরনের পেনশন পদ্ধতি চালু আছে। আনফান্ডেড পেনশনে কোনো কর্মীকে চাঁদা দিতে হয় না বলে এর জন্য কোনো তহবিলও সৃষ্টি হয় না। ফান্ডেড পেনশনে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান বা উভয়কেই চাঁদা দিতে হয়। ডিবি পদ্ধতি সরকারি কর্মচারীদের জন্য। ডিসি পদ্ধতিতে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি তহবিলে অর্থ জমা এবং সেখান থেকেই ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কোনো কোনো দেশে বীমা কোম্পানির মাধ্যমেও পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে। তবে বাংলাদেশে কোন ধরনের সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে তা এখনো যথার্থ পন্থায় নির্ধারিত হয়নি। অর্থমন্ত্রী বিষয়টি সমীক্ষা পর্যায়ে রয়েছে বলে গণমাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে জাতীয় পেনশনব্যবস্থা (এনপিএস) চালু করা হয়। যেটি সর্বপ্রথম সামরিক বিভাগ ছাড়া শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। ২০০৯ সালের ১মে দেশের ভেতরে ও বাইরে থাকা ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী সব নাগরিকের জন্য পেনশনব্যবস্থা উন্মুক্ত করা হয়।
পক্ষান্তরে যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয়, পেশাগত, ব্যক্তিগত ও আনফান্ডেড এই চার ধরনের পেনশনব্যবস্থা চালু রয়েছে। রাষ্ট্রীয় পেনশনেও রয়েছে রাষ্ট্রীয় অবসরভাতা, সম্পূরক পেনশন ও পেনশন ক্রেডিট নামক তিনটি অংশ। রাষ্ট্রীয় অবসর ভাতার আওতায় যাদের বার্ষিক আয় ৯ হাজার ৫০০ পাউন্ডের বেশি তাদের বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হয় জাতীয় বীমায়। যাদের আয় রাষ্ট্রনির্ধারিত নিম্ন আয়সীমার নিচে তাদের দেওয়া হয় ঐচ্ছিক সম্পূরক পেনশন। পেনশন ক্রেডিট হচ্ছে, স্বল্প আয়ের ৬০ বছরের বেশী বয়সীদের জন্য। পেশাগত পেনশন হচ্ছে কর্মীর বেতন থেকে ৩ শতাংশ এবং সরকার বা কোম্পানি থেকে ৫ শতাংশ জমা হওয়ার পদ্ধতি। এটা বিনিয়োগ করে মুনাফার টাকাসহ পেনশন দেওয়া হয়। এছাড়া আনফান্ডেড পদ্ধতিতে পেনশন দেওয়া হয় সামরিক, সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষকদের। আর ব্যক্তিগত পেনশন হচ্ছে বীমা কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে পেনশনব্যবস্থা সম্পর্কে বলা আছে-বার্ধক্যজনিত কারণে যারা অভাবগ্রস্ত হবেন, তাদের এই সুবিধা দেওয়া হবে। এই অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন হবে। এই সাহায্য পাওয়া রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর(বিবিএস) জরিপ অনুসারে, ২০২০ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৮২ লাখ যা ২০২১ সালে ১৬ কোটি ৯১ লাখে উন্নীত হয় বলে প্রাক্কলন করা হয়। দেশের জনসংখ্যার ৫৪ দশমিক ৯ শতাংশ হচ্ছে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী। এই হিসেবে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী জনসংখ্যা ৮ কোটি ৭৩ লাখের কমবেশ হতে পারে বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। মূলত সমাজে জনগোষ্ঠীর ১৪ শতাংশের বয়স যদি ৬৫ বা তার বেশি হয় তাহলে সেই সমাজকে বৃদ্ধ সমাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং বয়স্ক পর্যায় থেকে বৃদ্ধ পর্যায়ে রূপান্তরিত হতে সময় লাগে মাত্র ১৮ বছর।
সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রদত্ত তথ্যানুসারে, ২০৪৭ সালে বাংলাদেশ একটি বৃদ্ধ সমাজে রূপান্তরিত এবং ২০২৯ সালে ‘বয়স্ক সমাজ’ হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছাবে। এই ১৮ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ যে গতিতে বয়স্ক থেকে বার্ধক্য পর্যায়ে পরিবর্তিত হবে; তা এশীয় উন্নত দেশ ও সমৃদ্ধ ইউরোপীয় দেশগুলোর গতির তুলনায় খুব বেশি। সমসূত্র মতে, ২০৪০ সালে প্রতি ছয়জন কর্মক্ষম মানুষের বিপরীতে একজন প্রবীণ নির্ভরশীল ব্যক্তি থাকবে। আর ২০৬৫ সালে এ অনুপাত হবে প্রতি তিনজনে একজন। ফলশ্রুতিতে ২০৪০ সালের পর দেশের সরকারকে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর পেনশন সুবিধা বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। বিজ্ঞজনদের মতে, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সর্বজনীন পেনশন সুবিধার আওতায় এনে তার কার্যকর বাস্তবায়ন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। প্রত্যাশিত সমূদয় আশঙ্কাগুলো উত্তরণে সমন্বিত-প্রায়োগিক কর্মকৌশলের মাধ্যমে কার্যকর নীতি নির্ধারণ সময়ের জোরালো দাবি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতগুলো নানামুখী প্রণোদনায় ইতিমধ্যে বিপুল সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। আগামীতে বার্ধক্য-বয়স্ক-অসহায় সময়কালে এর বাস্তবতা যৌক্তিক মূল্যায়নে বিবেচনা করা জরুরি। অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ এ ধরনের সামাজিক খাতগুলোর নবতর আবিষ্কারে অধিকতর সচেতন হবে – এই প্রত্যাশাটুকু ব্যক্ত করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।