সর্বজনীন পথিকৃৎ গাউছুল আজম শাহ্‌সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.)

ওয়াহিদ মনজুর | সোমবার , ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:২৬ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বভুবনের একমাত্র প্রভু পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতকে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিপালন করেন। সকল কিছুর মূল উদ্দেশ্য হলেন তিনিই। সকল সৃষ্টির মূলে তিনিই। সৃষ্টির সফলতা অর্থাৎ সৃষ্টির সৌন্দর্য তখনই বিকশমান হয়, যতদিন সৃষ্টি স্রষ্টার উদ্দেশ্যকে যথাযথ প্রতিফলন ঘটায়। মহান প্রভুর তাঁর সৃষ্টির সাথে এক অভিনব, অতুলনীয় ও রহস্যপূর্ণ প্রণয় সংশ্রবী বন্ধন রয়েছে। তা কালের দূরত্বে আলমে নাছুত বা দৃশ্যত জগতের মহা ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ প্রলোভন ও নফসানিয়্যতের মোহে সেই বন্ধনে আবরণের কঠোরতা গ্রাস করে ফেলে, তাই যুগযুগান্তরে ঐ পরিচিত জ্ঞান ও প্রেম প্রীতিময় বন্ধনকে উন্মোচনে, তাঁর সুমধুর শান্তিময় পবিত্র মিলন ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, তাঁর মনোনীত নবী ও অলিরা পথভ্রান্তমানবদের একমাত্র প্রদর্শক ও উন্মোচক। তাই হাদিস দর্শনে ‘মোজাদ্দিদ’ তথা যুগসংস্কারকের আবির্ভাবের কথা বিশুদ্ধ হাদিসেও রয়েছে।

প্রাণোত্তম বিশ্ব রহমতের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিরোধানের পর থেকে আজ অবধি যুগের চাহিদানুযায়ী তথা বিভিন্ন সংস্কারক মহান আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত সংস্কার কার্য করেছেন। কালের দূরত্বে মানব বিভিন্ন সভ্যতার কঠিনতম প্রলোভনীয় ও চিত্তাকর্ষক পার্থিবতার সব নব্য কৌশলের ক্রিয়ায় ন্যায়, চিরসত্য, প্রেমময় ও খোদা তত্ত্বজ্ঞানী ভাবধারা থেকে বিচ্যুত মানবকূলকে তাঁরায় স্মৃতি, প্রীতি ও প্রেম প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তাঁর মহামিলন পথে পৌঁছে দেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, এক মহান আলোকবর্তিকা তৌহিদ পথের অদ্বিতীয় বাহক, মিলনদ্বার ও উদঘাটক হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মোজতাবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতীক ও নায়েব আহমদী বেলায়ত ক্ষমতার ঝাণ্ডাবাহী বিশ্বজনীন বৈষম্যহীন সুফি বা আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী হযরত মওলানা শাহ্‌ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কাদ্দাসা সিররাহুল আজিজ) এর আবির্ভাব ঘটে। তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাব সবখানে দৃশ্যে ও অদৃশ্যে পরিলক্ষিত। তাঁর আদর্শ ভাবধারা ও নির্দেশিত মৌলিক পন্থা অনুসরণ করে মানব সমাজ পঙ্গপালের মতো ছুটে এসে ঐ ঐশী মিলনে একীভূত হয়। যুগ যুগান্তরে যত সংস্কারক এই মানব সভ্যতায় বিকাশ লাভ করেন, তাঁরা যুগের পার্থিব সকল নিত্য নতুন নাছুতী স্বভাব, রিপু ও ইন্দ্রিয় জালের বিপরীতে বিভিন্ন ও অভিনব ধর্মীয় নির্যাস মিশ্রিত উছুল বা পন্থা দ্বারা সত্য পথের দিশা দান করেন, যা সর্বদা সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। এই দিশাসমূহকে সুফি ভাষায় তরিকত বলা হয়। হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (.) এর প্রদর্শিত পথ বা তরিকাও অন্যান্য তরিকাসমূহের মত সময়োপযোগী। ঊনবিংশ শতাব্দী যেমন বিভিন্ন আর্থসামাজিকসাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বা রূপান্তরের জন্য বিখ্যাত তেমনি এই শতাব্দীতে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের পতন ও মানব সভ্যতা অধঃপতনও পরিলক্ষিত। এই পতিত মানবকূল নফসে আম্মারা দ্বারা পরিচালিত হয় যা কুকর্মকে নির্দেশ দেয়। কোরআনে আছে, ‘ইন্নান নাফছা ল আম্মারাতুন বিসসুয়ে’ (অপরিশুদ্ধ সত্তা মন্দ কর্মের নির্দেশক)। এই অপরিশুদ্ধ সত্তাকে মুক্তির লক্ষে মাইজভাণ্ডারী তরিকার নির্দেশিত উছুলে ছাবয়া তথা সপ্ত পদ্ধতি কষ্টি পাথরের মতো। মহামহিম স্রষ্টার অবিনশ্বর বাণীর ‘ক্বাদ আফলাহা মান যাক্কাহা’ (যে নিজেকে শুদ্ধ করেছে, সে সফলকাম) ইশারা এই তরিকার মূল নির্যাস। হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (.) কর্তৃক প্রদর্শিত ও প্রবর্র্তিত এ সপ্ত উছুল সকল মানবকুলকে বৈষম্যহীনভাবে স্রষ্টার নৈকট্য ও ঐক্যের মোহনায় ঐক্যবদ্ধ করে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই তরিকার প্রভাব এই উপমহাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা মহাদেশসমূহে ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। মাইজভাণ্ডারী তরিকার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোতে এক অবিনশ্বর আবেদন রয়েছে, তাই সকল শ্রেণির ও ধর্মের মানুষ নিজেদের পরিশুদ্ধ করণে এতে সামিল হতে পারে। আধুনিক সভ্যতায় জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কৌশলে যেমন যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে, মানুষের ভোগবিলাস, পার্থিব মোহ, অন্যায়অবিচার, সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি, লুণ্ঠনহরণ ও ব্যভিচারের হারও ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানব সমাজ এসব শয়তানী বা নফসের প্ররোচনায় পর্যুদস্ত হয়ে মানসিক শক্তিও ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে। আধুনিক সভ্যতার এই অবক্ষয়ের প্রতিকার রয়েছে মাইজভাণ্ডারী তরিকার এই সপ্ত উছুল বা পদ্ধতিতে। এই মহান সংস্কারকের নির্দেশিত পথে মানুষ নিজেকে পরিচালিত করে পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামেল হয়ে মহান প্রভু কর্তৃক ঘোষিত খলিফা বা প্রতিনিধি করে তুলতে পারবে। এছাড়া এই আধুনিক সভ্যতায় মানুষ পূর্বেকার তুলনায় অনেক বেশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, যা অনেক গবেষণায় ফুটে উঠেছে। আধুনিক বিশ্ব সভ্যতার অতি আধুনিকতাকে এর জন্য দায়ী করা হয়। ঐসব গবেষণায় স্রষ্টার সাথে সম্পর্কিতদের ব্যাপারে মানসিক শক্তির বৃদ্ধির সম্ভাব্যতা তুলে ধরা হয়।

মানব সভ্যতার এই ক্রান্তিলগ্নে মাইজভাণ্ডারী তরিকা একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে আলোর পথ দেখাবে, যা রিপুর বিনাশ সাধন পদ্ধতির নিরিখে শুরু হয়ে আধ্যাত্মিক মৃত্যু পদ্ধতি সাধনের মাধ্যমে উন্নতর মানবরূপে গঠন করবে। গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (.) কালজয়ী দর্শন উছুলে ছাবয়া তাঁরই সাজ্জাদানশীন হযরত মওলানা শাহ্‌ ছুফী সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (.) বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন।

. ‘ফানা আনিল খাল্ক’ অর্থাৎ সৃষ্টির প্রতি আত্মনির্ভরশীল হওয়া। এটি মানুষকে আত্মনির্ভর করে সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে।

. ‘ফানা আনিল হাওয়া’ অনর্থক সব কিছু পরিহার করা। কুচিন্তা, সংকীর্ণতা, সন্দেহসংশয়, কুধারণাসহ সকল অপ্রয়োজনীয়তা থেকে নিজেকে বিরত রাখা হয়।

. ‘ফানা আনিল এরাদা’ নিজের ইচ্ছার ওপরে স্রষ্টার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া, স্রষ্টার উবুদিয়্যত ও খিলাফতের শরাফত ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া। কল্যাণের তরে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নিজেকে রূপান্তরিত করে সকল জাগতিক বিচ্যুতিকে অকল্যাণ জ্ঞান করে নিজেকে পরিপূর্ণ মানব করে গড়ে তোলা। এই রিপু বিনাশ পদ্ধতি মানব সমাজকে পূর্ণ শান্তিময় করে তুলতে পারে। মানব সভ্যতার মুক্তির জয়গানের রূপরেখার দ্বিতীয় পদ্ধতি আধ্যাত্মিক (রূপক) মৃত্যু। মাইজভাণ্ডারী তরিকায় পরিশুদ্ধি করণে নিজেকে আধুনিকতার বৈরী প্রভাব থেকে পরিত্রাণ পেতে এই মৃত্যু পদ্ধতিতে বিকশিত হবে। এই তরিকায় আধ্যাত্মিক মৃত্যুকে বিভিন্ন রং সংশ্লিষ্টতায় ভিন্ন ভিন্ন রূপক অর্থে প্রকাশ করা হয়েছে যা মানুষের আত্মার ব্যাধির সাথে ইঙ্গিতপূর্ণ।

. ‘মউতে আবয়্যাজ’ বা সাদা মৃত্যু: এই মৃত্যু উপবাস ও আত্ম সংযমে আয়ত্ত হয়। সকল আউলিয়া, ঋষিমনীষীরা আত্মোন্নয়ন এর চর্চা করতেন। সকল কুবিষয়াদি থেকে আত্মসংযম করতেন।

. ‘মউতে আছওয়াদ’ বা কালো মৃত্যু: ইহা অপরের শত্রুতা ও সমালোচনার কারণ আপনার মাঝে খুঁজে আপনাকে সংশোধনের মাধ্যমে অর্জিত হয়। সমালোচনা বা নিন্দাকে ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করে তা হাসিল করতে হয়।

. ‘মউতে আহ্‌মর’ বা লাল মৃত্যৃ: ইহা কামভাব ও লোভ লালসা থেকে সংযমের মাধ্যমে অর্জিত হয়।

. ‘মউতে আখজার’ বা সবুজ মৃত্যু: ইহা বিলাসিতা ও সকল অনর্থক অভ্যাস পরিহারে নির্বিলাস জীবন যাপনে অর্জিত হয়।

এই সপ্ত কোরআনী পদ্ধতি মানবের মৌলিক চরিত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে, যা মহান আল্লাহর প্রিয়তম বন্ধু হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (.) প্রবর্তিত তরিকায় নির্দেশিত। সেই শতাব্দীকাল আগে থেকে এই মহান পুরুষের দরবার বিশ্ব সভ্যতাকে লাইট হাউস হিসেবে সুপথ ও মুক্তির দিকে আহবান করছে এবং দীক্ষা দিচ্ছে। এই ধারাবাহিকতা তাঁর বর্তমান উত্তরাধিকারী গদীনশীন ও আওলাদ হযরত মওলানা শাহ্‌ সুফি সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী (.) কর্তৃক এখনো বলবৎ রয়েছে, যাতে অগণিত দিশেহারা মানুষ পথের দিশা পাচ্ছে।

সর্বজনীনভাবে উছুলে ছাবয়া অনুসরণ করে সমকালীন সমাজরাষ্ট্রের নানা সংকটে বিপথগামী তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি মুক্তির অন্যতম পাথেয় হতে পারে। আগামীকাল ১০ মাঘ ২৪ জানুয়ারি এই মহান তরিকার পথিকৃৎ গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী হযরত মওলানা শাহ্‌ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (.) এঁর ওরশ শরীফে তাঁর প্রতি লাখো সালাম।

লেখক : প্রভাষক, গ্লোবাল ইংলিশ কলেজ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, রিসার্চ ফেলো, দারুল ইরফান রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের ভাষার স্বতন্ত্র পরিচয় লিপিবদ্ধ হওয়া জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধপ্রথমবার মোশাররফ করিমের সঙ্গে রাশেদ সীমান্ত