সর্পদংশনের চিকিৎসা : আমাদের করণীয়

প্রফেসর ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী | বুধবার , ২৬ জুন, ২০২৪ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সর্পদংশন প্রায়শ ঘটে। দেশে ১২ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপসহ প্রায় ৮০ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। এদের মধ্যে কেবলমাত্র ৬ ধরনের সাপ বিষধর। যেগুলো হলো. চন্দ্রবোরা,বা ‘রাসেল’ ভাইপার২. গোখরা বা কোবরা, .পদ্ম গোখরা বা রাজ গোখরা বা কিং কোবরা,. শঙ্খিনী বা ব্যান্ডেড ক্রেইট, বা কেউটে, . সবুজ সাপ,বা গ্রীন স্নেক ৬. সামুদ্রিক সাপসী স্নেক।

বিষাক্ত সর্পদংশনের লক্ষণ সমূহঃ যখন রোগীকে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে

 দংশিত স্থানে কোনরুপ চিহ্ন নাও থাকতে পারে। চামড়ার রং পরিবর্তন, কালচে হওয়া, ব্যাথা, দ্রুত ফুলে যাওয়া, ফোস্কা পড়া, পচন, দংশিত স্থান হতে ক্রমাগত রক্তপাত।

 ঘুম ঘুম ভাব।

 অস্বাভাবিক দুর্বলতা।

 চোখের পাতা ভারী হওয়া বা বুজে আসা।

 জিহ্বা জড়িয়ে আসা, কথা বলতে অসুবিধা হওয়া।

 ঢোক গিলতে অসুবিধা, খাওয়ার সময় নাক দিয়ে পানি চলে আসা।

 হাঁটতে অসুবিধা, হাতপা অবশভাব।

 ঘাড় দুর্বল, মাথা হেলে যায়।

 শ্বাস প্রশ্বাসের অসুবিধা।

 কাল রং এর প্রস্রাব।

প্রাথমিক চিকিৎসা

 ‘ভয়ের কোন কারণ নেই, সর্প দংশনের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে’এই মর্মে রোগীকে আশ্বস্ত করা।

 রক্তক্ষরণ হতে থাকলে চাপ দিয়ে ধরে রাখা। দংশিত অংগ (হাত, পা) স্প্লিট/ চেপ্টা/ বাঁশের চেলা এবং ব্যান্ডেজ/ লম্বা কাপড় (৩ থেকে ৪ ইঞ্চি চওড়া) যেমন গামছা, ওড়না ইত্যাদি দ্বারা নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। এমনভাবে যেন বাঁধন অনেক বেশী শক্ত অথবা ঢিলা না হয়। বাঁধনের নিচ দিয়ে যাতে দুটি আঙ্গুল ঢোকানো যায়, তা যেমন বিষের প্রবাহের বাধা দিতে যথেষ্ট কার্যকরী, তেমনি রক্ত চলাচলেরও উপযোগী থাকবে বলা যায়।

 রোগীকে নিথর এবং নিশ্চল হয়ে শুয়ে যেতে হবে, যাতে আক্রান্ত অংগ নড়াচড়া না হয়। কপালের দংশনে: বসে যেতে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতের দংশনে: হাত নড়াচড়া করা যাবে না।

 দংশিত অংঙ্গের (হাতপা) হাড় ভেঙ্গে গেলে স্প্লিন্ট এর সাহায্যে নড়াচড়া প্রতিরোধ করা উচিত। যদি ক্রেপ ব্যান্ডেজ থাকে, তাহলে তাই ব্যবহার করা চলে। দংশনকৃত হাতপা এমনভাবে কাপড় ও কাঠ (বা বাঁশের কঞ্চি) দিয়ে পেঁচিয়ে নিতে হবে, যাতে গিড়া নড়াচড়া করা না যায়। গিড়া নড়াচড়াতে মাংসপেশীর সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধমে শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

 দংশিত স্থানে বিষদাঁতের ক্ষতচিহ্ন আছে কিনা দেখতে হবে।

 দংশনকৃত ক্ষতস্থান কেবলমাত্র একবার ভিজে কাপড় কিংবা জীবানুনাশক লোশনে মুছে ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।

 যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দংশিত অঙ্গ থেকে আংটি, চুড়ি, তাবিজ, তাগা, খুলে ফেলতে হবে। দংশিত অঙ্গ ফুলে গেলে পরবতীতে এগুলো খুলতে অসুবিধা হয়।

 দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ: দংশিত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য মোটর বাইক বা এ্যাম্বুলেন্স এর সাহায্য গ্রহণ।

 রোগীকে একপাশ কাত করে রাখা।

 যদি শ্বাসপ্রশ্বাস না থাকে, তাহলে মুখে বায়ু ঢোকার নল ব্যবহার করা এবং প্রয়োজন হলে কৃত্তিম শ্বাসপ্রশ্বাস সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা।

 কেউ যদি সাপ মেরে থাকে, হাসপাতালে যাওয়ার সময় শনাক্তকরণের জন্য তা নিয়ে যেতে হবে। তবে সাপ মারার জন্য ধরার জন্য অযথা সময় নষ্ট করা যাবে না।

ব্যবস্থাপত্র

 চিকিৎসার স্বার্থে প্রথমে জেনে নেওয়া চাইঐ দংশন বিষাক্ত সাপের ছিল কি না, বা আদৌ বিষক্রিয়া ঘটেছে কি না। কেননা সর্পদংশনের প্রায় ৮০% ঘটে ‘বাবুরাম সাপুড়ের সেই চোখ নেই, কান নেই; করে নাকো ফোঁস ফাঁস’ অর্থাৎ বিষহীন জ্যান্ত সাপের কামড়ে।

 সাধারণভাবে দংশনস্থানে যদি বিষদাঁতের ফুটো না পাওয়া যায়, এবং সে স্থানে কোনো ব্যথা, জ্বালা বা ফুলে যাওয়া অবস্থার সৃষ্টি না হয়, তবে তা বিষাক্ত সাপের কামড়ে নয়এ ধারণা সমীচিন। যদিও পুরোপুরি তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তবে নির্বিষ দংশনে ওষুধের সাহায্যে কোনোরূপ চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। বরং রোগীকে অভয় যোগানো আশু কর্তব্য। যেসব ক্ষেত্রে বিষক্রিয়া ঘটবে বলে ধারণা পাওয়া যায়, সেসবে জরুরি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত জরুরী।

 স্বাস্থ্যসুবিধা নিতে হাসপাতালে পৌঁছাতে বিলম্ব না করা। রোগীকে দ্রুত ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া উচিত। যেখানে সার্বিক পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি শিরায় স্যালাইন, প্রয়োজনে রক্ত বা রক্তের বিভিন্ন অংশ, ধনুষ্টংকারের প্রতিষেধক ব্যবস্থা, অ্যান্টিবায়োটিকস; ব্যথানাশক ওষুধ শিশুর প্রতি কেজি ওজন হিসেবে প্রয়োগ করে থাকেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। সর্বোপরি সাপের বিষের প্রতিষেধক ওষুধ ‘অ্যানটিভেনিন’ ব্যবহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

 এখানে উল্লেখ্য যে, কামড়ানোর ৪ ঘন্টার মধ্যে অ্যান্টিভেনিন ব্যবহার করা হলে সবচেয়ে বেশি সুফল মেলে। কিন্তু ১২ ঘণ্টা পরে প্রয়োগ করা হলে তার কার্যক্ষমতা নিয়ে সংশয় থাকে। হাত বা পা অত্যধিক ফুলে যাওয়াসহ দংশনের স্থানে পচা ঘাএর চিকিৎসায় কোনো কোনো সময় সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। কখনো কখনো সর্পদংশনের রোগীকে সপ্তাহকাল পর্যন্ত হাশপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়।

সর্প সংশনের পর যা করা উচিৎ নয়

 দংশিত অঙ্গে কোন রকম গিঁট দেওয়া যাবে না। বিশেষ সতর্কতা: ইতিমধ্যে যদি গিঁট প্রদান করা হয়ে থাকে তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে, চিকিৎসকের উপস্থিতিতে, কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এন্টিভেনম শুরু করা, অতপর গিঁট অপসারণ করা।

 দংশিত স্থানে কাটা , সুঁই ফুটানো, কিংবা কোন রকম প্রলেপ না লাগানো।

 ওঝা বা বৈদ্য দিয়ে চিকিৎসা করে কিংবা ঝাড়ফুঁক করে অযথা সময়ক্ষেপণ না করা।

 হাসপাতালে নেওয়ার পথে রোগীর কথা বলতে অসুবিধা হলে, নাকে কথা বললে কিংবা মুখ থেকে লালা ঝরলে রোগীকে কিছু খেতে না দেওয়া।

 দংশিত স্থানে কোনভাবেই হারবাল ঔষধ, পাথর, বীজ, মুখের লালা, পটাশিয়াম, কাদা, গোবর, রাসায়নিক জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না। কামড়ানোর জায়গায় এলকোহল জাতীয় কিছু দেয়া যাবে না।

 তেল, ঘি, মরিচ, গাছগাছালীর রস ইত্যাদি খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা অনুচিত।

 ব্যথা উপশমের জন্য অ্যাসপিরিন দেওয়া যাবে না।

সর্প দংশন কীভাবে এড়ানো যায়

 বসতবাড়ির শোবার ঘরের সাথে খাবার সামগ্রী যেমনধান চাল, হাঁসমুরগী, কবুতর না রাখা উত্তম। এসব সমগ্রী ইঁদুরকে আকর্ষণ করে, যার খোঁজে সাপ ঢুকতে পারে। প্রজাতি ভেদে ইঁদুর, ছোট প্রাণী, তেলাপোকা, ঘাস ফঁড়িং সাপের প্রিয় খাবার। বসতবাড়ি সাপ আকর্ষণ করে এমন প্রাণী মুক্ত রাখা যেমন: ইঁদুর, মুরগীর বাচ্চা, গিরগিটি, ব্যাঙ।

 সাপ বসত বাড়ির গর্তে বা ফাটলে লুকিয়ে থাকতে পারে বিধায় এগুলো মেরামত করা।

 খাটের উপর ঘুমানো, মেঝেতে না ঘুমানো। ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা। রাতের বেলায় শস্য, ফলের বাগান, কিংবা মাছ পাহারা দেওয়ার সময় মাটিতে কিংবা মাচায় ঘুমানোর বা শোয়ার ব্যাপারে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন।

 বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা। বাড়ি ও চাষ করার জমির মধ্যে দূরত্ব রাখা। বাড়ির আঙ্গিনা ময়লাআর্বজনা মুক্ত রাখা। সাপ ছদ্মবেশী শিকারী, অর্থাৎ তারা শিকারকে লুকানোর জায়গা থেকে আক্রমন করতে চায়। পাতা, সার, খড়ের গাদা, লাকড়ির স্তুপ, কাটা ঘাসের স্তুপ সাপের জন্য লুকিয়ে থাকার পছন্দনীয় স্থান। কাজেই এগুলো বাড়ির আঙ্গিনা থেকে সরিয়ে নেয়া। উইয়ের ঢিবিতে, গাছের গর্তে, স্তুপকৃত গাছতক্তা, লাকড়ি, ঘন আগাছার মধ্যে হাত না দেওয়া। কাস্তে ও মুঠি দিয়ে পাকা ধান কাটার সময় সাবধানতা অবলম্বন করা।

 ঘরে প্রবেশের পূর্বে লাইটের সুইচ অন করা উচিত। বিছানা, বালিশের নিচ ও স্কুল ব্যাগ যত্ন সহকারে দেখতে হবে। শব্দ করা, যাতে লুকিয়ে সাপ থাকা সাপ সরে যেতে পারে। সাপ বায়বীয় শব্দের প্রতি অপেক্ষাকৃত বধির, তবে ভুগর্ভস্থ কম্পনের প্রতি সংবেদনশীল।

 বেশীরভাগ সাপ রাতে সক্রিয় থাকে। রাতে হাঁটার সময় কিংবা প্রাকৃতিক কাজে বের হলে টর্চ লাইট নিয়ে, ঘাসের মধ্যে কিংবা ঝোপঝাড়ের ভিতর যদি হাঁটতে হয়, তাহলে লম্বা জুতো কিংবা বুট জুতো পড়ে খুব সাবধানে হাঁটা। বড় বড় পাথর বা কাঠের গুড়ি সাবধানে সরানো উচিত।

 মাছ ধরার সময় ‘চাঁই’ বা জালের মধ্যে হাত দেওয়ার আগে সাপ আছে কিনা দেখে নিতে হবে। খালি হাতে সাপ না ধরা, কারণ সাপ মরার ভান করতে পারে।

লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে নারী প্রগতির চার অনন্যা