সরকার ও বিপিসির নিজস্ব অর্থেই হবে দ্বিতীয় ইউনিট

ইস্টার্ন রিফাইনারি বিদেশি ঋণের অপেক্ষায় ৮ মাসে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে ৬৬০০ কোটি টাকা

হাসান আকবর | শুক্রবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ

সরকার এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) যৌথভাবে ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন করবে। দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি ঋণের অপেক্ষা করে প্রকল্প ব্যয় ৬ হাজার কোটিরও বেশি টাকা বেড়ে গেছে। গত ১৫ বছরে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। এভাবে আর সময় নষ্ট না করে সরকার ও বিপিসি যৌথভাবে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটির কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে মোট ব্যয় হবে ৪২ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ৩০ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকার যোগান দেবে, বাকি ১২ হাজার ৪৭৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা দেবে বিপিসি।

দেশের জ্বালানি খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্নমুখী সুবিধার কথা মাথায় রেখেই ইস্টার্ন রিফাইনারির সেকেন্ড ইউনিট নির্মাণ করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশে বর্তমানে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৭০ লাখ টনেরও বেশি। এই বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেলের খুব সামান্য অংশই দেশে পরিশোধন করার সুযোগ রয়েছে। ইস্টার্ন রিফাইনারি বছরে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টনের মতো জ্বালানি তেল পরিশোধন করতে পারে। বাকি সব তেলই বিদেশ থেকে পরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করতে হয়। ক্রুড অয়েল থেকে রিফাইনড অয়েলের মূল্য বেশ চড়া। এতে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ক্রুড অয়েল আমদানি করে দেশে পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা পেতো। কিন্তু ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় দেশে ক্রুড অয়েল আমদানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রায় বাড়তি অর্থ ব্যয় করে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। ইস্টার্ণ রিফাইনারির সক্ষমতা বাড়ানো গেলে এই বাড়তি খরচ সাশ্রয় করা সম্ভব হতো বিশেষজ্ঞদের এমন পরামর্শের প্রেক্ষিতে ১৯৬৮ সালে নির্মিত দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত্ব রিফাইনারিটির উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১০ সালে গ্রহণ করা হয় ইস্টার্ণ রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ প্রকল্প। বছরে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারি২ নামে নতুন একটি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ওই সময় প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। পতেঙ্গায় ইস্টার্ণ রিফাইনারির ২শ’ একর জায়গার একপাশের ৭০ একর জায়গায় দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ঢিমেতালে চলা প্রকল্পটির ব্যয় ইতোমধ্যে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়েছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) নানাভাবে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে সফল না হওয়ার পর সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিল। যাতে বিপিসি ৩০ শতাংশ অর্থ যোগান দেয়ার প্রস্তাব করে বাকি ৭০ শতাংশ অর্থ সরকারের তহবিল থেকে ঋণ হিসেবে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সরকার এতে অর্থায়নের সম্মতি জানিয়েছিল।

বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই উদয় হয় এস আলম গ্রুপ। তারা প্রকল্পটিতে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়। ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিটশীর্ষক প্রকল্পটি ইআরএল এবং এস আলম গ্রুপের সাথে এমওইউ স্বাক্ষর করা হয়। এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে ৩০ লাখ টনের পরিবর্তে ৫০ লাখ টন শোধনের ধারণক্ষমতা করার প্রস্তাব দেয়া হয়।

এস আলম গ্রুপের সাথে যৌথভাবে ইস্টার্ণ রিফাইনারি নির্মাণের ব্যাপারে নানা প্রক্রিয়া চালানো হয়। প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত করে দেয়া হয় মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। ওখান থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগেই কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সৃষ্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতন হলে ইস্টার্ণ রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিটের সব কার্যক্রমই মূলতঃ মুখ থুবড়ে পড়ে। ইতোমধ্যে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে এস আলম গ্রুপ

দিশেহারা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গত বুধবার ঢাকায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এস আলমের সঙ্গে করা চুক্তিও বাতিল করা হয়। বাতিল করা হয় পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের বিষয়টিও।

বিপিসি প্রকল্পটি নিয়ে লেগে থাকে। ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের আধুনিকায়ন ও সমপ্রসারণ (ইআরএল)’ নামের এই প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩০ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা দেবে সরকার এবং ১২ হাজার ৪৭৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা আসবে বিপিসির তহবিল থেকে। প্রকল্পটি ২০৩০ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কিছুদিন আগেও প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ৩৬ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণের আশা করে সময়ক্ষেপণ করায় গত ৮ মাসে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ৬,৬০০ কোটি টাকা। এভাবে আরো সময়ক্ষেপণ করলে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। আগে উদ্যোগ নিলে প্রকল্পটি অনেক কম খরচে করা যেতো বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ২০১০ সালে মাত্র ১৩ হাজার কোটি টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুযোগ ছিল। এর আগে সরকার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর কাছ থেকে ঋণ সহায়তা চেয়েছিল। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। ফলে প্রকল্পটিকে ২০২৫২৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অন্তর্ভুক্ত করে সরকার ও বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ইআরএল২ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের পরিশোধন সক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। এতে আমদানিনির্ভরতা কমবে, পরিবহন ব্যয় ও পণ্যের দাম হ্রাস পাবে, এবং ইউরো৫ মানের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎপাদন সম্ভব হবে। ফলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও পরিবেশ সুরক্ষায় এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

উল্লেখ্য, ইস্টার্ণ রিফাইনারি আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল পরিশোধন করে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, বিটুমিন, এলপিজি, জেট ফুয়েলসহ ১৭ ধরনের পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট উৎপাদন করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপির জন্য ‘সেক্রেফাইস করেছি’, এখন আগে গণভোট চাই : তাহের
পরবর্তী নিবন্ধসিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মশিউর গ্রেপ্তার