সরকারের সমস্ত অর্জন বিফলে যাবে, যদি প্রকৃত শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি না পায়

নেছার আহমদ | সোমবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:২৩ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ এর রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকেল ৪.২১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পরাজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমপর্ণের মধ্যে দিয়ে মুক্তিকামী মানুষের ওপর তাদের অত্যাচার নির্যাতনের পর নেমে আসে এক প্রশান্তি এবং সমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ দুইযুগের পাকিস্তানি শোষণবঞ্চনার কলঙ্কময় অধ্যায়। দুঃশাসন, নির্যাতন ও বঞ্চনার কবল থেকে মুক্ত হয় বাঙালি জাতি। জন্মলাভ করে নতুন দেশ ‘বাংলাদেশ’।

৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও নিরোধ দিবস হিসেবে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও পালিত হয়েছে। স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তীর পরবর্তী বিজয় দিবসের এ সময়ে ১৯৭১ এর বাংলাদেশে নির্বিচার গণহত্যার ব্যাপারে এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বা সংস্থাগুলোকে অবহিত করাও সম্ভব হয়নি। এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ উদ্যোগের অভাব লক্ষ্যণীয়। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাবে গণহত্যায় অংশ নেওয়া যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি হানাদারদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

তবে বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন ধরেই দেশে বিদেশে কাজ করছে সচেতন মহল। সাম্প্রতিক সময়ে স্বীকৃতি আদায়ে কাজটি আরও জোরদার হয়েছে। ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৯ তম সভায় ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। গণহত্যা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানো দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য। জাতিসংঘ এ দিন প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে গণহত্যায় উস্কানি না দেওয়া ও গণহত্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার এবং এদেশীয় রাজাকারদের দ্বারা যে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তার জন্য দিবসটি বাংলাদেশের জন্য এবং বাঙালির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ ‘অরাপেশন সার্চ লাইট’ নামে বাঙালি নিধন শুরু করেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তর, ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বন্দুক ও কামান দিয়ে হামলা চালিয়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।

সে ভয়াবহ রাতের কয়েক ঘণ্টার হামলায় কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা। ১৯৭১ এর পরবর্তী নয় মাস এ ধরনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত ছিল। সরকারি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। ১৯৭১ এর রক্তাক্ত ইতিহাস বাঙালিকে প্রতিনিয়ত কাঁদালেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ গণহত্যা সম্পর্কে তেমন অবগত নয়। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান এর তথ্য মতে, ‘২০০১ সালে ইউনেস্কোর কাছে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। পরে ২০০৪ সালে ২৫ মার্চকে গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়’। আবেদনের জবাবে ইউনেস্কো জানান যে, ‘স্বীকৃতি পেতে হলে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে তা তুলে ধরতে হবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতি নিয়ে তা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাস করাতে হবে।

বর্তমানে সরকারিভাবে না হলেও বিভিন্ন সংস্থা এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, ‘১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশম্যান্ট অব ক্রাইম অব জেনোসাইড’ গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ রয়েছে। ‘কোনো জনগোষ্ঠীকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতি সাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতি সাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য জনগোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া,’ এই পাঁচটি উপাদানের সবকটি বিদ্যমান ছিল একাত্তরের গণহত্যায়। ২৫ মার্চের গণহত্যা তাই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি রাখে।

৮ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় ব্রাসলেসে ইউরোপীয় কমিশনের সামনে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিতে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সর্বইউরোপীয় শাখা এ সমাবেশের আয়োজন করে।

গণহত্যার ইতিহাসের ভয়াবহতা ও নৃশংসতার দিক থেকে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা ইতিহাসে অন্যতম বলে উল্লেখ করেছে নিউজউইক। সর্বদিক বিবেচনায় ‘পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মানুষ জাতিগত, ভাষাগত, সংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে আলাদা। সুতরাং বাঙালির উপর পাকিস্তানের সংঘটিত নৃশংসতা অবশ্যই ১৯৪৮ এর কনভেনশনে উল্লেখ করা গণহত্যার শামিল।

সরকার মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছেন। স্বাধীন বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ধরণের সুযোগসুবিধার আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছে সরকার। এই লক্ষ্যে দেশজুড়ে চলছে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেঙ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। ইতিমধ্যে দেশে ৬৪ জেলায় শেষ হয়েছে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণোত্তর সম্মাননা জানাতে কবর নির্মাণের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে একই নক্‌শায়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের জন্য সরকারের নেয়া এতসব উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সমাজের নানা শ্রেণির ও পেশার মানুষেরা। কিন্তু সরকারের এতোসব আয়োজন অতি উৎসাহী নামধারী, সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা এবং সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। সরকারের সব পরিকল্পনা বিফলে যাবে যদি প্রকৃত শহীদ ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি না পায়। আমার জানা মতে, ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর শহীদ এবং সেনাবাহিনীর কর্মরত অবস্থায় শহীদ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বীকৃতি প্রাপ্ত শহীদদেরকে শহীদের মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না। বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বীকৃতি এ সনদের এখন কোন মূল্য নেই। স্থানীয় চেয়ারম্যান বা দুয়েকজন সঙ্গীদের সনদের মাধ্যমেই মিলবে শহীদের মর্যাদা। (চেয়ারম্যান যদি রাজাকারও হয় কোনও অসুবিধা নেই) হাইরে স্বাধীনতা! সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের অসংখ্য শহীদের নাম, যারা স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক সম্মানীত হয়েছিলেন। দুঃখজনকভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের নিকট বঙ্গবন্ধুর সনদ মূল্যহীন। যা জাতি হিসেবে আমাদেরকে লজ্জিত করে। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ করছে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা সুযোগসন্ধানী স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকর্তাদের কারণে এবং তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে যদি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সনদ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সত্যিকারের মূল্যায়ন না হয় তবে সরকারের সব পরিকল্পনা অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং সরকারের সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিজয় মাসের এ সময়ে আমি অনুরোধ করব, পত্রপত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সনদ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হোক।

আজ আমাদের ৭১ এর গণহত্যাকে যেন ভুলে না যাই সে দিকে নজর দিতে হবে। বাঙলি জাতির স্বাধীনতার জন্য এত বিশাল গণহত্যার শিকার অন্য কোনও জাতিকে হতে হয়েছি কিনা আমার জানা নেই। বাঙালি জাতির মতো আর কোনও জাতিকে তার খ্যাতনামা শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতার বেদিমূলে উৎসর্গ করতে হয়েছিল কিনা তাও আমার জানা নেই।

বাঙালি জাতির মতো এত অল্প সময়ে তার শ্রেষ্ঠ সন্তান ত্রিশ লাখ মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ এবং প্রায় দুই লাখ বীর নারীকে তাদের সম্ভ্রম বিসর্জন দিতে হয়েছিল কিনা জানা নেই।

১৯৭১ এর বাংলাদেশ সম্পর্কে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ২৯তম অধিবেশনে যে নীতিমালা ও প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল তাতে ছিল ‘যে হাজার হাজার বাঙালি নির্যাতনযন্ত্রণাভোগ করেছে, নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছে। তাদের লক্ষ লক্ষ বিধবা ও এতিম সন্তান এবং যারা বেঁচে গেছে তাদের এটা আশা করার অধিকার রয়েছে যে, যারা এসব ঘৃণ্য অপরাধের জন্য দায়ী, তারা যেন বিচার থেকে রেহাই না পায় এবং অপরাধীদের বিচার করার অধিকার এবং কর্তব্য বাংলাদেশের রয়েছে। অর্থাৎ কর্তব্য বাংলাদেশের সরকারের এবং জনগণের রয়েছে’।

এই অধিবেশনে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞা দেওয়া হয় এবং ওর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল ১৯৭৪ সালে সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায় তারা যেন আন্তর্জাতিক আইন ও তাদের নিজেদের দেশের আইন অনুযায়ী এই ধরনের অপরাধে অপরাধীদের গ্রেফতার করে উন্মুক্ত বিচারালয়ে শনাক্ত করে ন্যায় বিচার করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরেই আজ বাংলাদেশ বিশ্বে একটি আলোচিত নাম, উন্নয়নের রোল মডেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলার আকাশের এক জ্বলন্ত ধ্রুবতারা। হাজারো সংকট দুঃসাহসিক, কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দেশকে যে পর্যায়ে দাঁড় করিয়েছেন যা তার তেজোদীপ্ত উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের আপন আলোয় পথ দেখে নিয়ে অবিস্মরণীয় সংগ্রামী যাত্রা।

লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাহানশাহ্‌ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারীকে (ক) যেমন দেখেছি
পরবর্তী নিবন্ধনীরব শত্রু কীটনাশক ও আমাদের খাদ্যচক্রে শাক-সবজি