যে কোন কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হলে যথাসময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। যেমন, যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেয়ায় চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রথমত চলতি বছর বোরোর বাম্পার ফলন হলেও কৃষি মন্ত্রণালয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত কৃষক, আড়তদার ও চাল মালিকদের কী পরিমাণ চাল আছে তার কোন সঠিক তথ্যও নেই। এ অবস্থায় চালের দাম বেঁধে দিয়ে এবং খোলা বাজারে বিক্রি বাড়িয়েও সরকার খাদ্য পণ্যটির মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। ক্রমেই বাড়ছে এর দাম। চালের বাজারে বিরাজমান ঊর্ধ্বমুুখী প্রবণতার মধ্যেই খবর মিলছে দেশে চাল উৎপাদন কমতে পারে। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসিডিএ) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, গত অর্থ বছরের তুলনায় দেশে এবার চালের মোট উৎপাদন কমতে পারে সাড়ে পাঁচ লাখ টন। সংস্থাটির প্রাক্কলন গভীরভাবে আমলে নিতে হবে। একেতো কোভিড ১৯ এর অভিঘাত আছে। তারওপর দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাত এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুই দফা বন্যায় আমন চাষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক জায়গায় বীজতলা নষ্ট হয়েছে। সরকার কৃষি উপকরণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিলেও শতভাগ জমিতে আমন ধান লাগানো সম্ভব হয়নি। ফলে আমনের উৎপাদনে বড় বিপর্যয়ের কারণে চালের উৎপাদন হ্রাস পেতে যাচ্ছে। এছাড়া আগামী বোরো উৎপাদনও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবার চালের সরকারি মজুদও কমার খবর মিলছে। এটি অব্যাহত থাকলে আপদকালীন পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেমন কঠিন হবে, বাজার অস্থিতিশীলতা রোধ করাও সম্ভব হবে না। এটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। আগের ব্যর্থতা পর্যালোচনা করে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ন্যায্যমূল্য ধান সংগ্রহ অভিযান জোরদার করতে হবে। উল্লেখ করা দরকার যে বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্য সম্পর্কিত নীতি প্রণয়নে যথাযথ তথ্য-উপাত্তও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি মজুদের পরিমাণ জানা গেলো বেসরকারি খাতে চালের মজুদ কত আছে, তার পরিসংখ্যান জানা নেই। এ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ প্রথমে করতে হবে। সঠিক তথ্যের মাধ্যমে ঘাটতি নির্ণয় পূর্বক প্রয়োজনে আমদানি করতে হবে। সরকার অবশ্য তিন লাখ টন চাল আমদানির বিষয়ে এরই মধ্যে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি মজুদ পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে কিনা এবং বাজারে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে ঠিক কি পরিমাণ চাল আমদানি করা প্রয়োজন তা নিরুপণ করা জরুরি। আমদানি বিষয়ে নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। কয়েক বছর ধরে চাল আমদানি বেসরকারিখাতে ছেড়ে দেওয়ায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আমদানি হয়েছে। এতে ভোক্তারা লাভবান হলেও কৃষক তার পরিশ্রম লব্ধ ফসলের দাম পাননি। কাজেই বেসরকারি আমদানিকারকদের এবার চাল আমদানির অনুমতি দেয়াটা ঠিক হবে কিনা, সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে। বরং কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং বাজার ভারসাম্যহীনতা প্রতিরোধে এক্ষেত্রে সরকারের অগ্রণী ভূমিকা নেওয়াটা কাম্য। করোনায় বৈশ্বিক খাদ্যবাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়ার আভাস আগেই দিয়েছিল এফএও। তার বাস্তব রূপ এখন দৃশ্যমান। চীন, ভারত, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ প্রভৃতি রফতানিকারক দেশ নিজস্ব মজুদ বাড়াতে চাল রফতানি সীমিত করেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে চালের আমদানি বাজার আরও সংকুচিত হতে পারে। সুতরাং বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে দ্রুততার সঙ্গে কোন কোন দেশ থেকে চাল আমদানি করা যায় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আর কাজটি করতে হবে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। অনেক সময় মজুদ সন্তোষজনক থাকলেও বাজার কারসাজি ঘটে। মূলত বাজারকে অস্থির করে বিপুল মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার জন্য এক শ্রেণির ব্যবসায়ী এমনটি করে থাকে। কাজেই নিয়মিত বাজার নজরদারিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চালের দামের বর্তমান ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার প্রেক্ষাপটে খাদ্যমন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংস্থা এই হুঁশিয়ারি আমলে নেয়ার লক্ষণ নেই। চালের দাম বাড়ার জন্য মিল মালিক ও আড়তদাররা একে অন্যের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। প্রকৃত দায় কার তা নির্ণয় করার দায়িত্ব সরকারে। সেজন্য প্রয়োজন সার্বক্ষণিক তদারকি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক্ষেত্রে বিশেষ সক্রিয়তা দরকার। শুধু তদারকি থাকলে হবে না। বাজারে তার যোগানও নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববাজার ও স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় চালে মজুদ বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজার অস্থিরতা রোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, এটিই প্রত্যাশা।