হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন ঘিরে ধর্মীয় উন্মাদনা ও উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধ না করলে সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে বলে হুঁশিয়ার করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় গত তিন দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর, সংঘাত ও প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে সরকারের এই সতর্কবার্তা এল।
গতকাল রোববার সকাল থেকে হেফাজতে ইসলামের ডাকে হরতালের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় ধর্মভিত্তিক ওই সংগঠনের কর্মীরা। বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত দুদিন যাবত কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ধর্মীয় উন্মাদনায় চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, সরাইল এবং আশুগঞ্জে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করছে। যার মধ্যে উপজেলা পরিষদ, থানা ভবন, সরকারি ভূমি অফিস, পুলিশ ফাঁড়ি, রেলস্টেশন, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের বাড়িঘর, প্রেসক্লাবসহ জানমালের ক্ষয়ক্ষতি করে যাচ্ছে। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
এ জাতীয় ক্ষয়ক্ষতিসহ সকল প্রকার উচ্ছৃঙ্খল আচরণ বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। অন্যথায় জনগণের জানমাল ও সম্পদ রক্ষার্থে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা শুক্রবার জুমার নামাজের পর হাটহাজারীতে থানা ও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা করলে সংঘর্ষে চারজন নিহত হন।
এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে শুক্রবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যাপক তাণ্ডব চালায় কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা। তারা রেলওয়ে স্টেশনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে। জেলা শহরের কাউতলি এলাকায় পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং ২ নম্বর পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা করে। শহরের বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুক্তমঞ্চ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা, পৌর মার্কেট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন এলাকায় টানানো ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ছিঁড়ে অগ্নিসংযোগ করে। বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করে।
এরপর হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে শনিবার বিক্ষোভ এবং রোববার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের কর্মসূচি দেওয়া হয়। এর মধ্যেই শনিবার বিকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে মাদ্রাসা ছাত্ররা ফের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়, সেখানে অন্তত ৫ জন নিহত হন।
এদিকে গতকাল হরতালের মধ্যে সকাল থেকে নারায়ণগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে হেফাজত কর্মীরা। সেখানে তারা শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করেছে, আগুন দিয়েছে ডজনখানেক গাড়িতে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টানা তৃতীয় দিনের মতো তাণ্ডব চালিয়েছে মাদ্রাসার ছাত্ররা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলা শহরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে হেফাজতকর্মীরা। পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে অন্তত দুজন হাসপাতালে মারা গেছেন। সংঘর্ষের খবর এসেছে মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, সিলেটসহ আরও কয়েকটি জেলা থেকে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকার আরো উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে যে, স্বার্থান্বেষী মহল এতিম ছাত্র ও শিশুদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামিয়ে সরকারি সম্পত্তিসহ জনগণের সম্পদ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের অপকর্মে নিয়োজিত করায় প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসত্য, গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব গুজব রটনাকারীসহ আইন অমান্য করে শান্তি শৃঙ্খলাভঙ্গ এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
এর আগে দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে সংবাদকর্মীদের মুখোমুখি হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আমরা মনে করি নাশকতা মানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। আপনাদের মাধ্যমে জানাচ্ছি এগুলো থেকে বিরত থাকার জন্য, নতুবা আইন অনুযায়ী আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের যাতে আরো ক্ষতি না হয় সেজন্য সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে।
মন্ত্রী বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সব সময়ই দুই দল, দুই গ্রাম মারপিট করে। আজ নিরীহ মানুষের বাড়িঘর পোড়াচ্ছেন, সরকারি সম্পদ নষ্ট করছেন। আমরা এর পেছনে যে কারণ অনুমান করছি, আগে জঙ্গিরা নাশকতা করার জন্য যে প্রচেষ্টা নিয়েছিল সেই রকমের হতে পারে। জামায়াত-শিবির হতে পারে, বিএনপির লোকজন মদদ দিতে পারে।
তাণ্ডব কী শুধুই হেফাজত করছে, নাকি অন্য কেউ করছে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের যে রণকৌশল, বাঁশেরকেল্লা যুক্ত হয়েছে। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, আগে যে জঙ্গি সংগঠনগুলো সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টি করার জন্য যে প্রয়াস চালিয়েছিল তারাই নতুনভাবে এখানে সম্পৃক্ত হয়েছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। সবগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। যে যেখানে থাকুক, আমরা কাউকে ছাড় দেব না।
জঙ্গি সংগঠন বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন-এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এর আগেও আপনারা দেখেছেন, কিছু জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে মদদদাতা রয়েছে। হরকাতুল জিহাদ বলুন, আনসার উল্লাহ বাংলা টিম বলুন, যেটাই বলুন, সবগুলো মূল নেতৃত্ব এসেছে জামায়াত-শিবির থেকে।
হরতাল তো হেফাজত ডেকেছে-এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, হেফাজত ডেকেছে। এখন হেফাজতের ভেতরে যেগুলো দেখছি, অনেক উসকানি চলে এসেছে। এসবের জন্য আপনারা হেফাজতকে দায়ী করছেন কিনা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা সবাইকেই দায়ী করছি। সবকিছু গুছিয়ে সাক্ষী-প্রমাণ নিয়ে এগুলোর ব্যবস্থা আমরা নেব।