ল্যানসেট অনকোলজির ডিসেম্বর সংস্করণে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুহার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। দেশে এ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ। তথ্যটা আমাদের জন্য শুভ নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ, যা ২০৩৫ সাল নাগাদ দাঁড়াবে ৩২ লাখ ৫০ হাজার ৭২৬ জনে। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যান্সারজনিত মৃত্যু প্রতি বছর দেড় লাখ। প্রতি বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে দুই লাখ মানুষ, যা সামনের দিনগুলোয় আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও জনসংখ্যা অনুপাতে তা অপ্রতুল। নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। ওষুধপত্র বলতে গেলে পুরোটাই কিনতে হয়। এসব ওষুধের জন্য রোগীরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন কারসাজিতে ওষুধ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। প্রয়োজনীয় পুষ্টিবিদ, মনোচিকিৎসকের অভাব রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির সুযোগ থাকলেও রোগের প্রথম দিকের চিকিৎসার ব্যবস্থা শূন্যের কোঠায়। ক্যান্সার চিকিৎসার সুবিধা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে। রোগীদের জন্য আধুনিক স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন ক্যান্সার রোগীদের জাতীয় নিবন্ধনের নিয়ম, যেন এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের তথ্য–উপাত্ত তৈরি করা যেতে পারে, যার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে জাতীয় ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসানীতি প্রণয়ন করা সহজ এবং বাস্তবমুখী হয়। স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যান্সারের মৌলিক প্রতিরোধী কার্যক্রমের অভাব রোগের ব্যাপ্তিকে আরো বিস্তৃত করেছে। রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা ব্যয়বহুল হওয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধের দুষ্প্রাপ্যতা, চিকিৎসার সুযোগ–সুবিধা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়া, চিকিৎসকের স্বল্পতা সব মিলিয়ে ক্যান্সার চিকিৎসা আমাদের দেশে এখনো সাধারণের নাগালের বাইরে। অন্যদিকে এ ব্যাপারে জনসচেতনতার অভাব এ চিত্রকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। ফলে হাজার হাজার রোগী চিকিৎসার জন্য বহির্মুখী হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ব্লাড ক্যান্সারের ব্যাপ্তি ও চিকিৎসার সুযোগ–সুবিধা খুবই সীমিত। ক্যান্সার চিকিৎসাকে সাধারণের নাগালে রাখতে এবং সহজলভ্য করতে দেশে দরকার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা ও মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা।
তাঁরা বলেন, সময় পরিবর্তন হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোগ, রোগের ধরন, চিকিৎসা এবং রোগের গতি–প্রকৃতিও পরিবর্তন হচ্ছে। তদুপরি এর বিপরীতে পৃথিবীর চিকিৎসা বিজ্ঞানও এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও ক্রমশ চিকিৎসা বিজ্ঞান ও চিকিৎসা সেবায় উৎকর্ষতা আসছে। ক্যান্সার একটি বিশেষায়িত রোগ। তাই এ রোগের চিকিৎসায় উৎকর্ষতা আনতে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। গবেষণার মাধ্যমেই বের হয়ে আসবে আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা।
ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয় বিশাল। তার ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত নীতিমালা, দক্ষ জনবল, ওষুধের সহজলভ্যতা, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং উদার বিনিয়োগ। ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব মেডিকেল অনকোলজি এক রিপোর্টে উল্লেখ করে, ক্যান্সারের ওষুধ সহজলভ্য না হলে তা কম কার্যকরী অথচ বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসম্পন্ন চিকিৎসার দিকে রোগীকে ধাবিত করবে। এ জন্য ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও ওষুধের সহজলভ্যতা জরুরি।
ক্লিনিক্যাল অনকোলজিস্ট ডা. আলী আসগর চৌধুরী তাঁর এক লেখায় ক্যানসারের ওষুধ সহজলভ্য করার জন্য কিছু প্রস্তাবনা প্রদান করেছিলেন। যেমন : ক. ক্যান্সারের ওষুধের রেজিস্ট্রেশন ও অনুমোদন সময় কমিয়ে আনা যেতে পারে। খ. উচ্চমূল্যের ওষুধগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আর্থিক অনুদান দেওয়া যেতে পারে। গ. নির্দিষ্ট কিছু ওষুধকে স্বল্পমূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ঘ. সরকার ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। ঙ. মানসম্মত জেনেরিক ও বায়োসিমিলার ওষুধগুলোর সরবরাহ বাড়ানো যেতে পারে। চ. ওষুধ কোম্পানিগুলো রোগী সহায়তামূলক কর্মসূচি নিতে পারে। ছ. এনজিও বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্যানসার রোগীদের সহায়তার কর্মসূচি নিতে পারে। জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন প্রণয়ন, ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, দক্ষ জনবল সৃষ্টি, মৌলিক গবেষণা পরিচালনা এবং যথাযথ চিকিৎসাপদ্ধতি বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জন–এই নীতিমালার আলোকে আমাদের দেশের ক্যান্সার চিকিৎসা এগিয়ে নিতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলেন, ব্লাড ক্যান্সারের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য যদি সেবা বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, তবে রোগীরা উপকৃত হবে। বিশেষ করে, সব সরকারি হাসপাতালে রোগীর আনুপাতিক হারে যদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পদায়ন করা হয়, তবে রোগীরাও আরো উন্নত সেবা পাবেন। একই সাথে উন্নত যন্ত্রপাতি সংযোজন করে সব পরীক্ষা নিরীক্ষার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।