সরকারি স্কুলে ভর্তিতে লটারি: ভালো ফলাফলের চ্যালেঞ্জ আসছে সামনে

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | রবিবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের সরকারি স্কুলগুলোতে আসন সংখ্যা যত আছে, তার তুলনায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমপক্ষে দশগুণ বেশি। ফলে খুদে শিক্ষার্থী সবার পছন্দ মত স্কুলে স্থান সংকুলান না হওয়া স্বাভাবিক। এসব স্থান দখল করার জন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে শুরু হয় একটি অন্যায্য প্রতিযোগিতা, যা সাথে সাথে মাবাবাকেও চিন্তায় ফেলে। স্কুলের স্বাভাবিক পরীক্ষাগুলোর পাশাপাশি, ভর্তি পরীক্ষার জন্য অভিভাবকদের মধ্যে শুরু হয় বছরব্যাপী বাড়তি একটা টেনশন। এই টেনশন নিয়েই অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতেন। ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের অল্প বয়সেই লেখাপড়ার পাশাপাশি ভর্তির জন্য এধরনের চাপের কারণে তাদের উৎসাহ, উদ্দীপনা ও ভিতরকার মানসিক চিন্তাশক্তি হ্রাস পায়। ছোট বাচ্চাগুলোর পড়ালেখার চাপ এত বেশি যে, হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সুন্দর শৈশব। আর তা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিক্ষার্থীদের এই দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে, অনেক অভিভাবক এ ধরনের ভর্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ছিলেন। অতএব সরকারি সিদ্ধান্তে লটারি মাধ্যমে ভর্তির ব্যবস্থাটি অভিভাবকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। বন্ধ হয়ে গেছে কোচিং, ভর্তি বাণিজ্য ও শিশুদের অন্যায্য প্রতিযোগিতার চাপ।

সরকারের সিদ্ধান্তকে অনেক অভিভাবক স্বাগত জানালেও কিছু কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ ও স্কুলের শিক্ষকরা কিন্তু মনে মনে ক্ষুব্ধ। কারণ স্কুলগুলো ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করা সেরা ছাত্রগুলো নিয়ে তাদের দায়িত্বের মূল কাজটা শেষ করত। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের মারফতে যা জানা যায়, তার বাস্তবতা শুনলে গা শিউর উঠে। এ সমস্ত নামকরা সরকারি স্কুলগুলোতে ক্লাস বা লেখাপড়া ঠিকভাবে হয় না। তারপরও ভালো শিক্ষার্থীরা নিজেদের উদ্যোগে বা অভিভাবকদের সহযোগিতায় লেখাপড়া করে ভালো রেজাল্ট করত আর স্কুলগুলো এর সুনামের ফল ভোগ করত।

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের এবারের এসএসসির ফলাফলে দেখা গেছে শহরের স্কুলগুলোর আধিপত্য। প্রথম দশটি স্কুলের মধ্যেই নয়টি স্কুল এই শহরের এবং অনেকগুলো সরকারি স্কুল। চট্টগ্রাম শহরের সরকারি স্কুলগুলো সাধারণত ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করিয়ে থাকে। একচেটিয়ে মেধাবী ছাত্রদের ভর্তির মাধ্যমে, শহরের সরকারি স্কুলগুলো ভালো ফলাফল করে থাকে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরনের কনফিউশন কাজ করে যে, তাঁর ছেলের ভালো ফলাফলের পেছনে স্কুলের কতটা ভূমিকা রয়েছে। ভালো ছাত্ররা সাধারণত ভালো রেজাল্ট করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হল, গত ২০১৮ সাল থেকে সরকারি স্কুলগুলোতে লটারির মাধ্যমে ছাত্র ভর্তি করানো হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় অনেক নামকরা সরকারি স্কুল শতকরা শতভাগ ভালো ছাত্র ভর্তি করাতে পারছে না বলে দাবি করে যাচ্ছে। মূল চ্যালেঞ্জটা এই জায়গাতেই। শতকরা শতভাগ ভালো ছাত্র ভর্তি করাতে না পারলে, শতভাগ ভালো ফলাফল করার একটা চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে। এজন্যই আগামীতে সরকারি ভালো স্কুলগুলো থেকে ভালো ফলাফল করা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

একটা স্কুল বা শিক্ষকের জন্য একজন খারাপ ছাত্রকে ভালো ফলাফল করানোর মধ্যে, যে ধরনের একটা আত্মতৃপ্তি, সন্তুষ্টি ও সার্থকতা থাকে, ভালো ছাত্রকে ভালো ফলাফল করার মধ্যে সেরকম কৃতিত্ব নেই। আমরা দেখি চট্টগ্রাম শহরের ভালো স্কুলগুলো, ভালো ছাত্র ভর্তি করিয়ে বোর্ড পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে সব কৃতিত্ব স্কুলগুলোর নিজেদের বলে দাবি করে। লটারির মাধ্যমে ভালো ছাত্রের পাশাপাশি মাঝারি এবং খারাপ ছাত্রও ভর্তি হয়। লটারির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া এ ধরনের খারাপ ছাত্রকে স্কুলগুলো যদি ভালো ফলাফল করাতে পারে তবে বোঝা যাবে তাদের শিক্ষা পদ্ধতি এবং নিয়মকানুনগুলো যথাযথ। আর যদি না পারে, তবে সে ক্ষেত্রে স্কুলগুলোর নিজেদের ভালো স্কুল দাবি করা একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের সামনে পড়বে। আমরা চাই না সে ধরনের একটা পরিস্থিতির সামনে পড়ুক চট্টগ্রামের স্বনামধন্য স্কুলগুলো। অনেক অভিভাবকের মনে প্রশ্ন জাগে স্কুলে কি আদৌ কোনও লেখাপড়া হয়? অনেকেরই ধারণা ছাত্র এবং অভিভাবকদের নিজেদের প্রচেষ্টাতেই, প্রাইভেট অথবা কোচিং এর সহযোগিতায় ভালো ফলাফল করে আসছে যা স্কুলগুলো নিজেদের সাফল্য বলে প্রচার করছে। এবার এসএসসি পরীক্ষায় যে শিক্ষার্থী ১২৭৪ পেয়ে প্রথম হল, তাকে নিয়ে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা ফেসবুকে তাদের কোচিংয়ের পেজ থেকে শিক্ষকরা নিজেদের সাফল্য বলে দাবি করছে। যতদূর জেনেছি ছেলেটি চট্টগ্রামের একটি স্বনামধন্য স্কুলের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ছেলের সাফল্যেটা পুরোটাই কোচিং সেন্টারের কৃতিত্ব বলে দাবি করা হচ্ছে। স্কুলের কোনও কৃতিত্বই কি নেই? ব্যাপারটি আমাদের সমাজে একটা ভুল বার্তা দেয়। আর তা হল স্কুলগুলোতে লেখাপড়া হয় না, যা স্কুলগুলোকে গুরুত্বহীন করে ফেলছে।

গত কয়েকদিন আগে থেকে সামনের শিক্ষাবর্ষের জন্য স্কুলগুলোতে সরকারিভাবে লটারির মাধ্যমে ভর্তির আয়োজন শুরু হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ভর্তি বাণিজ্য এবং কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতেই লটারিতে শিক্ষার্থী ভর্তির এ আয়োজন। নীতি নির্ধারকদের মতে এত ছোট বাচ্চাদের মেধা যাচাইয়ের কিছু নেই। সব স্কুলকেই সব শিক্ষার্থী নিতে হবে। পৃথিবীর কোথাও শিশু ও কিশোর বয়সী বাচ্চাদের মেধা যাচাইয়ে কোনো পরীক্ষা নেয়া হয় না। একটি স্কুল এত ছোট বাচ্চার মেধা যাচাই করে কিভাবে! যদি মেধা যাছাই করে ভর্তি করাতে হয় তাহলে স্কুলের কাজ কী? যদি শুধু ভালোটা নিয়েই তারা থাকতে চায়, তাহলে তারা আর শিখালো কি? তাদের দায়িত্ব কী? সরকারের চিন্তাধারায় আরেকটি ব্যাপার উঠে এসেছে সেটা হল ক্যাচমেন্ট এরিয়া। যে শিক্ষার্থী যে এলাকায় থাকে সে যেন ওই এলাকার স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায় সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। একজন শিক্ষার্থীর ক্যাচমেন্ট এরিয়া নিশ্চিত করা গেলে তা শুধু লেখাপড়াতেই নয়, নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অভিভাবকদের সময় ও অর্থনষ্টসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। স্কুলে আসতে যেতেই যদি দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়ে যায় তাহলে শিক্ষার্থীর পড়ালেখার সময় নষ্ট হবে। এজন্য লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থী যাতে তার বাড়ি হতে নিকটতম স্কুলেই পড়তে পারে। তবে এব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষের একটি ভিন্ন অবজারভেশনও আছে। তাদের বক্তব্য হলো, লটারীর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর যথাযথ মান যাচাই হয় না বলে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ছাত্র যদি একই ক্লাসে আসে সেক্ষেত্রে সঠিক মান বজায় রাখা কঠিন। ঠিক এ জায়গায় সরকারের বক্তব্য হলো, নতুন নীতিমালার লক্ষ্য হলো স্কুলের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে গড়ে তোলা। তথাকথিত মেধাবী তকমা দিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির আড়ালে যে ভর্তি বাণিজ্য এবং কোচিং বাণিজ্য চলতো তা চিরতরে বন্ধ করে দিতেই বর্তমান সরকার নতুন নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক অভিভাবকের মন্তব্য দেখলাম এ রকমভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করা ভালো ছাত্ররা তো ভালো রেজাল্ট করবেই, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। লটারীর মাধ্যমে ভালোখারাপের মিশেলে শিক্ষার্থী নিয়ে শতভাগ পাশ করাতে পারলেই আসল সফলতা।

শুধুমাত্র লটারি করেই সরকার দায় সারলে হবে না, সব স্কুলে সমান সুযোগ নিশ্চিত করাটা জরুরি। প্রাইমারি ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, মানসম্মত এবং বিষয়ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আজকাল অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের দিতে চান না। এটির মান উন্নয়নের দিকে সরকারের নজর দিতে হবে, যাতে অভিভাবকদের আস্তা অর্জিত হয়। অনেক সময় আমরা দেখতে পাই, একজন অভিভাবক অনেক কষ্ট করে বেশি বেতনের ভালো স্কুলের বাচ্চাকে ভর্তি করায় শুধুমাত্র স্কুলের সার্বিক পরিবেশের কারণে। এটা অর্জিত হয় স্কুল কমিটি ও শিক্ষকদের সহযোগিতায়। সবার ধারণা সরকারি স্কুলের পরিবেশ কিন্তু বেসরকারির তুলনায় খুব একটা ভালো নয়। এ মনোভাব পরিবর্তনে সরকারের যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বোপরি লটারীতে স্বচ্ছতা আনতে হবে, যাতে এ প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন তুলতে না পারে। নতুন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে শুরুতে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও, সকলের প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে