লোহাগাড়া উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের তৃতীয় তলায় মহিলাদের নামাজ কক্ষ দখল করে চালু করা হয়েছে প্রাইভেট হেফজখানা। এতে মহিলারা বঞ্চিত হচ্ছেন মসজিদে নামাজ আদায়ের সুযোগ থেকে। এছাড়া মসজিদের বর্তমান ইমাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে অন্যত্র কর্মরত। ফলে তিনি মডেল মসজিদের ইমাম পদে যোগদান করতে পারছেন না। আবার প্রভাব খাটিয়ে ইমাম পদে অন্য কাউকে যোগদানও করতে দিচ্ছেন না। যার ফলে দীর্ঘদিন যাবত ঝুলে আছে মডেল মসজিদে ইমাম পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া।
জানা যায়, ২০২১ সালের ২৩ মে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতে সরকারি অর্থায়নে নির্মিত উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে তিন পদে জনবল নিয়োগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়। একই মাসের ৩১ মে মসজিদে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিম পদে উপজেলা প্রশাসনের সম্মেলনে কক্ষে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২৮ জন ইমাম, ২০ জন মুয়াজ্জিন ও ৬ জন খাদিম পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পরীক্ষায় ইমাম পদে মো. আবদুল গফুর প্রথম, মোহাম্মদ শহীদুল হক দ্বিতীয় ও মো. সেলিম উদ্দিন তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। এরমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী সরকারি এবং এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। একই সালের ১০ জুন লোহাগাড়া উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নামাজ আদায় করা শুরু হয়। এরপর থেকে ইমাম নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী মো. আবদুল গফুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে বহাল তবিয়তে থেকে মডেল মসজিদে নিয়োগ বিহীন ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এদিকে প্রভাব খাটিয়ে ইমামের পদও ছাড়ছেন না তিনি। আবার যোগদানও করছেন না। বিভিন্ন কূটকৌশলে প্রভাব খাটিয়ে মেধাক্রমে অন্য প্রার্থীদেরও ইমাম পদে যোগদান বানচাল করে দিচ্ছেন নিয়োগ বিহীন বর্তমান ইমাম। এছাড়া পরীক্ষার পর ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর মুয়াজ্জিন পদে ১ জন ও খাদিম পদে ২ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তারা নিয়মিত বেতনভাতা পাচ্ছেন। নিয়োগপত্রে উল্লেখ রয়েছে পাশাপাশি সরকারি অনুদানপুষ্ট অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন না।
অপরদিকে, চলতি সনের ২০ এপ্রিল থেকে তৎকালীন সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভীর নির্দেশে মৌখিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ইমাম মাওলানা আবদুল গফুর দীর্ঘদিন যাবত মসজিদের তৃতীয় তলা দখল করে সেখানে প্রাইভেট হেফজখানা পরিচালনা করছেন। এতে মডেল মসজিদের মহিলা নামাজ আদায়ের কক্ষসহ পুরো তৃতীয় তলা তার দখলে চলে যায়। ব্যক্তিগত হেফজখানা পরিচালনার জন্য মডেল মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে মৌখিকভাবে অনুমতি দেন। তবে উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে পরিচালিত হলেও ব্যক্তিগত হেফজখানা পরিচালনার জন্য ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ কারো কাছ থেকে অনুমতি নেয়া হয়নি। গত ২৭ জুন লিখিত অনুমতি ছাড়া মডেল মসজিদে ব্যক্তিগত হেফজখানা চালুর বিষয়টি অবহিত করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক বরাবর লিখিতভাবে জানিয়েছেন ফাউন্ডেশনের লোহাগাড়া উপজেলার ফিল্ড সুপারভাইজার মু. আবু বকর রফিক।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, তৎকালীন লোহাগাড়া উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদের পাশে কয়েকটি দোকানঘরের ভাড়া নিয়ে মসজিদের ব্যয়ভার পরিচালনা হতো। বর্তমানে ওই স্থানে উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। মসজিদের ব্যয়ভার পরিচালনার জন্য বর্তমানে সেখানে ১১টি দোকানঘর রয়েছে। পূর্বে প্রতি বর্গফুট ৮ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হলেও চলতি মাস থেকে প্রতি বর্গফুট ১০ টাকা করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি মাসে ৭টি দোকান থেকে নতুনভাবে ১ লাখ টাকা করে অগ্রিম নেয়া হয়েছে। এসব দোকানের ভাড়া মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন রশিদের মাধ্যমে উত্তোলন করেন। বর্তমানে মসজিদে মোটা অংকের বিদ্যুৎ বিল অপরিশোধিত রয়েছে। মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অধীনে আয়–ব্যয়ের হিসাব উপজেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও তাদেরকে কেউ কোন হিসাব দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। ফলে মসজিদের আয়–ব্যয়ের সঠিক হিসাব কারো কাছে পাওয়া যাচ্ছে না।
বুধবার (২৮ আগস্ট) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নিচ তলায় ডাইনিং রুমে এক বাবুর্চি হেফজখানার শিক্ষার্থীর জন্য রান্নাবান্না করছেন। সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠে দেখা যায়, কিছু শিক্ষার্থী ফ্লোর ঝাড়ু দিচ্ছে, আবার কিছু শিক্ষার্থী কোরআন তেলাওয়াত করছে। তৃতীয় তলায় মসজিদের অংশে মাঝখানে দেয়াল দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে এক পাশে মহিলাদের নামাজ আদায়ের কক্ষ, অন্যপাশে দ্বিতীয় তলায় জায়গা সংকুলান না হলে পুরুষদের নামাজ আদায়ের কক্ষ। মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল গফুর তৃতীয় তলার পুরোটায় দখলে নিয়েছেন। মহিলা নামাজ আদায় কক্ষে শিক্ষার্থীরা কোরআন তেলাওয়াত করে, আর অন্যপাশে তাদের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে ৬০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়া শিক্ষক রয়েছেন ৩ জন। অতিরিক্ত গরম পড়লে এসি ছেড়ে দিয়ে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় এসে শিক্ষার্থীরা হেফজখানার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় বলে জানা গেছে। এছাড়া মডেল মসজিদ মহাসড়ক সংলগ্ন হওয়ায় প্রতি শুক্রবার বহু গাড়ির যাত্রীরা জুমার নামাজ আদায় করতে সেখানে থামেন। মাঝে মধ্যে বেশি গাড়ি থাকলে যাত্রীরা মসজিদের ভেতর জায়গা না পেয়ে বাহিরে খোলা আকাশের নিচে জুমার নামাজ আদায় করতে হয়।
লোহাগাড়া মডেল মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল গফুর জানান, নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করলেও কর্তৃপক্ষ তাকে যোগদানপত্র দেননি। তাই তিনি বিধিমোতাবেক মডেল মসজিদের ইমাম পদে যোগদান করতে পারছেন না। তাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে চাকরিতে বহাল থেকে বিনা বেতনে মসজিদের ইমাম ও খতিব পদে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মসজিদের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে কর্তৃপক্ষ একটি মিটিংয়ের আয়োজন করে নাই। তাই মসজিদের আয়–ব্যয়ের হিসাব বুঝিয়ে দিতে পারি নাই। প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দেয়া শর্তে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতির কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে তৃতীয় তলায় হেফজখানার কার্যক্রম শুরু করেছেন। কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে মসজিদে অপরিশোধিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করার জন্য ৭টি দোকানঘর থেকে অগ্রিম টাকা নেয়া হয়েছে।
ইমাম নিয়োগ পরীক্ষায় মেধাক্রমে উত্তীর্ণ মাওলানা মুফতি সেলিম উদ্দিন জানান, লোহাগাড়া উপজেলা মডেল মসজিদের ইমাম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণিত সকল নিয়ম–কানুন মেনে ইমাম পদে উত্তীর্ণ হই। তৎকালীন উপজেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সুপারভাইজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাত দিয়ে নিয়োগের ব্যাপারে ফোন করেছিলেন। এছাড়া চূড়ান্তভাবে একটি নির্দিষ্ট তারিখে চাকরিতে যোগদান করার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন এমপি আবু রেজা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভীর মৌখিক চাপে তাকে বাদ দিয়ে বর্তমান ইমামকে নিয়োগপত্র বিহীন অবৈধভাবে ইমাম ও খতিবের স্থানে বহাল রাখেন। এই ব্যাপারে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ন্যায্য অধিকার দাবি করছেন।
লোহাগাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফিল্ড সুপারভাইজার মু. আবু বকর রফিক জানান, উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দেখভাল করার দায়িত্ব ইসলামিক ফাউন্ডেশনের। ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে মসজিদের তৃতীয় তলা দখল করে ব্যক্তিগত হেফজখানা চালু করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আসবাবপত্র ব্যবহার করায় অল্পসময়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হেফজখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ। এছাড়া মডেল মসজিদের কার্যক্রম শুরু হবার পর একাধিকবার মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু মসজিদের ইমাম আয়–ব্যয়ের হিসাব ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। অপরদিকে, নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হবার পর মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল গফুরকে বিধিমোতাবেক তার কাছে যোগদানপত্র প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য ছক পূরণ পূর্বক স্বাক্ষর করে জমাও দিয়েছেন। কিন্তু নিয়োগপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে মডেল মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি সরকারি অনুদানপুষ্ট অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা যাবে না। তাই তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে ইমাম ও খতিব পদে যোগদান করছেন না। এছাড়া প্রভাব কাটিয়ে বিভিন্নভাবে তদবির করে মডেল মসজিদের ইমাম পদে নিয়োগ পরীক্ষায় মেধাক্রমে উত্তীর্ণ অন্য কাউকে যোগদানও করতে দিচ্ছেন না। তাই ইমাম নিয়োগ প্রক্রিয়া ঝুলে রয়েছে।
লোহাগাড়া মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ ইনামুল হাছান জানান, প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা করে বিদ্যুৎ বিল বাবদ দেয়ার জন্য মসজিদের ইমামকে তৃতীয় তলায় হেফজখানা পরিচালনার জন্য মৌখিকভাবে অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে এটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হলে মডেল মসজিদ থেকে হেফজখানা অন্যত্র সরিয়ে নিতে বলা হবে। এছাড়া ইমাম নিয়োগ প্রক্রিয়া ঝুলে থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান তিনি।