ভর মৌসুমে দেশে ইউরিয়া সারের সংকট ঘুচাতে সরকার চড়া দামে কাফকো থেকে দুই লাখ টন সার কিনলেও তা পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে লাইটারেজ জাহাজে সার পরিবহন একেবারে শূন্যের কোটায় নেমে গেছে। এই অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে ট্রাকযোগে সার পরিবহনের ব্যবস্থা করা হলেও সংঘবদ্ধ একটি চক্রের কারসাজিতে সার পরিবহন অর্ধেকে নেমে আসার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি খাতে ইউরিয়া সারের ভর মৌসুম চলছে। ২৫টি বাফার গুদামে সারের সংকট বিরাজ করছে। প্রয়োজনীয় সারের অভাবে বিভিন্ন স্থানে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি হচ্ছে। ইউরিয়া সারের অভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের কৃষি খাতের কথা বিবেচনা করে সরকার আন্তর্জাতিক বাজারদরে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) থেকে ছয় লাখ টন ইউরিয়া কেনার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কাফকোর উৎপাদনে কিছুটা সমস্যা হওয়ায় কাফকো কর্তৃপক্ষ সাড়ে পাঁচ লাখ টন ইউরিয়া সার বিক্রি করে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন বা বিসিআইসির সাথে চুক্তি করে। এসব সার সড়ক ও নদীপথে ২৫টি বাফার গুদামে পরিবহনের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে লাইটারেজ জাহাজে নদীপথে ২ লাখ টন সার পরিবহনের কথা। বাকি সাড়ে তিন লাখ টন সারের মধ্যে এক লাখ টন বিআরটিসির সরকারি ট্রাকে পরিবহনের দায়িত্ব দেয়া হয়। বাকি আড়াই লাখ টন সার সড়কপথে পরিবহনের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। টেন্ডারে দুই লাখ টনের জন্য মেসার্স পোটন ট্রেডার্স, দেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন, গ্রাম সিকো লিমিটেড, ফয়সল অ্যান্ড কোম্পানি সামিট এসোসিয়েশন (জেবি), মেসার্স রুহুল আমীন ভুঁইয়া, ওয়েস্টিন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, এমএইচআর কর্পোরেশনকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। বাকি ৫০ হাজার টন সার পরিবহনের টেন্ডার পায় নবাব অ্যান্ড কোম্পানি। কিন্তু নবাব অ্যান্ড কোম্পানি ইতোপূর্বে সার গায়েব করে দেয়ার অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ায় তাদের পরিবর্তে ‘দ্বিতীয় স্থান পাওয়া’ কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কাফকো থেকে আন্তর্জাতিক বাজারদরে চড়া দামে কেনা ইউরিয়া যথাসময়ে ২৫টি বাফার গুদামে পৌঁছানোর সরকারের চেষ্টা থাকলেও সংঘবদ্ধ একটি চক্র সব আয়োজন ভণ্ডুল করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বিশেষ করে লাইটারেজ জাহাজে দুই লাখ টন সার পরিবহন করার কথা থাকলেও ইতোমধ্যে মাত্র ৫ হাজার টন সার জাহাজে বোঝাই করা হয়েছে, যা গতকাল পর্যন্ত কোনো বাফার গুদামে পৌঁছেনি। অপরদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসির ৫শ ট্রাক নিয়মিত সার পরিবহন করলেও পদে পদে ব্যাহত হচ্ছে বেসরকারি ট্রাকে সার পরিবহন।
সূত্র বলেছে, কাফকোর গুদাম থেকে ট্রাকে সার বোঝাই করার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় কাফকোর হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রায় বারো বছর ধরে হ্যান্ডলিং ঠিকাদার হিসেবে কাজ করা মেসার্স আর এ এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠানটির মর্জির ওপর ট্রাকে সার বোঝাইয়ের কাজ নির্ভর করে। বিআরটিসির ট্রাকগুলোর প্রতিটিতে ১৫ টন বা ৩০০ বস্তা ইউরিয়া বোঝাই করা হলেও একই সাইজের প্রাইভেট ট্রাকগুলোতে ৮ টনের বেশি সার দেয়া হচ্ছে না। প্রতিদিন বিআরটিসি ৭০ থেকে ৮০ ট্রাক সার নিয়ে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বাফার গুদামে গেলেও বেসরকারি মাত্র ২০/৩০ ট্রাক সার পরিবহন করতে পারছে। সরকারি ট্রাকের অর্ধেক সার নিয়ে বেসরকারি ট্রাকগুলো কাফকোর গুদাম ছাড়ছে। যা ভর মৌসুমে সার পরিবহনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
অভিযোগ, সার পরিবহনকে পুঁজি করে সংঘবদ্ধ একটি চক্র কয়েক কোটি টাকার চাঁদাবাজির মিশন নিয়ে নেমেছে। এদের অপতৎপরতায় কৃষি সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। বেসরকারি ট্রাকগুলোতেও সরকারি ট্রাকের সমান হারে সার বোঝাই করা না হলে সার পরিবহনে দ্বিগুণ সময় লাগবে। যা বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে।
কাফকোর জেনারেল ম্যানেজার (প্রোডাকশন) ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবু দাউদ সরকারি ও বেসরকারি ট্রাকে সার পরিবহনের বৈষম্যের কথা স্বীকার করে বলেন, বিআরটিসির ট্রাকে ১৫ টন এবং বেসরকারি ট্রাক ৮ টন সার বোঝাই করা হয়। কিন্তু বেসরকারি ট্রাকগুলো গেটের বাইরে গিয়ে নিজেরা ম্যানেজ করে ১৪/১৫ টন সার নিয়ে বাফার গুদামে যায়। গেটের বাইরে গিয়ে তারা নিজেরা আবার সার রিলোড করে।
বিষয়টি অস্বীকার করে বেসরকারি একজন পরিবহন ঠিকাদার বলেন, কাফকোর বাইরে গিয়ে সার রিলোড করার সুযোগ নেই। তাছাড়া কেউ যদি তা করেও থাকে তাহলে তার বেশি অর্থ খরচ হবে। যা স্বাভাবিক নয়।
কাফকোর হ্যান্ডলিং ঠিকাদার আর এ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, এটি পুরোপুরি শ্রমিকদের ব্যাপার। তারা সরকারি ট্রাকে ১৫ টন লোড করে আর বেসরকারি ট্রাকে ৮ টন লোড করে। সরকারি ট্রাকে বাড়তি লোড করার জন্য বিসিআইসি, কাফকো, সিইউএফএল এবং পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। টন প্রতি ৭০ টাকা করে প্রদান করে সরকারি ট্রাকে ১৫ টন সার বোঝাই করা হয়। বেসরকারি ট্রাকগুলোও টনপ্রতি ৭০ টাকা করে দিয়ে বাড়তি সার লোড করাতে পারে। তারা তা না করলে আমাদের কি করার আছে?
আর এ এন্টারপ্রাইজের সাথে কাফকোর সার হ্যান্ডলিংয়ের যে চুক্তি রয়েছে তা টন হিসেবে। প্রতি টনের জন্য ৪৮ টাকা ৫০ পয়সা। হ্যান্ডলিং ঠিকাদার ১৫ টন লোড দিয়ে ১৫ টনেরই বিল করছে। আবার বাড়তি টনপ্রতি ৭০ টাকা করে আদায় করছে। এই বাড়তি টাকা আদায় করতে না পারায় বেসরকারি ট্রাকে ৮ টনের বেশি লোড দিচ্ছে না। বিষয়টি চাঁদাবাজি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা
কাফকো থেকে সার পরিবহনের ব্যাপারটি বিসিআইসির পক্ষ থেকে মনিটরিং করছেন সিইউএফএলের জিএম (মার্কেটিং) মোহাম্মদ হামিম। তিনি বলেন, বিষয়টি পুরোপুরি কাফকো দেখছে। আমাদের কিছু বলার নেই। তবে আমরা ১৫ টন সার বোঝাই করার জন্য বারবার অনুরোধ করেছি। বেসরকারি ট্রাকেও সরকারি ট্রাকের মতো ১৫ টন সার বোঝাই করা হলে কৃষি খাত উপকৃত হবে।