সরকারি টাকায় কেনা লিফট ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে!

এসএওসিএলের আমদানি করা ২৮ লাখ টাকার দুটি লিফট ব্যবহৃত হচ্ছে বেসরকারি টেকনিক্যাল কলেজে

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৯ জুলাই, ২০২১ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) অংশীদারি প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) কেনা দুটি লিফট দুই বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে নাসিরাবাদের একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন টেকনিক্যাল কলেজে। এতে প্রায় ২৮ লাখ টাকা লোপাট হয়েছে বলে দৈনিক আজাদীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ের অডিট অধিদপ্তর খোয়া যাওয়া লিফট দুটি নিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আপত্তিও দিয়েছে বলে জানা গেছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অডিট অধিদপ্তরের অডিট আপত্তি সূত্রে জানা গেছে, এসএওসিএল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে ৪১ লক্ষ ৭২ হাজার ৪শ টাকা মূল্যে আমদানি করা ৩টি লিফটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এসএওসিএলের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসার পর বিষয়টি খোঁজ নিতে গিয়ে একটি লিফট প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে স্থাপন করা হয় বলে জানা গেছে। অন্য দুটি লিফটের বিষয়ে জানতে বন্দর থেকে খালাসকারী সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান হট-লাইন কার্গো ইন্টারন্যাশনাল ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি এজেন্ট ও-২ এলিভেটরস কো. লিমিটেডকে গত ৮ জুন চিঠি দেয় এসএওসিএলের বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত তদারককারী কর্মকর্তা বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোরশেদ হোসাইন আজাদ। এরপর সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠানটি থেকে কোন সাড়া না পেলেও চিঠির জবাব দিয়েছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। গত ১২ জুন প্রতিষ্ঠানটির কমার্শিয়াল এঙিকিউটিভ খালেদা আকতার স্বাক্ষরিত পত্রে জানানো হয়েছে, খুলশী থানাধীন নাসিরাবাদ এয়াকুব ফিউচার পার্কের দুই নং গেটের ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজে লিফট দুটি স্থাপন করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬৩০ কেজি ভারবহন ক্ষমতার একটি ও ১ হাজার কেজি ভারবহন ক্ষমতার দুটিসহ মোট তিনটি লিফট আমদানির জন্য গত ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর যমুনা ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় ঋণপত্র (নং-৩০৩৮১৮০১০৩০৭) খোলে এসএওসিএল। তন্মধ্যে এক হাজার কেজির দুটি লিফট স্থাপন করা হয়েছে ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজে। লিফট দুটির এলসি মূল্য ৩৩৪০০ মার্কিন ডলার। ওই সময়ে প্রতি ডলার ৮৩ টাকা ৯৫ পয়সা হিসেবে লিফট দুটির মূল্য ২৮ লক্ষ টাকার কিছু বেশি। যা লোপাট হয়েছে বলে অডিটরদের ধারণার সত্যতা মিলেছে।
গতকাল রোববার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজের প্রবেশমুখে সিড়ির পাশে একটি এবং বারান্দার শেষপ্রান্তে একটি লিফট সংযোজন করা হয়। লিফটের নিচতলায় সবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ছাপানো নির্দেশনা লাগানো রয়েছে। এসময় প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ অফিসে ছিলেন না। পরে সন্ধ্যায় ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজের অধ্যক্ষ ও চিটাগাং ন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ইঞ্জি. এবিএম আবদুল ওয়াহেদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘এসএওসিএল নয়, লিফট দুটি আমাদের ডেভেলপার দিয়েছেন’।
তবে লিফট দুটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও-২ এলিভেটরস কো. লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সায়েম উদ্দিন গতকাল সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘লিফট তিনটির আমদানিকারক ছিল এসএওসিএল। একটি লিফট প্রতিষ্ঠানটির হেড অফিসে, অন্য দুটি এসএওসিএলের নির্দেশনা মোতাবেক ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজে স্থাপন করা হয়েছে। সাহেদ সাহেব এসএওসিএলের দায়িত্বে ছিলেন, ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজের দায়িত্বে ছিলেন ওনারই ভাই ওয়াহেদ সাহেব। ওয়াহেদ সাহেবই লিফট দুটি গ্রহণ করেছেন।’ প্রতিষ্ঠানটি তাদের ওয়েব সাইটেও সেবাগ্রহীতাদের ছবির তালিকায় ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজের একটি ছবিও আপলোড দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিফট তিনটি আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খোলা থেকে শুরু করে স্থাপন পর্যন্ত সবকিছুই তদারক করেছিলেন এসএওসিএলের ডিপার্টমেন্ট প্রধান উপ-ব্যবস্থাপক (প্রকৌশল ও পরিচালন) মো. মোকাররম হোসেন। আমদানিকৃত লিফট তিনটি পারিবারিক লোকজন দিয়ে বন্দর থেকে খালাসের ব্যবস্থাও করেন মোকাররম। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে লিফট দুটির বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেন তিনি।
জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি দুদক হটলাইনে আসা এক অভিযোগের সূত্র ধরে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় ৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় অভিযান চালিয়ে এসএওসিএলের পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদ ও তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদের বিরুদ্ধে ৫৭ কোটি টাকা অবৈধভাবে স্থানান্তরের প্রমাণ পায় দুদক। এরপর নড়েচড়ে বসে বিপিসি। এরপর ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এসএওসিএলের ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়-ব্যয় ও অডিটসহ সার্বিক আর্থিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিপিসি। বিপিসির তদন্ত কমিটি ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের নমুনা ভিত্তিক কিছু আর্থিক কার্যক্রমের অনুসন্ধান করে প্রায় তিনশ’ কোটি টাকার অনিয়মের সত্যতা পায়। এরপর বিপিসি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠায়। বিপিসির তদন্ত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে চলতি বছরের ৯ মার্চ প্রায় ৮১ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মঈন উদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এর আগে গত বছরের ১৮ আগস্ট করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. শাহেদকে আসামি করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে সাবেক মহাব্যবস্থাপক মো. শাহেদ মারা যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির পূর্ণ কর্তৃত্ব নেয় বিপিসি। এরপর বেরিয়ে আসতে থাকে ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এসএওসিএলে ঘটে যাওয়া নানা অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র। মূলত ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজের মালিক ও অধ্যক্ষ ছিলেন প্রয়াত মহাব্যবস্থাপক শাহেদের বাবা ইঞ্জিনিয়ার বাকী। ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজটি পশ্চিম খুলশী থাকলেও ২০১৭ সালে নিজেদের মালিকাধীন ৯ তলা ভবনে চলে আসে। ওই নতুন ভবনেই লাগানো হয় লিফট দুটি। পরবর্তীতে শাহেদ মারা যাওয়ার ১৫ দিনের মাথায় তার বাবাও মারা যান। এরপর প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হন শাহেদের আরেক ভাই ইঞ্জিনিয়ার এবিএম আবদুল ওয়াহেদ। তিনি ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বও নেন। ওই ভবনে তাদের মালিকানাধীন চিটাগাং ন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামের আলাদা আরেকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে চারটি বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয়।
এসএওসিএল’র দায়িত্বপ্রাপ্ত তদারককারী কর্মকর্তা বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোরশেদ হোসাইন আজাদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার পর অডিট আপত্তি দেখে লিফট তিনটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছি। তারা লিফট দুটি ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজ ভবনে স্থাপন করেছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। এগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এ সম্পদ উদ্ধারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরো ৯৪৫ জন শনাক্ত, মৃত্যু ১১
পরবর্তী নিবন্ধখাতুনগঞ্জে ৮ জনের সাড়ে ৪ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবসায়ী আত্মগোপনে