দেশে লবণের চাহিদা পূরণ করতে উৎপাদনের প্রধান জোন হিসেবে কক্সবাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। দেশের মোট লবণ চাহিদার ৭৫ শতাংশেরও বেশি উৎপাদন হয় এই জেলায়। বঙ্গোপসাগরের নোনা পানি, সূর্যের তাপ আর প্রাকৃতিক বাতাসের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যের অন্যতম এই লবণ শিল্প। যুগের পর যুগ ধরে এটি শুধু একটি কৃষি কার্যক্রম নয়, বরং উপকূলীয় অঞ্চলের হাজারো পরিবারের জীবিকার প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছে এ পেশা। অথচ হাজার কোটি টাকার এই খাত বর্তমানে নানা সংকট, অনিশ্চয়তা ও সীমাবদ্ধতায় জর্জরিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, বাজার ব্যবস্থাপনার অস্থিরতা, ন্যায্য দাম না পাওয়া এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কারণে লবণচাষিরা প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সুদীর্ঘ কালের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তারা আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা বা বাজার নিয়ন্ত্রণের অভাবে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়ছেন। তবুও তারা আশার আলো হারিয়ে ফেলেননি। প্রতিদিনের পরিশ্রম, ঘাম ও সময় দিয়ে এই ঐতিহ্যবাহী খাতকে টিকিয়ে রাখছেন ভবিষ্যতের স্বপ্নে ভর করে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে চলতি বছর মোট লবণের চাহিদা ছিল ২৬ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ উপকূলে উৎপাদিত হয়েছে ১৯ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন লবণ, যা দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ ঘাটতি পূরণ করেছে। এই বিপুল উৎপাদনের মাধ্যমে শুধু দেশের ভেতরের প্রয়োজনই মেটে না, শিল্পকারখানার বিভিন্ন খাতেও যোগান দেওয়া হয় কক্সবাজারের লবণ। তবুও উৎপাদনের অনিশ্চয়তা, বাজারজাতের জটিলতা ও আমদানি নির্ভর নীতির কারণে চাষিরা বারবার ক্ষতির মুখে পড়েন।
বর্ষার সময় বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে হঠাৎ করেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে পুরো মৌসুমের বিনিয়োগ হারিয়ে যায়। বাজার ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতার অভাবে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাবের কারণে চাষিরা ন্যায্য মূল্য না পেয়ে হতাশ হন। ফলে একদিকে যেখানে দেশের বিশাল চাহিদা পূরণে তারা মূল ভূমিকা রাখছেন, অন্যদিকে ন্যায্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে রয়ে যাচ্ছেন বঞ্চিত ও অবহেলিত।
লবণ চাষ সাধারণত প্রতি বছর অক্টোবর থেকে নভেম্বরের শেষ দিকে শুরু হয়ে মে মাস পর্যন্ত চলে। বর্ষা শেষে জমি প্রস্তুতের মাধ্যমে শুরু হয় এই প্রক্রিয়া। প্রথমে জমি সমতল করে চারপাশে শক্ত বাঁধ তৈরি করা হয় যাতে সমুদ্রের পানি ঠিকভাবে আটকে রাখা যায়। এরপর জমিতে নালা ও ছোট ছোট প্লট বানিয়ে তাতে সমুদ্রের নোনা পানি তোলা হয়। প্রচণ্ড রোদে ধীরে ধীরে এই পানি শুকিয়ে সাদা লবণ তৈরি হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি নির্ভর করে শ্রম, সময় ও দক্ষতার পাশাপাশি আবহাওয়ার অনুকূলতার ওপর। একদা লবণ উৎপাদন সনাতনী পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল থাকলেও কালের বিবর্তনে বর্তমানে এই খাতে এসেছে আধুনিকায়ন। এতে উৎপাদন বেড়েছে, সময় কমেছে, গুণগত মান উন্নত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির সুযোগও তৈরি হয়েছে। তবে পদ্ধতির উন্নয়ন হলেও চাষিদের মৌলিক সমস্যা এখনো থেকে গেছে আগের মতোই।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় পলিথিন পদ্ধতিতে লবণের চাষ করা হচ্ছে, যা পুরোনো সনাতনী পদ্ধতির তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর। এই পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হয় ৫২ শতাংশেরও বেশি, পাশাপাশি মানও থাকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। ফলে দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে। সনাতনী পদ্ধতিতে যেখানে প্রতি একরে গড়ে ১৭ দশমিক ২৫ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হতো, সেখানে এখন পলিথিন পদ্ধতিতে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ মেট্রিক টনে, যা পূর্বের তুলনায় ৫২ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি। যেহেতু লবণ চাষ মৌসুম ভিত্তিক, তাই বছরে ছয় মাস লবণ উৎপাদনের পর বাকি সময় একই জমিতে অনেক চাষি লোনা পানির চিংড়ি চাষ বা অন্যান্য মাছ চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। এতে জমির বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত হয়, যদিও ঝুঁকিও থেকে যায় সমানতালে।
মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের কালালিয়া কাটার লবণচাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল কবির মেম্বার বলেন , এক একর জমিতে মৌসুমে গড়ে প্রায় ২৬ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়। উৎপাদন ব্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় জমির অগ্রিম মূল্য, জমি প্রস্তুত করা, পলিথিন ক্রয়, বাঁধ নির্মাণ, পানি তোলা এবং শ্রমিকদের মজুরি প্রদানে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ভালো লাভ হয়, কিন্তু আকস্মিক বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় বা মৌসুমের আগাম বর্ষা আসলে পুরো ফসল নষ্ট হয়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে চাষিদের ঋত পরিশোধ ক্ষমতার ওপর। লবণ মৌসুমে চাষিরা প্রায় ৬ থেকে ৭ মাস মাঠে নিরলস পরিশ্রম করেন। বছরের বাকি সময়ে কেউ কৃষিকাজ করেন, কেউ মাছ ধরা, ক্ষুদ্র ব্যবসা বা দিনমজুরির কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। মৌসুমে সামান্য লাভ হলেও তা দিয়ে পুরো বছর চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। অনেকের ঘরবাড়ি বাঁশ ও টিন দিয়ে তৈরি, মৌসুমের আয় দিয়েই সংসারের সমস্ত ব্যয় মেটাতে হয়। লবণ মৎস্য ও কৃষি কল্যাণ সমিতি রাজাখালী (পেকুয়া) ইউনিয়ন শাখার সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল হালিম বলেন, লবণাক্ত পানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চাষিদের ত্বক ফেটে যায়, পায়ে ঘা হয়, চোখে জ্বালাপোড়া ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে চর্মরোগে ভুগলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা বা সচেতনতার সুযোগ নেই। স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এই পেশা ছাড়তে পারছেন না, কারণ এটি তাদের একমাত্র জীবিকা। কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবা বা সুরক্ষা সামগ্রী না থাকায় পরিস্থিতি দিন দিন আরও জটিল হচ্ছে। এ বাস্তবতা দেখায়, উৎপাদনের পেছনে শুধু অর্থনৈতিক নয়, শারীরিক ত্যাগও কতটা বড় একটি উপাদান।
উৎপাদনের পর লবণ স্থানীয় বাজার, আড়তদার ও শিল্পকারখানায় বিক্রি করা হয়। বেশিরভাগ চাষি নিজেরা বাজারজাত করতে পারেন না। ফড়িয়া বা আড়তদারদের ওপর নির্ভর করতে হয়, যারা অনেক সময় কম দামে লবণ কিনে মজুত করে পরে বেশি দামে বিক্রি করে। এতে আসল লাভটা চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে। বাংলাদেশের শিল্প খাতে যেমন টেক্সটাইল, ট্যানারি, কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে লবণের চাহিদা ক্রমবর্ধমান, তেমনি খাদ্য লবণের চাহিদাও বাড়ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে। কিন্তু আমদানিনির্ভর শিল্প লবণের নীতিতে স্বচ্ছতার অভাব থাকায় স্থানীয় লবণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উৎপাদন বেশি হলেও বাজারে আমদানি চলতে থাকায় দাম পড়ে যায়, চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়েন। এ অবস্থায় স্থানীয় উৎপাদকদের সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে দীর্ঘমেয়াদে এই শিল্প টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিসিক কক্সবাজারের (লবণ শিল্পের উন্নয়ন) উপ–মহাব্যবস্থাপক আবু জাফর ভূঁইয়া বলেন, বর্তমানে বাজারে লবণের দাম তুলনামূলকভাবে কম থাকায় প্রান্তিক চাষিরা দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চাষিদের আর্থিক সক্ষমতাও সীমিত। তবুও লবণ একটি বিকল্পহীন পণ্য হওয়ায় এর সম্ভাবনা বিশাল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চাহিদাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে লবণের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। ফলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে এর অবস্থানও বেশ শক্তিশালী।
কক্সবাজারের লবণ শুধু একটি পণ্য নয়, এটি হাজারো পরিবারের জীবিকার ভিত্তি, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই শিল্প টিকিয়ে রেখেছে উপকূলের মানুষ। যথাযথ নীতি সহায়তা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে এই শিল্প আরও বিকশিত হয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।