আর মাত্র কিছুদিন পর শুরু হবে শীত। আবহাওয়া এবং শিক্ষার্থীদের বিষয় বিবেচনা করে ভ্রমণে আমরা শীতকালকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। ভ্রমণ জীবনের একটি আরামদায়ক অভিজ্ঞতা যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, ভ্রমণ আপনাকে যা দেখায় মানচিত্র তা আপনাকে কখনোই দেখাতে পারবে না। পর্যটন হল আধুনিক সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পৃথিবীকে জানার অন্যতম মাধ্যম, যা ১৭ শতকে পশ্চিম ইউরোপে শুরু হয়েছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৫০ সালে বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫০ লক্ষ কিন্তু বর্তমানে ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা মতে এই বিপুল সংখ্যার ৭৩ শতাংশই আবার ভ্রমণ করবে এশিয়ার দেশগুলোতে। কিন্তু সঠিক তথ্য–উপাত্ত না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয়, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ বিদেশী পর্যটক ভ্রমণ করেন। একই বছর প্রায় ৪ কোটি দেশীয় পর্যটক সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান। পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল। বাংলাদেশ যদি এই বিশাল বাজার ধরতে পারে তবে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
অপূর্ব সৌন্দর্যের আধার বাংলাদেশ, যার প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত যা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই, প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন যা ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে, সুন্দরবনের সঙ্গে যে বিষয়টি নিবিড়ভাবে জড়িত তা হলো বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের অকৃত্রিম সৌন্দর্য ও পর্যটনের মূল আকর্ষণ হলো– পাহাড়ে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি, যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয় এর সঙ্গে আছে পাহাড়ে নৃ–গোষ্ঠীর ভিন্নধর্মী জীবনাচরণ যা আমাদের চেয়ে অনেকটা আলাদা। পর্যটকদের মন জুড়ায় নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল, এই অঞ্চলে রয়েছে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ চা বাগান মালনীছড়া, সৌন্দর্যের রানী খ্যাত জাফলং, নীলনদ খ্যাত স্বচ্ছ জলরাশির লালা খাল, সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল, পাথর জলের মিতালিতে বয়ে যাওয়া বিছনাকান্দির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, পাহাড় ভেদ করে নেমে আসা পাংথুমাই ঝর্না, , হাকালুকি হাওড়। বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চল পর্যটনের আরেক সম্ভাবনার নাম, সুনামগঞ্জ, মধ্যে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাওড় অঞ্চলের সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশি সৌন্দর্য পর্যটকরা নৌকায় বসে উপভোগ করে, বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মায়ায় ভেসে বেড়াতে পারে।
পৃথিবী জুড়েই পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প যা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অনেক দেশ এই পর্যটন শিল্প থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করছে,আয়ের উৎস হিসেবে পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে নতুন নতুন পর্যটন অঞ্চল সৃষ্টি করে প্রচার প্রচারনার পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি করছে। পর্যটন শিল্পে বিশ্বের বুকে এক অপার সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশ। কিন্তু বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক কর্মপরিকল্পনার অভাবে আমরা পর্যটন শিল্পে এখনো অনেক পিছিয়ে আছি।এই শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু ও সমন্বিত পরিকল্পনা। এই শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পেশাদার দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সঠিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প অন্যতম নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারবে, যেখানে সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, ও মালদ্বীপ পর্যটন খাত থেকে আয় আমাদের দেশের চেয়ে বেশি, সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পর্যটনশিল্পে সবচেয়ে পিছিয়ে, যেখানে পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে তুলতে সক্ষম হলে দক্ষিণ এশিয়ায় পর্যটনে আমরাও এগিয়ে থাকবো। আমাদের পর্যটন আয়ের বেশির ভাগই আসছে কিন্তু দেশীয় পর্যটন থেকে। তাই এটি প্রমাণ করে যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিদেশি পর্যটকের কাছে আমাদের পর্যটন শিল্পের জনপ্রিয়তা এখনো অনেক কম। এমনকি আমাদের বর্তমানে যে পর্যটন স্থানসমূহ রয়েছে তারও কোন প্রচারণা নেই। তাছাড়া পর্যটন শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণহীন ফলে অনেক সময় পর্যটকরা বিভিন্ন হেনস্তা ও প্রতারণার শিকার হয়। আমাদের দেশে সরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন পর্যটন এলাকা সৃষ্টি না হলেও বেসরকারি উদ্যোগে কিছু নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র সৃষ্টি হলেও তা বিলাসবহুল হওয়ায় সাধারণ নাগরিকদের পক্ষে উপভোগ করা অনেকটা অসম্ভব। তাই বাংলাদেশের এই শিল্পে পিছিয়ে থাকার সম্ভাব্য কারণগুলো হচ্ছে:
১. অবকাঠামোগত দুর্বলতা
২. পর্যটকের জন্য বাড়তি খরচ।
৩. প্রচার–প্রচারণার অভাব
৪. নিরাপত্তার অভাব
৫. উন্নত সেবা ও তথ্যের অভাব।
৬. আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা।
বাংলাদেশ অপার সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসাকে সর্বদা ধরে রাখার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিকাশের দায়িত্ব আমাদেরই, আমাদের দেশের অনেক ভ্রমণ পিপাসু ব্যক্তি দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে নিজ দেশের অনেক কিছু তারা ঘুরে দেখে না,তাই হয়তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু’। তাই অপরূপ বাংলাদেশকে দেখার জন্য পর্যটন খাতে আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।