সম্প্রীতির বন্ধন অটুট থাকুক

নাসের রহমান | মঙ্গলবার , ২১ অক্টোবর, ২০২৫ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

বহুকাল থেকে এদেশের মানুষ সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। এ বন্ধন অটুট রাখতে মানুষ বদ্ধপরিকর। যে কোনো পরিস্থিতিতে সম্প্রীতি বজায় রাখতে চায়। পাশাপাশি চলতে চায়। মিলেমিশে থাকতে চায়। পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ চায়। কারো সাথে বৈরিতা নয়, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়। কারো আবেগ অনুভূতি নিয়ে বিদ্রুপ বা কটাক্ষ নয়। কারো প্রতি অবহেলা নয়। কারো প্রতি অবজ্ঞা নয়। কারো বিশ্বাসে আঘাত করা নয়। কারো প্রতি প্রতিহিংসা নয়। কারো প্রতি অমর্যাদা নয়। কারো প্রতি অবিশ্বাস নয়। কারো পথ চলায় প্রতিবন্ধকতা নয়। কারো পথ রুদ্ধ করা নয়। কাউকে হেনস্তা করা নয়। কাউকে বিপদগ্রস্ত করা নয়। কারো প্রতি অন্যায় অবিচার নয়। কারো সাথে জোরজবরদস্তি নয়। কারো চিন্তা চেতনায় হস্তক্ষেপ নয়। কাউকে অধিকার বঞ্চিত করা নয়। কারো প্রতি বৈষম্য নয়।

সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য এসব প্রসঙ্গ অপরিহার্য। পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে এগুলো পরিপালিত হয়। এক্ষেত্রে সহনশীল মনোভাবের কোনো বিকল্প নেই। সবার সাথে সদাচরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শতাব্দিকাল থেকে এসব অনুসঙ্গ সমাজে প্রবহমান। কালের ধারায় কখনো সমুজ্জ্বল আবার কখনো ম্রীয়মান। কখনো গতিময় আবার কখনো স্থবির। তবে কখনো থেমে থাকেনা। সবসময় চলমান। কখনো বাধাগ্রস্ত হলেও চলমান থাকে। সমাজের সাথে চলমান, সময়ের সাথে বহমান। সবাই যে সমানভাবে পরিপালন করে তা নয়। অনেকে সমান তালে চলতে পারে না। তবে কম বেশি সবাই পরিপালনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এজন্য সম্প্রীতির বন্ধন অটুট থাকে। সবাই সম্প্রীতির বন্ধনে থাকতে চায়।

ধর্ম বর্ণ গোত্র সম্প্রদায় নানাভাবে মানুষ বিভক্ত। ধর্মীয় বিভাজনটা সবচেয়ে বড়। এর মধ্যে দিয়ে দূরত্ব তৈরি হয় বেশি। ধর্মের মূল বাণী প্রায় একই রকম হলেও আচার আচরণে ব্যবধান অনেক। এক ধর্মের অনুসারীর সঙ্গে আরেক ধর্মের অনুসারীর তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ধর্ম পালনে যে যার ধর্মের রীতি অনুসরণ করে থাকে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধও লক্ষ্য করা যায়। বিরোধ থাকলেও কেউ কাউকে বাধা দিতে পারে না। যার যার ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করার অধিকার সবার আছে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার নেই। অন্যের ধর্মের সমালোচনা করাও সমীচীন নয়। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্মের প্রতি আস্থাশীল, বিশ্বাসে অবিচল থাকে। এজন্য যার যার ধর্ম তার তার। ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি, সামাজিক সম্প্রীতি, রাজনৈতিক সম্প্রীতি, আরো অনেক সম্প্রীতির কথা বলা যায়। তবে এদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় ধর্মীয় সম্প্রীতি বা সাম্প্রাদয়িক সম্প্রীতি। কারণ একসময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এদেশের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। সর্বদা আতংকগ্রস্ত করে রাখতো। বহু নিরীহ মানুষ এ দাঙ্গার শিকার হয়েছিল। প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। এ ভয়াবহ দাঙ্গার বিপরীতে সম্প্রীতি আনার জন্য মানুষের চেষ্টা কখনো থামেনি। বহু ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প নির্মূল হয়ে সম্প্রীতির বন্ধন সাম্পদায়িক সম্প্রীতি গড়ে ওঠে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রয়োজন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসের প্রয়োজন। তরুণ প্রজন্মকে এ মানসিকতায় গড়ে তুলতে না পারলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা যাবে না। সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখা যাবে না। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সমাজকে এমনভাবে কলুষিত করে যার রোষানল থেকে কেউ রক্ষা পায় না। এজন্য সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে অংকুরে বিনষ্ট করে দিতে হয়। এর বিষদাঁত সমূলে উৎপাটন করতে হয়। এ বিষবাষ্প একবার ছড়িয়ে পড়লে প্রতিশোধের আগুনে বছরের পর বছর জ্বলতে হয়। এজন্য যুগে যুগে কবি সাহিত্যিকেরা, সমাজ চিন্তকরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে। তাদের লেখনিতে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। সাধারণ মানুষও সবসময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সচেষ্ট থেকেছে।

পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক বন্ধন, আত্মীয়তার বন্ধন, ধর্মীয় বন্ধন, সাম্প্রদায়িক বন্ধন আরো অনেক ধরনের বন্ধন দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বড় বন্ধন সম্প্রীতির বন্ধন। এসব বন্ধনে যদি সম্প্রীতির অভাব দেখা দেয় তবে বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। এর মাত্রা বাড়তে থাকলে একসময় বন্ধন আর টিকে থাকে না। জোড়া তালি দিয়ে বেশি দিন ধরে রাখা যায় না। এজন্য সম্প্রীতির বন্ধনকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হয়। চিন্তা চেতনায় মন মানসিকতার সম্প্রীতির বীজ বপন করতে হয়। তাহলে নতুন প্রজন্মের মাঝে অসাম্প্রদায়িক চেতনা গড়ে ওঠবে। সম্প্রীতির বন্ধনকে দৃঢ় প্রত্যয়ে ধারণ করবে। সম্প্রীতির সমাজ বিনির্মাণে অগণী ভূমিকা পালন করবে। অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে।

এ বন্ধনগুলোর গুরুত্ব আগামী প্রজন্ম অনুধাবন করতে না পারলে সম্প্রীতি টিকে থাকতে না পারবেনা। পারস্পরিক বোঝাপড়া, শ্রদ্ধা, আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর এসব বন্ধন টিকে থাকে। বিশ্বাস না থাকলে অনেক কিছু হারিয়ে যায়। তেমনি আস্থা বা বিশ্বাসের সংকট হলে সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখা যায় না। একের থেকে অন্যের দূরত্ব বেড়ে যেতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আবেগ তাড়িত হয়ে ভুল সিন্ধান্তে গ্রহণ করে। যে ভুল সংশোধন করা যায় না। এ ভুলের ঘাত প্রতিঘাতে সম্প্রীতির বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে। ভুল পথে একবার পা বাড়ালে তার মাশুল গুনতে হয় বহু বছর ধরে। স্পর্শকাতর এসব বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হয়। বিবেক বিবেচনাকে সদা জাগ্রত রাখতে হয়। যে কোন অশুভ শক্তিকে সমূলে বিনাশ করে দিতে হয়। তা না হলে হাজার বছরের যে সম্প্রীতির বন্ধন তাকে সমুন্নত রাখা যায় না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিচার বিভাগকে শক্তিশালী করা বেশি জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধঢাকায় ‘শাম-এ-নুসরাত’