দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব
এই গ্রাম থেকে মানাং খুব দূর না হওয়ায় সকাল সকাল গেলাম নাগাওয়াল (nagawal) গ্রামের প্যাগোডাটাতে। এই অন্নপূর্ণা সার্কেটজুড়ে এরকম ছোট, বড় অনেক আশ্রম ও প্যাগোডা রয়েছে যেটা পুরো ট্রেকিংটাকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তোলে। এই প্যাগোডাটা বেশ উঁচুতে (৩৭৫০ মিটার) অবস্থানের কারণে অন্নপূর্ণা ২ এবং ৩ দুইটাকেই খুব ভালোভাবে দেখলাম। এটা দেখা শেষ করার পর যাত্রা শুরু করলাম মানাংয়ের উদ্দেশ্যে। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে পৌঁছেও গেলাম। মানাং আসলে ছোটখাটো একটা মফস্বল তবে পুরো অন্নপূর্ণা সার্কেট এলাকায় এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই ট্রেকিংয়ের এটাই সর্বশেষ জায়গা যেখানে আপনি মোটামুটি আধুনিক সব সুযোগ–সুবিধা পাবেন আর বলতে পারেন এটাই ট্রেকিং শেষ করার আগ পর্যন্ত স্থানীয়দের শেষ বসতি এলাকা। নানা কারুকাজ করা মানাং গেইট দিয়ে যখন প্রবেশ করি তখন দেখা মিললো প্রচুর ট্রেকারের। প্রচুর ট্রেকার হওয়াতেই হোটেল খুঁজতে একটু কষ্ট হলেও শেষ পর্যন্ত মোটামুটির মানের একটা পেয়েও গেলাম।
উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য অধিকাংশ ট্রেকার মানাংয়ে দুই রাত অবস্থান করে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে এক রাত থাকবো। যেহেতু আমরা আগের রাতে এর চেয়ে বেশি উচ্চতায় (১০০ মিটার ) কাটিয়েছি। এখানে এসে নানা দেশের ট্রেকারদের সাথে পরিচিত হলাম। নানা চিন্তার, পেশার, বয়সের এই ট্রেকারদের বড় অংশই ইউরোপীয়ান। কেউ আসছে দল বেধে, কেউ আসছে প্রেমিক–প্রেমিকা নিয়ে, কেউ আসছে চাকরি আর ভালো না লাগায়, কেউ কেউ একেবারে একা। আবার দেখা মেলে ৬০–৭০ বছর বয়সী দম্পতি’র, যারা ধরে নিয়েছে জীবনের শেষবারের মত তাদের প্রিয় জায়গয় ঘুরে আসার। নানা জনের নানা গল্প শুনতে শুনতে মানাংয়ের সন্ধ্যাটা বেশ ভালো কেটে গেল । পরেরদিন ভোরে ভোরে আবার ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করি। গন্তব্য পৃথিবীর অন্যতম উঁচু জায়গায় অবস্থিত লেক তিলোচি।
মানাং থেকে তিলোচি বেস ক্যাম্পের ট্রেকিংটা যেমন সুন্দর তেমনি ভয়ঙ্করও। তিলোচি বেস ক্যাম্পে পৌঁছার আগের ৪ কিলোমিটার ছিলো খুবই ভয়ঙ্কর। এই পথে পাথর ধস একটা নিয়মিত ঘটনা আর পথটা একদিকে সরু আরেকদিকে গভীর খাদ। একটু এদিক সেদিক হলে আপনি সোজা গিয়ে পড়বেন খাদে। যেহেতু আমাদের এই অভিযান সৌন্দর্যের খোঁজে। তাই এই ঝুঁকি নিতে আমার কোন আপত্তি নাই। যা হোক, এই ঝুঁকিপূর্ণ আনন্দ নিয়ে যখন তিলোচি বেস ক্যাম্প পৌঁছাই তখন বাজে প্রায় সন্ধ্যা ৬ টা আর তাপমাত্রা মাইনাস ৫। পরের দিন সকাল সকাল তিলোচি লেকে যাবো সে পরিকল্পনা করে রাতে টি হাউজে ঘুমাতে গেলাম। সকাল সকাল আমরা যাত্রা শুরু করি লেকের দিকে। কিন্তু যাত্রার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার বন্ধুর উচ্চতাজনিত সমস্যা দেখা দেয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন কমছে না তখন সিদ্ধান্ত নিলাম না যাওয়ার এবং তিলোচি বেস ক্যাম্পে বিশ্রাম নেওয়ার। আমরা সারাদিন চেষ্টা করেছি উচ্চতা এবং ঠাণ্ডার সাথে মানিয়ে নিতে। আর তিলোচি বেস ক্যাম্পে অন্য ট্রেকারদের সঙ্গে গল্প করে সময়টা পার করলাম। যেটাকে আমরা নাম দিয়েছি ‘অফ ডে’।
পরেরদিন ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে তিলোচি লেকের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করি। বরফে ঢাকা পর্বতগুলোর মাথায় সূর্য তার প্রথম কিরণ দিয়ে যে দৃশ্যের তৈরি করেছে সেটা কেবল কোনো মহান পন্ডিত দ্বারা বর্ণনা করা সম্ভব। আমরা কেবল এই দৃশ্য দেখে সৌন্দর্যের আরেকটি দিক উন্মেচন করতে পারি । যাত্রার আড়াই ঘণ্টা পর জীবনে প্রথমবার বরফের রাস্তার দেখা পেলাম। আগে কখনো বরফের রাস্তায় হাঁটার অভিজ্ঞতা না থাকায় বারবার পিছলে যাচ্ছিলাম আর আমার অল্প দাড়িগুলোও বারবার বরফ হয়ে যাচ্ছিল। ৩০ মিনিট বরফের রাস্তায় হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম পৃথিবীর অন্যতম উচুঁ জায়গা তিলোচি লেকে (১৬৫৭৭ ফুট)। লেকে পৌঁছার পর অবাক হওয়ার মাত্রাটা আরও দ্বিগুন বেড়ে গেল। এত উপরে লেক সেটা তো আছে সে সাথে লেকের পানি এত নীল হতে পারে দেখে আমার কাছে নীল রঙের সংজ্ঞাটা পাল্টে গেল। এখানে আসার আগে এই লেকের যেসব ছবি দেখেছি আসলে সে–সব ছবিগুলোতে এটার পুরোপুরি সৌন্দর্য আসে নাই । বলতে গেলে, এই প্রথম কোনো দৃশ্য দেখলাম যেটা ছবির চেয়ে সুন্দর ।
লেকের ধারে কিছুক্ষণ বসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু প্রচণ্ড বাতাসের কারণে বসা যাচ্ছিল না । দ্রুত কিছু ছবি তোলে আবার দল বেঁধে রওনা দিলাম তিলোচি বেস ক্যাম্পের দিকে। এই অন্নপূর্ণা সার্কেটে দুইটা ট্রেকিং পথ রয়েছে। একটা তিলোচি লেক পর্যন্ত আরেকটা পুরো অন্নপূর্ণা সার্কেট। অধিকাংশ ট্রেকার এই দুইটার যে–কোনো একটা সম্পন্ন করে তাদের ট্রেকিং শেষ করে আর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এই দুইটা পথ একসঙ্গে সম্পন্ন করবো । তাই তিলোচি লেক থেকে তিলোচি বেস ক্যাম্পে এসে ব্যাগট্যাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পাস ‘ তোরাংলা পাস’–এর উদ্দেশ্যে।
আমরা যখন তিলোচি বেস ক্যাম্প থেকে তোরাংলা পাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি তখন একটা গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে ট্রেকিং শুরু করি । আমরা মূলত গাইড এবং পোর্টার ছাড়াই এই অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেকিং করছি। কিন্তু তিলোচি লেকে এসে বুঝতে পারলাম এই সিদ্ধান্ত আমাদের মত অনভিজ্ঞ লোকদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। পরস্পরের সহযোগিতা, উৎসাহ এবং ট্রেকিংয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া এই অন্নপূর্ণা সার্কিট সম্পন্ন করা সম্ভব না জেনেই আমরা এই গ্রুপের সাথে যুক্ত হই। ফ্রান্সের ২ জন এবং আমেরিকার ২ জন মিলে মোট ৪ জন ট্রেকার ছিল আর তাদের সাথে ছিল একজন গাইড। আড্ডা, গান এবং পরস্পরের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা খুব দ্রুত একটি টিমে পরিণত হয়ে গেলাম। আমাদের টিমের এক মেয়ে গাইড হিসেবে কাজ করে আলাস্কাতে। তার কাজ থেকে আমরা ট্রেকিং নিয়ে খুঁটিনাটি অনেক কিছু জেনে নিলাম। এই গ্রুপের সাথে যুক্ত হওয়ার পর আমার আত্মবিশ্বাস বেশ বেড়ে গেলেও প্রচণ্ড ঠান্ডা আমাকে বারবার দুর্বল করে দিচ্ছিল। স্লিপিং ব্যাগ, ২–৩টা শীতের কাপড় এবং মোটা কম্বল গায়ে দিয়েও ঠান্ডার কারণে তোরাংলা পাসের আগের দুই রাত আমি কোনোভাবেই ঘুমাতে পারছিলাম না। ঠান্ডার মাত্রা এতটা ভয়াবহ এখানে বিকাল হওয়ার সাথে সাথে পানি বরফে পরিণত হয়ে যায় এবং সেটা পরের দিন ১১–১২টা বাজার আগে পর্যন্ত পানিতে রূপান্তর হয় না।
২৩ নভেম্বর ভোর ৫টায় আমরা তোরাংলা পাস অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নিই এবং সে অনুয়াযী আমাদের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করি। ভোর ৫টায় আমরা যখন তোরাং পেদী হাই ক্যাম্প থেকে তোরাংলা পাসের উদ্দেশ্যে গ্রুপের সবাই একত্রিত হই তখন দেখলাম আরও অসংখ্য ট্রেকার গ্রুপে গ্রুপে একত্রিত হয়েছে। মাথায় টর্চ, পিঠে ব্যাগ, হাতে লাঠি নিয়ে যখন সবাই লাইন ধরে আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠছে মনে হচ্ছিল অনেক লম্বা এক ট্রেন পর্বত বেয়ে উপরে উঠছে। পুরো ট্রেকিং জুড়ে এই দৃশ্যটা আমার কাছে এখনো তরতাজা। এই তোরাং পেদী (৪৯৫০ মিটার) থেকে আমাদের আরও ৫০০ মিটার মত উপরে উঠতে হবে তোরাংলা পাস পৌঁছাতে গেলে। অসংখ্য ট্রেকারের উৎসাহের কারণে প্রচন্ড ঠান্ডা আমাকে খুব বেশি দুর্বল করতে পারেনি। প্রায় ৩–৪ ঘণ্টার ট্রেকিং করার পর সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে আমরা তোরাংলা পাস (৫৪১৬ মিটার) এসে পৌঁছায়, যেটাকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ পাস। এখানে এসে যে অসাধারণ দৃশ্যের মুখামুখি হয়েছি তাতে গত ৮–৯ দিনের কঠিন সময়গুলোকে গায়েব করে দিল। চারপাশের বরফের ওপরে সূর্যের কিরণের ফলে যে দৃশ্য তৈরি করেছে তখন কেবল একটা লাইনই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘কত সুন্দর এই পৃথিবী!’
প্রচুর ট্রেকারের এখানে মোটামুটি ছবি তোলার হিড়িক পড়ে গেল। আমি ব্যাগ থেকে বাংলাদেশের পতাকা বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। যখন সবাই ছবি তুলে নিচে নামার জন্য রওনা দিলাম তখন আমি ভাবি নাই এই ট্রেকিংয়ে আরও কিছু কঠিন পথ আমার জন্য বাকি রয়েছে। তোরাংলা পাস থেকে কিছু নিচে নামার পর বরফের পিচ্ছিল পথ শুরু আর এই পথে একটু এদিক সেদিক হলেই প্রায় ৯–১০ হাজার ফুট নিচে গিয়ে পড়বো। আমি যে ট্রেকিং জুতা পড়েছি সেটা খুবই সাধারণ মানের ছিল। ফলে আমি কোনোভাবেই এই পিচ্ছিল ও সরু পথ ধরে নামতে পারছিলাম না। আমি যখন নামতে পারছিলাম না তখন গ্রুপের সকলেই এসে আমাকে সহযোগিতা করতে লাগলো। প্রতিটা কদম কোথায় রাখবো, লাঠিটা কোথায় ফেলবো তাঁরা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে শিখিয়ে দিতে লাগলো। অবেশেষ প্রায় ৪৫ মিনিট ট্রেকিং করার পর এই বরফের পিচ্ছিল পথ পার হয়ে মনে হলো নতুন জীবন ফিরে পেলাম। এরপর আরও ৩–৪ ঘণ্টা অসাধারণ সুন্দর পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম তিব্বতের পাশ ঘেঁষা শহর মুক্তিনাথে। পেছনে রেখে এলাম অন্নপূর্ণা’র নানা জিগজ্যাগ সরু পথ, ফায়ার প্লেইস, টি হাউজ।