নীল তিমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী। নীল তিমি সামুদ্রিক এবং স্তন্যপায়ী প্রাণী। এই প্রাণী মানুষের চেয়ে বহুগুণ বড়। এটির ওজন প্রায় ১৫০ টন এবং এরা দৈর্ঘ্যে ৩০ মিটারের (৯৮ ফিট) হতে পারে। একটা সময় এই বিশালাকৃতির প্রাণীটি সংখায় অনেক বেশি থাকলেও বর্তমানে এটি বিলুপ্তপ্রায় একটি প্রাণী। মাত্রাতিরিক্ত শিকার, সমুদ্রের পরিবেশ দূষণ, পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব এমন অনেকগুলো বিষয়ের প্রভাবে নীল তিমির এই অস্তিত্ব সংকটের মুখে।
অনেকের ধারণা, সাগরে সাঁতরে বেড়ানো তিমিরা হলো একধরনের মাছ; কিন্তু তিমি কোনো মাছ নয়, স্তন্যপায়ী প্রাণী। বলতে পারো তোমার–আমার মতো একধরনের জীব। অত্যন্ত সুন্দর আর বুদ্ধিমান জীব। মাছের মতো ওরা ফুলকা দিয়ে নিঃশ্বাস নেয় না, আবার ডিমও পাড়ে না। শ্বাস–প্রশ্বাস চলে আমাদেরই মতো ফুসফুস দিয়ে। আর শ্বাসও নেয় আমাদের মতো বাতাস থেকে। অথচ ওরা থাকে সাগরের পানিতে। আরো অনেক আশ্চর্যজনক মিল আছে আমাদের সাথে ওদের। আমাদের যেমন চুল আছে তেমন ওদেরও চুল গজায়, তবে তিমিরা বড় হলে ওগুলো আর তেমন দেখা যায় না। আমাদের মতো তিমিও উষ্ণ রক্তের প্রাণী। আমাদের হৃৎপিণ্ডের মতো ওদেরও হৃৎপিণ্ডে চারটি প্রকোষ্ঠ আছে সাগরের বুকে বহু রকমের তিমি যে আছে তবে সব তিমিকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে ওদের দাঁত দেখে। একধরনের তিমির বড় বড় গোজ বা হাতির দাঁতের মতো দাঁত আছে। ওরা স্কুইড, বড় মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী শিকার করে খায়। এদের একটামাত্র নাকের ফুটো থাকে।
প্রায় ৬৬ প্রজাতির তিমি আছে দাঁতাল তিমি শ্রেণীতে। আর এক ধরনের তিমি আছে যাদের দাঁতগুলো চিরুনির দাঁতের মতো, অনেকটা ছাঁকনির কাজ করে ওগুলো। এ শ্রেণীর তিমি ছোট ছোট মাছ ছেঁকে মুখে পুরে নেয়। এদের নাকে দুটো ফুটো। ১০ প্রজাতির তিমি আছে এ শ্রেণীতে। কোনো কোনো তিমি কিন্তু অত বড় দেহ নিয়েও বেশ ভালো সাঁতার কাটতে পারে। কিলার তিমি আর শর্টফিন পাইলট তিমিরা হলো তিমি জগতের সবচেয়ে দ্রুততম তিমি। ওরা ঘণ্টায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার বেগে সাঁতরাতে পারে। তিমিরা ওদের লেজের ওঠানামা দ্বারাই মূলত সাঁতার কাটে। ওভাবে সাঁতরাতে সাঁতরাতে কোনো কোনো সময় তিমিরা ওদের আবাস ছেড়ে অনেক দূরে চলে যায়। বিশেষ করে ঠাণ্ডা পানির স্রোত থেকে প্রায়ই তারা দূরের কোনো গরম পানির স্রোতের সন্ধানে সাঁতরাতে সাঁতরাতে চলে যায়। আর এ ক্ষেত্রে ধূসর তিমির কোনো জুড়ি নেই। বছরে ওরা সাগরে গড়ে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মাইল পথ পরিভ্রমণ করে।
অনেক তিমিই কিন্তু খেলতে পছন্দ করে। যেমন কোনো তিমির ইচ্ছা হলো তো হঠাৎ সাগর জল থেকে লাফিয়ে শূন্যে উঠে পড়ল খানিকটা, আবার ধপাস করে পানি ছিটিয়ে পড়ল সাগরের বুকে। তবে ওটা যে নেহাত খেলার জন্যই ওরা করে তা ভেবো না।
অনেক সময় ওদের বিশাল বপুতে কিছু পরজীবী প্রাণী বাসা বাঁধে যেমন আমাদের মাথায় উকুন হয়। ওগুলোকে ঝেড়ে ফেলে দিতেও ওরা এমনটি করে থাকে। মাঝে মধ্যে তিমিরা সাগরের বুকে শুধু মাথাটা উঁচু করে একবার ঘুরিয়ে চার পাশটা দেখে নেয়, দেহকে পানির উপরে তোলে না। তিমিরা কিন্তু বেশ সামাজিক। ওরা দলে বেঁধে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। তিমির দলকে বলে পড। তবে কোনো বিপদ দেখলে পানির উপরে বাতাসে খাড়া করে লেজ উঠিয়ে ছুটতে থাকে। এ সময় বিকট আওয়াজ হয়। সে শব্দেই দলের অন্য তিমিরা সতর্ক হয়ে যায়।
তিমিরা নানা রকম শব্দ করে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান–প্রদান করে। এমনকি তিমিরা গানও গায়। বিশেষজ্ঞরা হ্যাম্পব্যাক বা কুব্জপৃষ্ঠ তিমির ৩০ মিনিট পর্যন্ত গান রেকর্ড করেছেন। তিমি কেন গান গায়, সে আর এক রহস্যের জাল। দাঁতাল তিমিরা অন্য তিমিদের চেয়ে বেশ জোরে শিস দেয়ার মতো করে গান গায়। অবশ্য ভবঘুরের মতো শিকারের সন্ধানে ঘোরার সময়ও দাঁতাল তিমিরা গান গায় বলে জানা গেছে। তবে অন্য তিমিরা গান গায় খুব নিচু স্বরে, কোমল করে। তবে নীলতিমি যত জোরে শব্দ করতে পারে অত জোরে পৃথিবীর আর কোনো প্রাণী শব্দ করতে পারে না। সাগরে নীল তিমির কণ্ঠস্বর ৫০০ কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায়।