সমুদ্রগামী আরো দুটি জাহাজ যুক্ত হয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজের নৌ-বহরে। সর্বশেষ প্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা সজ্জিত ‘এম ভি মেঘনা প্রিন্সেস’ ও ‘এম ভি মেঘনা এডভেঞ্চার’ নামে জাহাজ দুটি গতকাল উদ্বোধন করা হয়েছে। নতুন জাহাজ দুটির প্রতিটি ৬৩ হাজার মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করতে পারবে। মেঘনা গ্রুপের নতুন সংযোজিত দুটিসহ বাংলাদেশের পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ৬৩টিতে উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু মেঘনা গ্রুপের জাহাজের সংখ্যা হয়েছে ১০টি। সমুদ্রগামীসহ প্রায় ১৪৫টি জাহাজ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
গতকাল বুধবার দুপুরে আল্ট্রাম্যাক্স ড্রাই বাল্ক ক্যরিয়ার ‘এম ভি মেঘনা প্রিন্সেস’ ও ‘এম ভি মেঘনা এডভেঞ্চার’ এর উদ্বোধন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে জাহাজ দুটির উদ্বোধন উপলক্ষে আয়েজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান। গেস্ট অব অনার ছিলেন নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন মেঘনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল। বক্তব্য রাখেন ৭১ টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক বাবু, এইচএসবিসি ব্যাংকের হোলসেল ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান কেভিন গ্রিন এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন মতিউর রহমন চৌধুরী।
প্রধান অতিথি খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের শিপিং সেক্টেরে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিষয়টি আমাদের জন্য সুসংবাদ। মন্ত্রী বলেন, বিনিয়োগ ও ব্যবসাবন্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্বব্যাংকসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, আজ সকালে বিশ্বব্যাংকের একজন প্রতিনিধির সাথে কথা হয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে তিনি ফোন করেছেন। তারা নৌ-শিপিং সেক্টরে বিনিয়োগ করতে চান। কী ধরনের বিনিয়োগ আমরা নিতে চাই সেটা তারা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন। এটা দেশের জন্য বিরাট সুসংবাদ। প্রতিমন্ত্রী বলেন, শুধু বিশ্বব্যাংক না, পৃথিবীর অন্যান্য যেসব দেশে আমাদের বেইজ আছে, যেমন তার্কি, চীন, কোরিয়া, ইউকে, ইউএসএ তারা বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিতে চায়। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা আগে ছিল না। প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগের দরজা খুলে দিয়েছেন। আগে পরিকল্পিত কোনো ধরনের শিল্পায়ন ছিল না, এখন প্রধানমন্ত্রী পদক্ষেপ নিয়েছেন।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মানুষকে সাহসী করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি মানুষের সামনে পৃথিবীর দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আমাদের সক্ষমতা যত বৃদ্ধি পাবে পৃথিবী তত আমাদের কাছে চলে আসবে। সেই পথযাত্রায় মেঘনা গ্রুপের যে যাত্রা তা আরো দীর্ঘ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যত সহযোগিতা করা দরকার সবটুকু করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
তিনি বলেন, জাহাজটা শুধু ব্যবসা না। দেশের পতাকা নিয়ে যখন পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে যাবে সেখানে বাংলাদেশকে মানুষ চিনবে। সেখানে জাহাজ আমাদের অ্যাম্বেসেডর হিসেবে কাজ করবে। এটা আমাদের গর্ব। তিনি বলেন, ভাবতে কষ্ট লাগে বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ৬৩টি। এটা দু:খজনক। অনেক দেশ আছে যাদের পাঁচশ’র বেশি আছে। আমরা চাই আগামী পাঁচ-দশ বছরে আমাদের পাঁচ’শ-ছয়’শ সমুদ্রগামী জাহাজ হবে। এজন্য আমাদের ব্যবসায়ীরা এগিয়ে অসবেন এবং সরকার তাদের সহযোগিতা করবে। এসময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন গঠন করে সাড়ে তিন বছরে ১৯টি জাহাজ সংগ্রহ করেছিলেন। ২০০৮ সালে এসে সেই শিপিং কর্পোরেশনের বহরে ছিল মাত্র ৮টি জাহাজ।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে শুধু একটি মাত্র চট্টগ্রাম বন্দর ছিল। তারও অনেক দুর্বলতা ছিল। তার আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। মংলা বন্দরের আউটার বারে (বর্হিনোঙ্গর) একসঙ্গে দেড়শ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হয়েছে। ইনার বারে শুরু হয়েছে। যা আগে কখনো হয়নি। পায়রায় আমরা বন্দর পেয়েছি, যেটাকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়ন হচ্ছে। আগামী ১০-১৫ বছরে সেখানকার চেহেরা পাল্টে যাবে। ইতোমধ্যেই বদলে যাওয়া শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতায় মাতারবাড়িতে ১৭ হাজার কোটি টাকায় গভীর সমুদ্রবন্দর অনুমোদন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কনসাল্টেন্ট নিয়োগি হয়ে গেছে। ২০২৪-২০২৫ সালের মধ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর আমরা পেতে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আজকে আমরা ৬০-৬৫ লক্ষ টন ক্যাপাসিটির জাহাজে বসে আছি। আগামী দিন দেড় লক্ষ টন ক্যাপাসিটির জাহাজের উপর বসে কথা বলার অপেক্ষায় আছি।
সীমাবদ্ধতা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডিজি শিপিংয়ের সাথে কথা হয়েছে। সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে বাবসাবান্ধব পরিবেশের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছি। অল্পকিছুদিনের মধ্যে আন্ত:মন্ত্রণালয় সভা করে বিষয়গুলো সুরাহা করব। যেন বাংলাদেশের সুনীল সমুদ্র যেন ব্যবসাবান্ধব হয় এবং দেশের অর্থনীতিতে এটা যেন বড় সহায়ক হয় সেভাবে পদক্ষেপ নিবে। মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, ভারতসহ অন্যদের সাথে নৌ-টুরি্যজম কিভাবে করা যায় সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে কথা বলেছেন।
মেঘনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মেঘনা গ্রুপ ৫০টি শিল্পকারখানা গড়ে তুলেছে। এর মাধ্যমে, সমৃদ্ধ করছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। প্রত্যক্ষভাবে ৩৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে সেখানে। পণ্যপরিবহনের সুবিধার্থে আটটি নিজস্ব সমুদ্রগামী জাহাজ, চারটি বাল্ক ক্যারিয়ার, অভ্যন্তরীণ রুটে ৩০টি চাটার্ডসহ ১৪৫টি জাহাজের নৌ-বহর গড়ে তুলেছি। সেই বহরে যুক্ত হলো আল্ট্রাম্যাক্স ড্রাই বাল্ক ক্যরিয়ার এম ভি মেঘনা প্রিন্সেস ও এম ভি মেঘনা এডভেঞ্চার। সারা বিশ্বে সমাদৃত জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওশিমা শিপবিল্ডিং কোম্পানি লিমিটেড এগুলো নির্মাণ করেছে।
তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন কথার প্রেক্ষিতে অনুশাসন দেন, মন্দার মধ্যে অপর্চুনিটি খুঁজে বের করার জন্য। সে আলোকে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও দেশের বাণিজ্যেকে গতিশীল করতে কোভিড-১৯ এর মধ্যেও ২০২০ সালে ১০ শতাংশ কম ব্যয়ে আরো ১০৪ মিলিয়ন ডলারে আরো চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহে চুক্তি করেছি। ২০২২ সালে সেগুলো আমাদের নৌবহরে যুক্ত হয়ে দেশের পতাকা বয়ে সুনাম ছড়িয়ে দিবে।
শিপিং সেক্টরকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিটিসিএল, বিটিআরসি, ডিজি শিপিং কর্পোরেশনসহ একটা মিটিং করে সমস্যা দূর করে সহায়ক নীতি নির্ধারণ করতে ন্যে-পরিবহন প্রতিমন্ত্রীর সহায়ত প্রত্যাশা করেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, সমুদ্রসীমা জয়ের মাধ্যমে ব্লু ইকনমির যে প্রসপেক্ট সেটা বাংলাদেশে অপরিসীম। যে দেশে একটা বন্দর এবং একটা শিপিং কোম্পানি থাকে সে দেশকে পিছে ফিরে তাকাতে হয় না। মেঘনা গ্রুপকে ধন্যবাদ জানাবো সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য। তারা শিপিং সেক্টরে এগিয়ে এসেছেন। তাদের সাথে আরো অনেকে এগিয়ে এসেছে। এ পর্যন্ত ৬৩টি জাহাজ প্রাইভেট বাণিজ্য বহরে যুক্ত হয়েছে। এটা সত্যিই আমাদের জন্য ইতিবাচক বিষয়। আশা করছি তাদের দেখানো পথে অন্যরাও এগিয়ে আসবেন। তিনি বলেন, মেরিটাইম সেক্টরে আমাদের যে ইনলাইন গ্রুপ আছে সেটা ব্যবহার করবেন।
বন্দর চেয়ারম্যান বাল্ক ক্যারিয়ারে পাশাপাশি কন্টেনার শিপিং এ বিনিয়োগের আহবান জানিয়ে বলেন, বর্তমান যুগটা কন্টেনারেজশন এর জন্য। সবকিছু কন্টেনারের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।
কমোডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন বলেন, প্রত্যেক নাবিক বাংলাদেশের একজন করে দূত। সুতরাং আন্তর্জাতিক পরিবেশে জাহাজে যখন কাজ করব আমাদের কম্পিটেন্স ও সেফটি কমপ্ল্যায়েন্স মানতে হবে। বাংলাদেশের সঠিক দূত হিসেবে যেন কাজ করতে পারে সেজন্য কম্পিটেন্স যথাযথভাবে দেখে নিয়োগ করতে হবে।
এম ভি মেঘনা প্রিন্সেস এর মাস্টার ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে জাহাজ ক্রয় করা হয়েছে। তবে জাহাজটি ২০১৯ সালে জাপানে তৈরি করা হয়েছে। মানভেদে ৬৫ হাজার মেট্রিক টন কার্গো ধারণ সম্পন্ন। সকল মেশিনারি অত্যাধুনিক এবং অটোমেটিক। ঘণ্টায় ২২ থেকে ২৫ কিলোমিটার বেগে সমুদ্রে গমন করতে পারে। মাল ওঠানামার জন্য জাহাজে অত্যাধুনিক ক্রেন ও গ্রেভ আছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশের নৌবন্দরে গমনাগমনের জন্য উপযোগী। জাহাজে নাবিকের সংখ্যা ২১। সবাই বাংলাদেশের নাগরিক।