‘সারা দিন সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেও সন্ধ্যায় বিএনপি কথা বলার অধিকার নাই দাবি করে’ বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (বিএনপি মহাসচিব) সকালবেলা কড়া ভাষায় সরকারের সমালোচনা করেন। আবার সেটার সাথে প্রতিযোগিতা করে দুপুরে রিজভী আহমেদ (বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব) আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করে আরো কড়া ভাষায় সরকারের সমালোচনা করেন। পাশাপাশি প্রেস ক্লাবে গিয়ে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য) কিংবা অন্য কেউ আরেকবার বক্তৃতা দিয়ে বলেন, আমাদের কথা বলার কোনো অধিকার নাই। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি আলহাজ্ব আলী আব্বাস। ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক নজরুল ইসলামের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সমালোচনাকে সমাদৃত করার সংস্কৃতি লালন করেন মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, টেলিভিশনের টক শোগুলো শুনুন, সেখানে সরকারকে কী ভাষায় সমালোচনা করা হয়। আমরা মনে করি এই সমালোচনা থাকতে হবে। সমালোচনা না থাকলে গণতন্ত্র নষ্ট হয়, গণতন্ত্রের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। গঠনমূলক সমালোচনা হচ্ছে বিউটি অব ডেমোক্রেসি এবং সেই সমালোচনাকে সমাদৃত করার মানসিকতা থাকতে হয়।
তিনি বলেন, আমরা বহুমাত্রিক সমাজব্যবস্থায় বসবাস করি। আমাদের দেশে যেভাবে মানুষ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করতে পারে, অন্য কোনোখানে সেভাবে করা যায় না। যুক্তরাজ্যে কোনো ভুল সংবাদ প্রকাশিত হলে অনেকে আদালতে অভিযোগ করেন এবং অনেক ক্ষেত্রে জরিমানাও গুনতে হয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমালোচনা করার সংস্কৃতিকে পছন্দ করেন। দায়িত্বে থাকলে সমালোচনা সহ্য করতে হবে।
সমালোচনার পাশাপাশি ভালো কাজের প্রশংসা করার আহ্বান জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, যখন ভালো কাজের প্রশংসা হয় না, অহেতুক সমালোচনা হয়, তখন কিন্তু যারা ভালো কাজ করেন তারা হতাশ হন। তখন মানুষ ভালো কাজ করার জন্য উৎসাহিত হন না। অবশ্যই সমালোচনা হবে, সমালোচনা থাকবে। এটির পাশাপাশি ভালো কাজের প্রশংসাও দরকার। না হয় রাষ্ট্র, সমাজ এগোবে না।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, রাত বারোটার পরে যদি টক শো শোনেন, সবগুলো টক শো থেকে যদি উপসংহারে আসেন, তাহলে মনে হবে দেশে কোনো কিছুই হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু বাস্তবতাটা কী? বাস্তবতা হচ্ছে ব্লুমবার্গ করোনা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে বলছে করোনা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবগুলো দেশের উপরে বাংলাদেশের অবস্থান এবং পুরো পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান ২০তম। জনবহুল বাংলাদেশে মানুষের ঘনত্ব পৃথিবীতে সর্বোচ্চ, মাথাপিছু কৃষি জমির পরিমাণ পৃথিবীতে সর্বনিম্ন।
তিনি বলেন, গতকাল যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণা সংস্থার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তারা বলেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর ২৮তম এবং ২০৩৫ সালে পৃথিবীর ২৫তম অর্থনীতির দেশ। পৃথিবীর মাত্র ২২টি দেশ করোনাকালে পজিটিভ জিডিপি গ্রোথ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান উপরের দিকে। এই পরিসংখ্যানগুলো জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। কারণ আশাহীন জাতি এগোতে পারে না। কোনো জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সেই জাতির মধ্যে আশা থাকতে হয়। জাতিকে আশান্বিত করাও আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। এ দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের যেমন, সাংবাদিকদেরও।
তিনি আরো বলেন, কোথাও খারাপ কিছু হলে সেটি ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। অবশ্যই খারাপ সংবাদ হলে সেটি প্রচারিত হবে। সাথে ভালো সংবাদকেও প্রচার করেন।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রকে সঠিকভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম। এটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। রাষ্ট্রের কোনো একটা স্তম্ভ ঠিকমতো কাজ না করলে এর ভিত নষ্ট হয়ে যায়। সেটি মাথায় রেখেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং এর সাথে যাঁরা যুক্ত আছেন তাঁরা যাতে স্বাধীনভাবে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারেন সেজন্য কাজ করছেন। করোনাকালে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলেও সাংবাদিকরা কাজ করে গেছেন। পৃথিবীতে সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হলে একটি মহল ওত পেতে থাকে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করার জন্য। করোনাকালে বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এর বিপরীতে দেশের মূলধারার গণমাধ্যম বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কারণে এসব সুবিধাবাদী তেমন বেশি সুবিধা করতে পারেনি। এ জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের ধন্যবাদ জানাই।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের প্রশংসা করে তিনি বলেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই প্রেস ক্লাবে সব দলমতের মানুষ রয়েছেন। চট্টগ্রামের সব মানুষের কল্যাণে এ প্রেস ক্লাব কাজ করে যাচ্ছে। ঢাকা প্রেস ক্লাবেও দলাদলি ছিল, এখন যে একদম নেই তা নয়। কিন্তু চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে তা নেই। এ জন্য ক্লাবের নেতৃবৃন্দকে ধন্যবাদ জানাই। আমি কলকাতা প্রেস ক্লাবে গিয়েছি। এ জনপদের সবচেয়ে পুরনো প্রেস ক্লাব। সেখানে গিয়ে মন ভালো হলেও ক্লাবের কার্যালয় দেখে হতাশ হয়েছিলাম। টিনের চালাঘর। জায়গায় নিজের মালিকানা নেই। আমি সেসময় প্রশংসা করে বলেছিলাম, আমাদের চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের নিজস্ব ভবন রয়েছে।
সব মানুষের কল্যাণেই চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, সব দলমতের মানুষের প্রয়োজনে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে; এটি থাকা বাঞ্চনীয়। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রাজনীতি থাকতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক দলাদলির ছোঁয়া চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে লাগেনি। এজন্য আমি প্রেস ক্লাবের সকলকে ধন্যবাদ জানাই। সব জায়গায় রাজনীতিকে এনে সেখানে নিজেদের মধ্যে প্রকট বিভাজন তৈরি করাও সমীচিন নয়।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকদের সাথে আমার বহু দিনের জানাশোনা এবং হৃদয়ের সম্পর্ক। আমার হৃদয়ে আপনাদের স্থান সবসময় ছিল এবং থাকবে। আমি আশা করব আপনাদের হৃদয়েও আমাকে স্থান দেবেন-সেই আবেদনটুকু রাখলাম।
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান ও কলিম সরওয়ার, বিএফইউজের সহ-সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ আলী, ক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি সালাহউদ্দিন মো. রেজা বক্তব্য রাখেন।
উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ম. শামসুল ইসলাম, ক্লাবের সহ-সভাপতি মনজুর কাদের মনজু, অর্থ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক, সাংস্কৃতিক সম্পাদক রুপম চক্রবর্তী, ক্রীড়া সম্পাদক দেবাশীষ বড়ুয়া দেবু, গ্রন্থাগার সম্পাদক রাশেদ মাহমুদ, সমাজসেবা ও আপ্যায়ন সম্পাদক আইয়ুব আলী, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মিন্টু চৌধুরী ও কার্যকরী সদস্য স ম ইব্রাহীম।
আলোচনা অনুষ্ঠানে ‘মুজিব জন্মশতবর্ষ’ উপলক্ষে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব কর্তৃক প্রকাশিত বার্ষিকীর বিশেষ সংখ্যা ‘তথ্য সত্য-ভাষ্য’-এর মোড়ক উন্মোচন করেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ। বিকালে বঙ্গবন্ধু হলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের দ্বি-বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। আগামী ৩১ ডিসেম্বর ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।