জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর পর ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ অভিযোগকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলছেন সদ্য সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পাওয়া চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বলেন, আমাকে মুখোমুখি হতে হয়েছে এক অবিশ্বাস্য অভিযোগের– আমি নাকি ফ্যাসিস্টের দোসর! যেই ফ্যাসিস্টকে তাড়ানোর জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালাম ১৬ জুলাই থেকে, অল আউট অ্যাটাকে গেলাম, এটা জেনে যে ফ্যাসিস্ট হাসিনা টিকে গেলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যু অথবা জেল, আমি তারই সহযোগী? খবর বিডিনিউজের।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফারুকী ফেইসবুক পোস্টে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। তিনি এমন সময় এই পোস্ট লিখলেন, যখন তাকে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ আখ্যা দিয়ে কেউ কেউ তাকে উপদেষ্টা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি তুলছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের তিন মাসের মাথায় মুহাম্মদ ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদে আরও তিনজন নতুন সদস্য যোগ দিয়েছেন, তাদের একজন ফারুকী। সমালোচনার মুখে ফারুকী ফেইসবুকে লেখেন, “প্রিয় ভাই–বোনেরা, ঘুণাক্ষরেও যা আগে ভাবি নাই, এখন আমাকে সেটাই করতে হচ্ছে। আমি মাত্রই দুই দিন হলো কাজ করছি। এর মধ্যে আমার ধারণা, আমার মন্ত্রণালয়ে সহকর্মীদের মাঝে এই ধারণা দিতে পেরেছি যে, আমরা কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটাতে চাই, যেটা স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদে আমাদের সংস্কৃতিকর্মীদের কাজে আসবে। যদিও আমি কোনো পদ চাই নাই, তবুও দায়িত্বটা নেয়ার পর আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে করার চেষ্টা করছি।”
ফারুকীর ভাষ্য, শাহবাগ আন্দোলন যখন শুরু হয় আর সবার মত আমিও ভেবেছিলাম এটা নির্দলীয়। যে কারণে আমার সব পোস্টে এটাকে ঠেলে ‘রাষ্ট্র মেরামতে’ এজেন্ডার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পরেই যখন বুঝে যাই, তখনই লিখি ‘কিন্তু এবং যদির খোঁজে’। যে কিন্তু এবং যদি শাহবাগ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো। বাঙালী জাতীয়তাবাদ আর ইসলামকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে আজকের যে ফ্যাসিবাদের সূচনা করা হয়েছিলো তার প্রতিবাদে লিখি, ‘এই চেতনা লইয়া আমরা কি করিবো‘। ২০১৪ সালে।
ফারুকী লিখেছেন, এই দুইটা লেখার যে কোনো একটা লেখা ছাপা হওয়ার পর বিএনপির শিমুল বিশ্বাস সাহেব ফোন দিয়েছিলেন কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। আমি কোনো দল করি না। কিন্তু আমি আওয়ামী লীগ হলে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা আমার লেখায় কি খুঁজে পেলেন যে আমার সাথে পরিচয় না থাকা স্বত্বেও আমার নম্বর জোগাড় করে ফোন দিলেন? অন্তর্বর্তী সরকারে ফারুকীসহ একাধিক উপদেষ্টাকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে তাদের অপসারণের দাবি জানিয়ে সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করেছেন। মানববন্ধনে অংশ নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহসহ কয়েকজন নেতা। এছাড়া ফারুকীকে উপদেষ্টা করায় ‘তীব্র নিন্দা’ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ফেইসবুক পোস্টে ফারুকী বলেন, আমি চেয়ারের জন্য কোনো সাফাই দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। কিন্তু শিল্পী হিসাবে অপমানিত বোধ করেছি বলেই কয়টা কথা বলছি। আমি ঘটনাচক্রে একজন পরিচিত মুখ, ভাই ও বোনেরা। একজন লেখক যতোটা স্বাধীনভাবে লিখতে পারেন, ফ্যাসিবাদেরকালে আমার সেই স্বাধীনতা পাওয়ার সুযোগ ছিলো না। তার মধ্যেও যতোটুকু করেছি তার ফলও আমাকে ভোগ করতে হয়েছে।”
২০১৫ সালে সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন সেলের হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে বলেও জানান ফারুকী। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে ‘সিমপ্যাথি পাওয়ার ইচ্ছা এবং প্রয়োজন নাই’ বলেও জানান তিনি। আমি এখন দেখতে পাচ্ছি অনেকে ছাত্রলীগ এবং শাহবাগ করে আমাকেই বলছে ‘তুমি আওয়ামী লীগ’! হায় সেলুকাস। একেই বলে বোধ হয় প্রোপাগান্ডার সাদা–কালো রাজনীতি।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, অনেকে বলছে, আমি ভারতীয় হেজেমনির অংশ। যে লোককে বাংলাদেশের কালচারাল এস্টাবলিশমেন্ট ঘৃণা করে আমি কোলকাতা কেন্দ্রিক ভাষার হেজেমনি ভেঙ্গে দিয়েছি বলে, সেই কি না এই হেজেমনির অংশ! আমি পৃথিবীর কোনো দেশেরই ঢালাও নিন্দা করি না। কারণ দেশে নানা চিন্তার মানুষ থাকে। আমি সবার সাথেই কথা বলতে চাই, কাজ করতে চাই। কিন্তু আমার দেশের ক্ষতি হলে, আমি তার বিরুদ্ধে বলতে কুন্ঠা করি না। ২০১৩ সালে সীমান্তে ফেলানী হত্যার পরও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বলে জানান ফারুকী।
সেসময়ের একটি পোস্টের স্ক্রিনশট ফেইসবুকে শেয়ার করে ফারুকী বলেন, ফেলানীর মৃত্যুর পর কি পোস্ট দিয়েছিলাম ২০১৩ সালে সেটা দেখতে পারেন নীচে। আমার অবস্থানের উপহার হিসাবে ভারতীয় হাই কমিশনে একসময় কর্মরত রঞ্জন মন্ডল নামের এক কর্মকর্তা তার ফেসবুকে পাবলিক পোস্ট দিয়ে বহুবার কি অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করেছিলো সেটা খোঁজ করে দেখুন। আর সেই আমি পার্ট অব হেজেমনি? আমরা এক অনন্ত ভয়ের ঘরে বাস করে এসেছি। আমরা কথা বলতে ভয় পেতাম। এমন কি কথা বলার সময় ঘরে ফোন থাকলে সরিয়ে ফেলতাম। পাছে আড়ি পাতে। আওয়ামী লীগের মেয়াদে গোপনে সরকার পতনের ব্যাপারে পরামর্শ করার কথাও উল্লেখ করেন ফারুকী।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ভাষ্য, আমার মনে আছে ২০১২ সালে শুধুমাত্র কথা বলার জন্য আমি আর ‘আরিফ আর হোসাইন’ লুকিয়ে আমেরিকান ক্লাবে গিয়ে বসে আলাপ করতাম কিভাবে এই জালিম সরকারকে হটানো যায়। বিএনপি এবং জামায়াত কিছু করতে পারবে? আর্মির মনোভাব কি? জোনায়েদ সাকির সাথে বাটন ফোনে কথা বলে গোপনে দেখা করতাম আর পরামর্শ করতাম কি করা যায়। সেই আমি আওয়ামী ফ্যাসিজমের পার্ট? ফারুকী চান, সবাই তাকে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও মনে রাখুক। দেশকে কিছু দেওয়ার তাগিদ থেকেই তিনি উপদেষ্টা হয়েছেন বলেও জানান। ফারুকী বলেন, আমি তো কোনো বিপ্লবী নই। ছিলাম না কোনো কালে। আমি ফিল্মমেকার ঘটনাচক্রে এবং আল্লাহর রহমতে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমি আমার সেই পরিচয়েই গর্বিত। আমি মারা গেলে আমাকে ফিল্মমেকার হিসাবেই মনে রাখা হবে, মন্ত্রী হিসাবে না। ফলে মন্ত্রীত্ব আমার কাছে কোনো অর্জন না, পাবলিক সারভেন্টের দায়িত্ব মাত্র। আমি এটা ফাইনালি অ্যাকসেপ্ট করেছি নিজের ফিল্মের বাইরেও আমার দেশকে কিছু দেয়ার ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছে– এটা বিশ্বাস করেছি বলে। আমার মনে হয়েছে, জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজের লাভ–ক্ষতি না ভেবে এই ক্ষমতা দেশের কাজে লাগাই। লাস্টলি, আই অ্যাম লাভিং মাই জব। বাট আই অ্যাম হেইটিং দ্য ফ্যাক্ট দ্যাট আই হ্যাড টু রাইট দিস।