১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়াসহ দুই দেশের অমীমাংসিত ইস্যু সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং সফররত পাকিস্তানের উপ–প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার গতকাল রোববার সকালে ঢাকার একটি হোটেলে বৈঠক করেন।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং পাকিস্তানের উপ–প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং অভিন্ন স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে সহযোগিতামূলক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো গভীর করার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। খবর বাংলানিউজের।
অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান দুইবার হয়েছে : বিডিনিউজ জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের অমীমাংসিত ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর সমাধান একবার নয়, দুবার হয়েছে বলে দাবি করেছেন দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। গতকাল ঢাকায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি এ দাবি করেন।
গত এপ্রিলে ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানকে। একাত্তরে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা এবং প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পাওনা পরিশোধের বিষয়টি তখন আলোচনায় তোলা হয়েছিল।
সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, এই ইস্যুটির সমাধান আসলে দুইবার হয়েছে। একবার ১৯৭৪ সালে, আবার ২০০০–এর শুরুর দিকে, যখন জেনারেল (পারভেজ) মুশাররফ এখানে এসেছিলেন। তিনি গোটা পাকিস্তান জাতির পক্ষ থেকে গোটা বাংলাদেশ জাতির উদ্দেশ্যে কথাটা বলেছিলেন।
তিনি বলেন, অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে আপনার প্রশ্ন, দেখুন, প্রিয় ভাই, ১৯৭৪ সালে ইস্যুটি লিখিতভাবে সমাধান হয়েছে। এই ডকুমেন্টটি ঐতিহাসিক এবং দুই দেশের কাছেই আছে। আর তারপর, যখন জেনারেল মোশাররফ এখানে এসেছিলেন; খুব খোলামেলা এবং অকপটে তিনি এই ইস্যুটি তুলে ধরেছিলেন। এবং আমি মনে করি, পরিবারের মধ্যে, দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো কিছুর একবার সমাধান হলে, সেটা হয়ে গেছে।
১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ৩০ লাখ মানুষ নিহত এবং ৩ লাখ নারী ধর্ষিত হওয়ার ঘটনায় পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। অর্ধ শতক পরও পাকিস্তান ৩০ লাখ মানুষ হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেনি, রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমাও চায়নি। ২০০২ সালে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররফ বাংলাদেশ সফরে এসে ওই ভূমিকার জন্য সাধারণভাবে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছিলেন কেবল।
দুই দেশের এক সঙ্গে কাজ করার বিপুল সম্ভাবনা আছে মন্তব্য করে ইসহাক দার বলেন, দুই দেশের মানুষের জন্য আরো ভালো কিছু করার জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই। এটাতেই আমাদের ঐকমত্য এবং আমরা সেটাই করছি।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আমরা বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিনিয়োগ এবং নিরাপত্তা প্রতিরক্ষায় একযোগে কাজ করাসহ পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছু। আপনাদের সঙ্গে আমাদের ঐকমত্য আছে, আমাদের মতামতে কোনো ভিন্নতা ছিল না। যা খুবই ভালো বিষয়।
পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে একমত নয় বাংলাদেশ : বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান দুইবার হয়ে যাওয়ার যে দাবি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার করেছেন, তার সঙ্গে একমত না হওয়ার কথা বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, আমি অবশ্যই একমত না। একমত হলে তো সমস্যাটা সমাধান হয়ে যেত তাদের মতো করে, তাই না? আমি তো বললাম আপনাকে যে, আমরা আমাদের অবস্থানটা বলেছি, উনারা উনাদের অবস্থানটা বলেছেন।
দুদেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের আলোচনায় একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা, প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পাওনা পরিশোধ এবং আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরানোর অমীমাংসিত বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আপনারা নিশ্চয় প্রত্যাশা করেন না যে ৫৪ বছরের সমস্যা, আজকের একদিনের মিটিংয়ে, যে মিটিংটা কত বছর, ১২–১৩ বছর পরে, ১৩ বছর পরে এবং তাও কিন্তু পূর্ববর্তী হিনা রব্বানী খারের মিটিং কিছু একটা দাওয়াত দেওয়ার জন্য, দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল না। কাজেই এখানে বসে এক ঘণ্টায় আমরা এটা সমাধান করে ফেলতে পারব, এটা আপনারা নিশ্চয় আশা করবেন না। কেউই আশা করবে না। আমরা পরস্পরের অবস্থানটা তুলে ধরেছি।
অমীমাংসিত তিন বিষয় সমাধানে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করার বিষয়ে একমত হওয়ার কথা তুলে ধরে তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা তিনটি বিষয়ে কিন্তু নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছি। দুই পক্ষই একটি বিষয় আমরা ঠিক করেছি যে, এই জিনিসগুলোকে আমাদেরকে সমাধান করতে হবে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে যাতে খুব স্মুদলি এগোতে পারে এজন্য এদেরকে পিছনে ফেলতে হবে। এবং দুই পক্ষই এটুকু এগ্রি করেছি যে, আমরা এ নিয়ে কথা বলব এবং চেষ্টা করব এই ইস্যুগুলি যেন আগামীতে বা কোনো এক পর্যায়ে, একদিনে হয়ে যাবে না।
তিনি বলেন, আমরা একমত হয়েছি যে, আমরা এটা নিয়ে কথা বলব আলাদাভাবে, এমনভাবে, যাতে করে এই জিনিসগুলোকে আমরা ফেলতে পারি। এছাড়া আমরা পরস্পর নিজেদের যে অবস্থানগুলো, সেগুলো ব্যক্ত করেছি। অমীমাংসিত বিষয়ে দুই দেশের অবস্থান একই রকম কিনা, এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, আনরিজলভড ইস্যুতে দুই দেশে তাদের নিজেদের অবস্থানটাই পুনর্ব্যক্ত করেছে। তাহলে পাকিস্তান নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে একমত–এটা বলা যাবে কিনা, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, না। আপনি এটা বলতে পারেন না। কারণ আমি কি বলেছি, ডোন্ট পুট ওয়ার্ডস ইন মাই মাউথ। সেটা হলো যে, আমি বলেছি যে, নিজ নিজ অবস্থান ব্যক্ত করেছি। শুধু একটি অগ্রগতি মনে করি আমি, ছোট্ট একটু, সেটা হলো যে, আমরা দুই পক্ষ একমত হয়েছি যে এই বিষয়গুলো আলোচনা করে সমাধান করা প্রয়োজন, যাতে করে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এগুলো বাধা হয়ে না আসে। না দুই পক্ষ এ ব্যাপারেও একমত হয়েছি যে, আমরা একদিনে বসে এটা সমাধান করে ফেলতে পারব না।
চীন ত্রিপক্ষীয় যে প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগ নিয়েছে, সে কারণে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ধারাবাহিক বৈঠকগুলো হচ্ছে কিনা–এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে ‘না’। চীনের ওই উদ্যোগে তিন দেশের মধ্যে না রেখে পরিসর বাড়ানোর প্রস্তাব বাংলাদেশের দিক থেকে দেওয়ার কথা তুলে ধরে তৌহিদ হোসেন বলেন, এটা খুব সহজভাবে আমি আপনাদেরকে আগেও বলেছি; সেটা হলো পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক গত সরকারের আমলে, ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক চাই পাকিস্তানের সাথে, যেমন আমরা অন্যান্য বন্ধু দেশের সাথে চাই। ঠিক সেরকমই, এর চেয়ে বেশি কিছু না। তিনি বলেন, বেশি কিছু না মানে কি, আমাদের তো ব্যবসা–বাণিজ্য থেকে শুরু করে সবদিকেই কথাবার্তা বলতে হবে, সেই হিসাবে সম্পর্কটা এগোচ্ছে। এটা ত্রিপক্ষীয় আলোচনার কারণে এগোচ্ছে অথবা সেটার কারণে এটা এগিয়ে যাচ্ছে সেটা কিন্তু মোটেই বিষয় না।
তিনটি বিষয়ে তুলে ধরার পর পাকিস্তান কী অবস্থান জানিয়েছে–এমন প্রশ্নে তৌহিদ হোসেন বলেন, তাদের অবস্থান তাদেরকে যেটুকু জিজ্ঞেস করেছেন, তারা বলেছে, ওটুকুই। আমি সেটা কিছু বলতে চাই না। বাংলাদেশের অবস্থানটা কী? এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের অবস্থান খুব স্পষ্ট। আমরা চাই যে, হিসাবপত্র হোক এবং আমাদের টাকাপয়সার যে ব্যাপার সেটা সমাধান হোক। আমরা চাই যে এই যে এখানে গণহত্যা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে তারা দুঃখ প্রকাশ করুক, মাফ চাক এবং আমরা চাই যে, যে আটকে পড়া মানুষগুলি আছে, তাদেরকে তারা ফেরত নিক।
আটকে পড়া মানুষদের ব্যাপারে অভ্যন্তরীণভাবে কিছু তথ্যের মুখোমুখি হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেটা হচ্ছে যে, আমাদের একটি হাই কোর্টের রায় আছে। এটা নিয়ে কিন্তু এখানে যারা হিউম্যান রাইটস নিয়ে কাজ করেন, তারা কিন্তু এটা নিয়ে বলছেন। এটা তার প্রেক্ষিতে দেখতে হবে আমাদের। তো এটা নিয়ে আগামী দিনগুলোতে হয়ত আমরা বসব। ইন্টারনালি বসে সমস্যাটা সমাধান করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে বিষয়টা এখনো (অমীমাংসিত)।
বৈঠকে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কিনা, এ প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, এ ধরনের স্পেসিফিকে আপনার না যাওয়া উচিত এখন। যেহেতু, আমি তো বলেছি যে, আমরা আমাদের অবস্থানটাকে তুলে ধরেছি। এটা আমার উপরে ছেড়ে দিন, এটুকু বিশ্বাস করেন যে, আমি বাংলাদেশের অবস্থান খুব শক্তভাবে ব্যক্ত করেছি।