একটি ভিন্ন মেজাজের বই হাতে এসেছে। লেখক অটোগ্রাফ দিয়ে সৌজন্য–সংখ্যা দিলেন। ‘বিচিত্রা ভাবনা চিত্রিত লেখা।’ গ্রন্থের লেখক: শেখ মুজিব আহমেদ। এটি একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ, এবং ভিন্ন মাত্রা, ভিন্ন আবহে, অনেকটা কাটছাঁট ও রূঢ় বয়ান। একটু ব্যতিক্রম তো বটেই; গ্রন্থে ২২টি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধগুলো গদ্য কবিতার আঙ্গিক। তবে দু–একটি প্রবন্ধ ব্যতিক্রম–যে নেই তা বলবো না, যা নিমেষে শেষ করা যায়। কিন্তু যা ভেবেছি তা কোনোভাবে সঠিক না; প্রতিটি প্রবন্ধ ভাবনায় নতুনমাত্রা স্থাপন করে। এরপরও ঘোর কাটে না, মনে হয় কোথায় একটা খটকা বা হোঁচট খাওয়া, যা কিনা পরতে পরতে একটি লক্ষ্যে ছুটে চলা।
গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও প্রফেসার ড. অনুপম সেন। সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় ড. সেন লিখেন, খুব অল্প কথায় গ্রন্থের লেখক শেখ মুজিব আহমেদ বড় বড় বিষয়কে তুলে ধরেছেন। তিনি অকপটে আরেকটি অমিয় উক্তি করেন ‘আজ একটা সত্য সকলে উপলব্ধি করা প্রয়োজন, আমরা নিজেদের গরিব ভেবে ভিক্ষা করার মানসিকতাকে ধারণ করি, এর ফলে আমাদের উজ্জ্বল সম্ভবনাকে হেলা–ফেলায় অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
‘LNG আমদানী করে বিদ্যুৎ উৎপাদন’ প্রবন্ধটি একটি পাঠ পর্যালোচনা এবং আইন পরিষদের নাতিদীর্ঘ ভাষণ LNG. based power plant প্রকল্প দূষণমুক্ত, পরিবেশ বান্ধব এবং টেকসই জ্বালানী উৎস, এবং গড়ে LNG কম ব্যয়বহুল, ডিজেল অপেক্ষা CNG চল্লিশ শতাংশ সস্তা। এ ব্যবহারে গ্রীন হাউস গ্যাস Emissions ত্রিরিশ শতাংশেরও কম।
‘মহেশখালী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প…’ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালে। ব্যয়ের একটি অংশ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রয়মূল্য খাত হতে প্রাপ্ত .০৩ শতাংশ। যা বছরে ১৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পের ব্যয় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার।
‘পোলারাইজেশন নয়, সিভিল গভর্নমেন্ট…’ প্রবন্ধের সারকথা রাষ্ট্রের অভীষ্ট লক্ষ্য হলো– প্রধানত নিজের নিরাপত্তা (Self dependent), দ্বিতীয়– রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুশাসন নিশ্চিত করা, তৃতীয়–অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ এবং জনগণের মৌলিক চাহিদার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকে বহুমাত্রিক কাজ করা।
গ্রন্থের লেখক ‘বাংলাদেশ ও ইউরেনিয়াম (Uranium) সমৃদ্ধ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করে বলেন, সৌভাগ্য হয় ভারতের এক পারমাণবিক বিজ্ঞানির সাক্ষাৎ হয়। ওই বিজ্ঞানি ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে ইউরেনিয়াম সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বিজ্ঞানি বলেছেন, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল খনিক সম্পদ সমৃদ্ধ। কেন আমরা তা উত্তোলন করি না। পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাহানি সম্পর্ক বলেন, আন্তর্জাতিক একটি উদ্দেশে– এতদ্ব্অঞ্চলে অস্ত্র ও যুদ্ধে জন্য অর্থ যুগিয়েছিল। অথচ ১৯৯৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি হয়।
‘অমর্ত্য সেনের দারিদ্র ভাবনা’ প্রবন্ধে– ‘অমর্ত্য সেনের কৌশলপত্র সামাজিক অন্তর্নিহিত উচ্চারণ, যা দারিদ্র্যমুক্তি অনন্য সনদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।’ এ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, দারিদ্র নির্মূলে প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে সমাজে নিম্ন মধ্যবিত্ত ক্রমে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে অগ্রসর হয়।
‘সকল আঞ্চলিক ভাষা সাংবিধানিক স্বীকৃতি বিবেচনা–দাবি রাখে’ প্রবন্ধে, চাটগাঁইয়্যা সমাজবির্বতনে বিহুবিধ বর্ণ হতে ভিন্ন–ভিন্ন ধর্ম নিয়ে গড়িত সমাজব্যবস্থা রেঙ্গুন বা বার্মা থেকে আসা বার্মাইয়্যা ভাষা। আজকের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তাদের একাংশ। সপ্তদশ শতকে গৌড়ীয় সুলতান– পর্তুগিজদের আগমনের একটি পদচিহ্ন বহন করে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজার। চট্টগ্রাম নামটি সরকারি দলিলে প্রচলিতছিল ইসলামাবাদ, যা ১৬৬৬ সালে মুঘল সম্রাট সুবাদার শায়েস্তা খান রেখেছিলেন। স্থানীয়ভাবে ইসলামাবাদের আটপৌড়ে নাম চাটগাঁও। চাটগাঁওয়ের সংস্কৃতি উচ্চারণ– চট্টগ্রাম। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে থেকে তা শুরু হয়। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করে চট্টগ্রাম জয় করে।
পাল রাজবংশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৫৩–৯৫৭ খ্রি.। পাল রাজাদের শাসনামলে পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দরকে সমন্দর নামে চিনতো। তখন ধর্মপাল ও দেবপালের শাসন ছিল। ইতিহাসবেত্তা ড. নলিনীকান্ত ভট্টাচার্য প্লিনির পেরিপ্লাসের ক্রিসকে চট্টগ্রামের দ্বীপ সন্দ্বীপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এভাবে আরো ঐতিহাসিকদের একাধিক দলিল ও তথ্য–উপাত্ত রয়েছে।
পরিচয়: তিনি রাজনৈতিক সচেতন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ‘বাবা’ প্রবন্ধে তিনি স্মৃতিকাতর এবং আবেগআপ্লুত। বাবা আলহাজ্ব শেখ জমির আহমেদ, মাতা– ফরিদা খাতুন। জন্ম ১০ জানুয়ারি– ১৯৭২, চট্টগ্রামের পাহাড়তলির হাজিপাড়া। এবং তিনি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। গ্রন্থটি প্রকাশিত ২০১৫, বলাকা প্রকাশন চট্টগ্রাম থেকে। ৭৬ পৃ.-এ প্রবন্ধগ্রন্থে লেখকের মুন্সিয়ানা প্রকাশ পায়। আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়া প্রবন্ধগুলোও তথ্যসমৃদ্ধ, যা বোদ্ধাপাঠককে উজ্জীবিত করবে। সর্বশেষ বলতে হয়, লেখক গ্রন্থটি লিখে নিজেই ইতিহাস হয়ে গেলেন এবং অবশ্যই–এজন্য প্রশংসার দাবিদার।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।