যে কোনও মৃত্যুই কষ্টের। প্রিয়জনের বিয়োগজনিত ব্যথার চেয়ে বড় শোক আর নেই। প্রিয়জনের মৃত্যু মানুষকে চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। কাছের মানুষ চলে যাওয়ার পর যে শূন্যতা চেপে ধরে, তার ভার স্বাভাবিকভাবে বহন করার শক্তি কম মানুষেরই আছে। আর তা যদি হয় পরিবারের সকলের ভীষণ আদর আর শৈশবের স্বাভাবিক দুরন্তপনায় এদিক ওদিক ছুটোছুটি করা সবচেয়ে ছোট শিশু বাচ্চাটির হঠাৎ হারিয়ে গিয়ে দিন কয়েক পর বাড়ির পাশের একটুখানি দূরে শ্যাওলাময় নালায় নিস্তেজ বস্তাবন্দি বিভৎস লাশ হয়ে ভেসে উঠা অথবা শুনতে পাওয়া শিশুটির কোনও পরিচিতজনই শিশুটিকে খণ্ড বিখণ্ড করে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছে সাগরে! এমন দৃশ্য নিজের শিশু সন্তানকে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করতেই শরীর হিম হয়ে আসে, সবকিছুকেই অসাড় মনে হয়। কিন্তু, আমাদের ভাবতে বা অনুভব করতে ভীষণ কষ্ট হলেও বিগত কয়েকদিনের ব্যবধানে চট্টগ্রামে এমন কিছু নির্মম মৃত্যুই হয়েছে জামালখানের সাত বছরের শিশু বর্ষা আর ইপিজেড থানাধীন বন্দরটিলা এলাকার পাঁচ বছরের শিশু আয়াতের সাথে।
ভাবতেই ভীষণ খারাপ লাগছে, শিশু বর্ষা বা আয়াত তাদের ছোট্ট নরম হাতখানা দিয়ে আর কখনোই বাবার গলা জড়িয়ে ধরবে না, তাদের মাকে আর বিরক্ত করবে না কোলে উঠবে বলে, বাসায় এলে বাবার পিঠে উঠে বাবাকে কল্পনার ঘোড়া বানাবে না, মায়ের কাজের ফাঁকে মা‘ বলে আর ডাকবে না, ঘরময় আর কখনোই ছুটোছুটি হুল্লোড় করে পুরো বাসাকে আনন্দ–উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে রাখবে না কারণ, শিশু বর্ষা এবং আয়াত এই সবকিছুর উর্ধ্বে চলে গেছে! কিন্তু, যারা বেঁচে আছে, সেইসব শিশুরা কতটুকু নিরাপদ ঘুণে ধরা এই সমাজে?
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্জনও অনেক। কিন্তু, সব কিছুর মূলে যে সমাজ সে সমাজের মূল্যবোধ, আদর্শ আর নীতি– নৈতিকতার ক্ষেত্রে কতটুকু এগুতে পেরেছি আমরা? মাঝে মাঝেই আমরা বুঝতে পারি এবং উপর বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনার বাস্তবতায় উপলব্ধি করি, আমাদের চিন্তার জড়তা, নীতিহীন কদর্য মানসিকতা, মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাব এখনও আমাদের পিছু ছাড়ছে না। আমাদের মনে রাখা উচিত, উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে এগুলেও সমাজের জ্বরা কাটবেনা যদি সমাজের একটা বিরাট অংশ নৈতিক চরিত্র এবং সামাজিক নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে চরম দীনতার মধ্যে দিনাতিপাত করে।
মানুষের মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ু বাড়লেই বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার হার, প্রাথমিকে ঝরে পড়া হ্রাস বা প্রায় শতভাগ পাসের সমাজই একটি আলোকিত ও সপ্রাণ সমাজ নয়। ইদানীংকালে আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা–দুর্ঘটনায় আমরা বুঝতে পারছি, একটি সুস্থ, সুন্দর, সজীব ও প্রাণবন্ত সমাজের জন্য যে মানবিক ও সহনশীল শিক্ষা তৈরি করা প্রয়োজন সে রকম মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা আমরা আদৌ নাগরিকদের মাঝে ছড়াতে পারিনি। যে কোনও নাগরিক সমাজের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে নাগরিকের তিনটি অন্তর্নিহিত শক্তির ভূমিকাই মূখ্য বলে মনে করা হয়। সেগুলো হচ্ছে, নাগরিকের কল্পনাশক্তি, তাঁর চিন্তাশক্তি ও নাগরিকের সৃজনশীলতা। আর এসব দক্ষতার উত্তরণ ও উন্নয়নের বিকাশ ঘটে ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে। তখন অবশ্য মানুষের আরেকটি দক্ষতাও অর্জিত হয় তা হলো মানুষের মননশীলতা। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্যি, এগিয়ে যাওয়ার আর বিকশিত হওয়ার উপরে উল্লেখিত উপাদানগুলো আমাদের সমাজে প্রবলভাবেই অনুপস্থিত। একটি ভালো ও বিকশিত সমাজ এগোয় প্রতিনিয়ত বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব সমাধান করে, তাকে এড়িয়ে বা নিস্তব্ধ করে নয়। তখন সমাজের উন্নাসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, নীরব–সরব ও পিছিয়ে পড়া নাগরিকও ধীরে ধীরে তাঁদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে বুঝতে পারে। আমার মনে হয়, আমাদের সমাজেও এমন ঘটতে পারে, যদি আমরা বর্তমানের এই অস্থির ও জ্বরাগ্রস্ত সময়টাকে উপলব্ধি করতে পারি।
আমাদের সমাজের জ্বরা টের পাওয়া যায় যখন আমরা দেখি একজন শিক্ষার্থী তার নিজ শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করেন না, ডাকাতি পরবর্তীতে নৃশংস শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরে থানায় গিয়েও ভুক্তভোগী নারীরা সহমর্মিতার বদলে হয়রানির শিকার হয় আর আমরাও আগে নিজে বাঁচি ভাব নিয়ে চুপ করে রই! দেখা যায় সামান্য কথা কাটাকাটিতে বা একটু স্বার্থে আঘাত লাগলেই বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন! তবে সবকিছু ছাপিয়ে ইদানীংকালের কিশোর অপরাধ আমাদের সকলেরই আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুল–কলেজ পড়ুয়া শিশু–কিশোররা সামান্য কারণে মারামারি এমনকি খুনোখুনিতেও জড়িয়ে পড়ছে। পাড়া মহল্লা ভিত্তিক কিশোরদের গ্রুপিং এখন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই বয়সেই তাদের অনেকেই নাকি রাজনীতির এলাকাভিত্তিক সরকারদলীয় বিভিন্ন ছাত্র ও যুব নেতাদের আশীর্বাদ নিয়ে চলাফেরা করে! যদিও এইরকম কিশোর অপরাধ বিগত দিনেও ছিল, কিন্তু তা ছিল কদাচিৎ আর অনেকটাই রাজনীতির বিষমুক্ত। এখনতো পুরো ব্যাপারটাই ভয়াবহ আকার নিয়েছে। আমাদের সন্তান পরিণত বা পরিচ্ছন্ন স্বভাবের সেটাই বড় কথা নয়, সন্তান কার সাথে বা কিভাবে সময় কাটাচ্ছে সেটা দেখাও গুরুত্বপূর্ণ।
এ সূত্রে রবীন্দ্রনাথের একটি কথা মনে পড়ে যায়, তিনি বলেছেন, সবকিছুরই যেমন একটা আধার থাকে, সেরকম শিক্ষার আধার হল সংস্কৃতি। কিন্তু, আমাদের পরীক্ষানির্ভর শিক্ষায় সংস্কৃতির মেলবন্ধন কই? মানবিকতা, কীর্তিকথা, মনিষীকথা, গল্পকথা, সংগ্রহ আজ আমাদের কারও কারও কাছে শুধুই সময়ের অপচয়! তাই সমাজের জ্বরা কাটাতে হলে প্রথমে আমাদের এই সর্বনাশা পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা হতে বের হতে হবে, সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে হবে শিক্ষায়।
সমাজের এই জ্বরা কাটাতে হলে আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের পারিবারিক আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় গলদটা কোথায়? কেন আমাদের মূল্যবোধের সংকট, আদর্শের অনটন, সৃজনশীলতা আর সংবেদনশীলতার অভাব? কেন আমরা প্রকৃত মানুষ‘ হতে পারছি না? তবে, দিনশেষে আমরা আশাবাদী মানুষ। আমরা স্বপ্ন দেখি, আমাদের উদ্যমী ও সাহসী তারুণ্যের জোরে সমাজের এই জ্বরা‘র হবে অবসান। সেই সাথে প্রার্থনা করি, বর্ষা এবং আয়াতের পরিবার যেন এই ভীষণ শোকের সময় তা সহ্য করার শক্তি আর ধৈর্য ধারণ করতে পারে এবং আশা করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এ জাতীয় সব ঘটনায় দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হবেন।
লেখক: বিতার্কিক ও কলাম লেখক।