সমাজের অবক্ষয়, মুরব্বিয়ানার বিপর্যয় ও প্রাসঙ্গিক কথা

মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান | মঙ্গলবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

আমার ছোট ছেলের নাম ‘আদিবুর রহমান’। সে তখন সেন্টমেরীস স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে পড়ে। এক দুপুরে খাওয়ার টেবিলে সে তার মাকে চোখে চোখে কি যেন বলছিল। বাচ্চাদের চোখ দেখে তার ভাব বোঝা মায়েদেরই কাজ। আমি কৌতূহলী হয়ে ব্যাপার কী জানতে চাইলাম। আমার স্ত্রী হেসে বললেন- আজকে সে স্কুলে বকা খেয়েছে। বিস্তারিত জানতে চাইলে প্রায় ভয়ার্ত চোখে সে-ই (আদিব) বলা শুরু করল। ঘটনাটা ছিল এরকম – এক ছেলে সামনের দিকের একটা টুলে প্রায় নিয়মিত বসত। সেদিন সে দেরীতে স্কুলে এসেছে। এই সুযোগে অন্য একজন ছেলে ঐ সিটে বসে পড়ে। বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার পর দেরিতে আসা ছেলেটি তার মাকে তার সিট হারানোর কথা বলল। মা-জননী সিট দখল করে নেয়া ছেলেটিকে তালাশ করে বকা দিচ্ছিল। যেমন – “তুমি আমার ছেলের সিটে বসেছ কেন; তুমি তো জান এটা অন্যের সিট; আর কোন দিন এই কাজ করবে না; এ রকম করলে টিচারদেরকে দিয়ে তোমাকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেব।” আদিব এবং তার অন্য একবন্ধু এসব কথা শুনছিল। এবার আদিব সামনে গিয়ে ভদ্র মহিলাকে বলল – “আন্টি, আমাদের ক্লাসের নিয়ম হলো – আমরা যে আগে আসি সেই সামনের টুলে বসি; পরে আসলে তাকে পেছনের টুলে বসতে হয়; এটা সবার জন্য, টিচাররা আমাদেরকে ওভাবে বসতে বলেন।” একথা শুনে ভদ্র মহিলা তাকে (আদিবকে) ধমক দিয়ে বলেন- “তুমি কেন এখানে মাথা ঘামাচ্ছ; তোমাকে কে ডেকেছে; যাও এখান থেকে।” তখন আদিব ও তার বন্ধুটি অন্যত্র সরে গেল। আমাকে ঘটনা বলার সময় সে বলল- “খুব গরম মহিলা বাজি (বাবাজি), কোন নিয়মকানুন মানতে চায় না, এই রকম আরো অনেক মহিলাকে দেখেছি সামনের টুলে বসতে না পারলে স্কুলের মাঠেই বাচ্চাকে ধরে পিটায়; দাঁত কিড়মিড় করে; পরীক্ষায় লিখতে না পারলেও ওরকম খোলামাঠে বকাঝকা করে।”
আমি তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলাম, কিছু প্রয়োজনীয় মন্তব্য করার একান্ত ইচ্ছা থাকলেও তা করলাম না। কারণ এখানে সত্য ও ন্যায় মন্তব্য করতে গেলে, আমার ছেলে আমার কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়ে যেতে পারে। তার কাজের প্রতি আমার যে নৈতিক সম্মতি তা পরিমাণ মত ব্যবহার করতে জানার বয়স তখনো তার হয়নি। কিন্তু দুঃখবোধ হয়, আমরা বয়স্করা, শিক্ষিতরা ছোট ছোট কোমলমতি শিশুদের কাছে এভাবে হেরে গেলে আমাদের মুরব্বীয়ানা টিকে থাকবে কিভাবে। আর মুরব্বীয়ানার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হলে পরবর্তি প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় বা অনুসরণীয় কোন আচরণ সমাজে থাকবে না। তা যদি হয়ে থাকে তবে মানুষকে সমাজবদ্ধ জীব বলার দরকারই বা কি।
১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে আমি যে বাসায় থাকতাম ঐ মহল্লায় একদিন শান্তি শৃংখলা নিয়ে মিটিং হচ্ছিল। শুধু বাড়ির মালিকেরাই এতে যোগদান করবেন। মহল্লা কমিটির চেয়ারম্যান মিটিং-এ আসার সময় আমার সাথে দেখা হয়। তার সাথে আমার পূর্ব থেকে ঘনিষ্ঠ পরিচয়। বয়স্ক লোক, ওজস্বী চেহারা ও গজগতি সম্পন্ন। আমাকে দেখেই হাত ধরে আলোচনাস্থলে নিয়ে গেলেন। আমিও না বলার সুযোগ পেলাম না। আমার মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও আমাকে বসিয়ে আলোচনা শুরু হল। এলাকার সবাই এক ছাদের উপর বসে প্রায় রুদ্ধদ্বারে আলোচনা হচ্ছিল। খোলামেলা আলোচনা। কার ছেলে কি রকম আপত্তিজনক চলাফেরা করে, কারা কারা এসবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে, আবার কারা অন্যায় কাজে উস্‌কানিমূলক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে যায়, কারা ভাড়াটিয়াকে পানি না দিয়ে কষ্ট দেয়, কারা ভাড়াটিয়ার সাথে অশোভন আচরণ করে ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক আলোচনা, আমি খুব উপভোগ করছিলাম (উল্লেখ্য, আমার বাড়িওয়ালা উচ্চ শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত খুবই সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন)। বাড়িওয়ালাদের মিটিং হওয়ায় আলোচনায় আমার অংশ নেয়ার কথা ছিল না। থাকলেও আমি করতাম না। তবু হঠাৎ একবার ৩/৪ জন আমাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলে আমি বিনয়ের সঙ্গে ‘না’ করেছি।
সবাই যার যার কথা বলার পর কয়েকজন ইশারা-ইঙ্গিতে একটু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এই জাতীয় মিটিং আমি আগে কখনও দেখিনি। তাই আমার জন্যই তারা বিব্রত বোধ করছে কিনা এই ভেবে উঠতে চাইলাম। কিন্তু সভাপতি সাহেব আমাকে উঠতে দিলেন না। অগত্যা বসে থাকলাম। এলাকার এক বয়স্ক লোক সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনাকে ওনারা কিছু বলতে চাচ্ছেন। সভাপতি সাগ্রহে তাদের বলার অনুমতি দিলেন। তারা সভাপতির এক ছেলের ব্যাপারে আপত্তি বা অভিযোগ তুলল। তার বেশ কিছু অপকর্মের কথা বলা হল। খেয়াল করলাম, খুব সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, সুযোগ যখন পেয়েছেন একেবারে পুঁথির আকারেই কয়েকজন বলা শুরু করলেন, আর সবাইকেও খুব উৎসাহী মনে হল। আমি সাংঘাতিক বিব্রতাবস্থায় পড়লাম। শেষ পর্যন্ত আমার সেই মহানুভব হোস্টের বিরুদ্ধেই কিনা এই অভিযোগ।
তিনি চেয়ারে একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। আর বললেন, আসলে আমার ছেলেটা একেবারে পাগল। বুঝেন না, আমার এত সম্পদ থাকা অবস্থায়ও সে পথে পথে ঘুরে। তাকে পাড়ার হারামজাদা ছেলেরা উস্কানি দেয়, আর সে একটু দুষ্টামী করে। কিন্তু দেখছেন গত কিছুদিন থেকে সে এসব আর করে না। তার জন্য জমিদার পরিবারের মেয়েকে বউ করে এনেছি। সে আর এদিকে আসবে না। আমি বলে দেব। কে একজন বলে উঠল, গতকালই দেখেছি, সে এই এই …. কাজ করেছে। সভাপতি মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, গতকাল গতকালই, সেটাত আর আগামীকাল নয়। আমি হাসি চেপে রেখে কোন রকমে মিটিং থেকে বের হয়ে আসলাম। মিটিং-এর শেষাংশ দেখার সুযোগ হল না।
ঘটনার প্রায় ৪ বৎসর পর ভদ্রলোক প্রচুর সম্পদ রেখে মারা গেলেন। তার ঐ ছেলে অন্য সব ভাইদের উপর জোর খাটিয়ে পিতার সমস্ত সম্পদ নিজের দখলে আনল। শুরু হল বিক্রয়। সব ভাইয়েরা সন্ত্রাসী ভাইটির শক্তির কাছে হার মেনে নিজেদের অনিচ্ছায় পৈতৃক সম্পদ বিক্রয় দলিলে সই করতে থাকল। কিন্তু সাড়ে তিন কোটি টাকার হিসাব চাওয়ার সাহস নেই। তবুও ভাইয়েরা শহরের নাভিমূলে অবস্থিত পিতার গড়া বসত বাড়িটির দখলে থেকে ইতিহাসের আরো পরিণতি দেখার অপেক্ষায় আছে।
লেখক : শিক্ষাব্রতী, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকালজয়ী ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
পরবর্তী নিবন্ধ‘তুমি যতদূর পিছনে তাকাবে, ততদূর সামনে দেখতে পাবে’