বলা হয়ে থাকে, শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় ৯৮% শিক্ষক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত আছেন। তাঁরা দেশের ভবিষ্যত কাণ্ডারী, ভবিষ্যৎ নাগরিক গড়ায় কর্মরত। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকার কারণে আমার বেশ কিছু উপলব্ধি আজ পাঠকের কাছে শেয়ার করতে চাই।
১.একসময় জমিদার বা অবস্থাপন্ন পরিবারের সদস্যরা স্বপ্রণোদিতভাবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে শিক্ষকতায় আগ্রহী হতেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক উন্নয়ন। সময় পরিক্রমায় শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে দেশের আনাচে কানাচে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন শুরু হলে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রচুর শিক্ষক চাহিদার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে, বেতন–ভাতাদির অপর্যাপ্ততার কারণে স্নাতক/স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় শিক্ষক হবার মানসে বিএড/বিএড, এমএড করে শিক্ষকতায় যোগদান করেছেন এমন শিক্ষকের সংখ্যা অতি নগণ্য। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাকরির প্রতিযোগিতায় অন্যত্র চাকরি না পাওয়ায় অনেকে জীবিকার তাগিদে শিক্ষকতায় যোগদান করেছেন। বর্তমানে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে শিক্ষকতায় যোগদানের পদ্ধতি চালু হবার পরও দেখা যায় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ সনদধারীরা অন্যত্র চাকরি পেলে শিক্ষকতায় আসতে আগ্রহী হন না বা যোগদান করলেও শিক্ষকতা পেশায় ইস্তফা দিয়ে চলে যান।
২.একজন চাকরিজীবীর দৃষ্টিকোণ থেকে চাকরিতে যোগদানের পূর্বশর্ত হলো যথার্থ আর্থিক নিশ্চয়তা। শিক্ষকতায় আর্থিক নিশ্চয়তার দিকটি প্রধান বিবেচ্য হিসেবে চিন্তা শুরুর সাথে সাথে মাসিক বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি যুগোপযোগী না হওয়া এবং অপরাপর চাকরির বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি হতে তুলনামূলকভাবে অতিব কম হওয়ায় প্রধানত বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণের অনেকেই অতিরিক্ত আর্থিক যোগানের ব্যবস্থাকরণে টিউশন/কোচিং এ ঝুঁকে পড়েন। এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণের হেন ঝোঁকের মূল কারণ সরকার কর্তৃক শত ভাগ বেতন প্রাপ্ত হলেও অন্যান্য ভাতা ও সুবিধাদি সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের ন্যয় প্রাপ্ত না হওয়া। এছাড়া অনাগ্রহ সত্ত্বেও শিক্ষকতায় যোগদানকারীদের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের কাম্য পাঠদানে অনিচ্ছুক হতেও দেখা যায় যা কখনোই কাম্য নয়।
৩.বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও নীতিমালা–২০২১ অনুযায়ী একজন এমপিওভুক্ত সহকারী শিক্ষক ১০বছর নিরবচ্ছিন্ন চাকরির পর ১ম ও পরবর্তী ৬ বছর পর ২য় টাইম স্কেল প্রাপ্ত হন। সেই মতে একজন বিএড বিহীন সহকারী শিক্ষক ১১তম গ্রেডে, বিএডধারী সহকারী শিক্ষক ১০ম গ্রেডে, ১ম টাইম স্কেল প্রাপ্তিতে ৯ম গ্রেডে এবং ২য় টাইম স্কেল প্রাপ্তিতে ৮ম গ্রেডে বেতন–ভাতাদি প্রাপ্ত হন। সেই সাথে নিরবচ্ছিন্ন ন্যূনতম ১০ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও বিএড থাকলে সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং ৩ বছর সহকারী প্রধান শিক্ষকের অভিজ্ঞতাসহ মোট ১৫ বছরের ন্যূনতম শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকলে প্রধান শিক্ষক পদে আবেদনপূর্বক নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির বিধান চালু আছে। সেই মতে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রধান শিক্ষক ৮ম গ্রেডে ও একজন প্রধান শিক্ষক ৭ম গ্রেডে বেতন–ভাতাদি প্রাপ্ত হন। ফলে ৮ম গ্রেডে ২য় টাইম স্কেল প্রাপ্ত একজন সিনিয়র শিক্ষক এবং একজন সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদের নামের পরিবর্তন ব্যতীত বেতন–ভাতাদি প্রাপ্তিতে কোনো তারতম্য হয় না। এছাড়া একজন সহকারী প্রধান শিক্ষক ও একজন প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরতদের ক্ষেত্রে সহকারী শিক্ষকদের ন্যায় টাইমস্কেল/ সিলেকশন গ্রেড প্রাপ্তির বিধান না থাকার কারণে উল্লিখিত দুই পদে যোগদানের পর হতে একই গ্রেডে কর্মরত থেকে অবসরগ্রহণ করতে হয়। তাছাড়া এমন অনেক সহকারী প্রধান শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক আছেন যাঁরা এই নীতিমালা অনুযায়ী তাঁদের পদের জন্য বরাদ্দ গ্রেডের শেষ ধাপে পৌছে যাবেন, কিন্তু অবসরগ্রহণের শেষসময় ৬০ বছর বয়সে উপনীত হবেন না; ফলে অবসর পর্যন্ত শেষ কয়েক বছর একই ধাপে বেতন–ভাতাদি উত্তোলনে বাধ্য হবেন। উল্লেখ্য, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক পদে অটোপ্রমোশনের কোনো বিধান নেই এবং অনেক সহকারী প্রধান শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক আছেন যাঁরা তাঁদের কর্মজীবনে সহকারী একবারো টাইম স্কেলের সুবিধাপ্রাপ্ত হননি। এছাড়া উল্লিখিত দুই পদ প্রশাসনিক পদ হওয়ার কারণে অফিস কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত সময়েও তাঁদের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হয়; তদসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রণালয় কর্তৃক ঘোষিত ছুটির সময়ও বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের সময়ে সময়ে নির্দেশিত কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়। ফলে সহকারী শিক্ষকদের মতো টিউশন/কোচিং এর মাধ্যমে কিছু অতিরিক্ত আর্থিক যোগানের ব্যবস্থা করার সুযোগ থাকে না।
৪.সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক যোগদান হতে ১০ম গ্রেডে, সহকারী প্রধান শিক্ষক ৭ম গ্রেডে এবং প্রধান শিক্ষক ৬ষ্ঠ গ্রেডে বেতন, ৪০%-৫০% বাড়ি ভাড়া ভাতা, ১৫০০টাকা চিকিৎসা ভাতা, ২টি ১০০% উৎসব ভাতা ও শিক্ষা ভাতা পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের বিবিধ র্যাংকে প্রেষণে পদায়নও করা হয়। সেই একই শিক্ষা স্তরের বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিএড বিহীন সহকারী শিক্ষক ১১তম গ্রেডে, বিএড ধারী সহকারী শিক্ষক ১০ম গ্রেডে, সহকারী প্রধান শিক্ষক ৮ম গ্রেডে ও প্রধান শিক্ষক ৭ম গ্রেডে বেতন, ১০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া ভাতা, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, ২টি ২৫% উৎসব ভাতা পেয়ে থাকেন।
৫.বাংলাদেশে প্রায় সব দপ্তরে বর্তমানে ইএফটির মাধ্যমে মাসিক বেতন–ভাতাদি স্ব স্ব ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে প্রদত্ত হলেও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আজও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে এমপিও চেক জমা হলে বিদ্যালয় হতে শিক্ষকদের নামভিত্তিক মাসিক বেতন–ভাতার সরকারি অংশ পাওনার বিলছক স্বাক্ষর প্রদান করত: জমা দিলে তবেই স্ব স্ব ব্যাংক হিসাবে মাসিক পাওনা জমা হয়। এছাড়া প্রতি মাসের ৭–১০ তারিখ নাগাদ এমপিও বিলের চেকের অর্থ উত্তোলনের নির্দেশনা থাকে বিধায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখাগুলো হতে নির্দেশিত শেষ তারিখের পরই প্রাপ্য অর্থ উত্তোলন করা যায়।
৬.বর্তমানে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকগণ ৬০ বছর বয়সবধি কর্মরত থেকে অবসরে যান। প্রতি মাসের এমপিওতে নিজ বেতন স্কেলের ৬%অবসর ও ৪%কল্যাণ তহবিলের জন্য কর্তন করে মাসিক বেতন–ভাতা প্রদান করা হয় এবং অবসরগ্রহণের পর এককালীন অবসর ও কল্যাণ তহবিলের প্রাপ্য অংশ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকগণকে প্রদান করা হয়। চাকরি হতে অবসরের পর এই তহবিল তাঁদের অবসরকালীন জীবন যাপনের মূল এবং অনেকের জন্য একমাত্র আর্থিক সহায় হলেও অবসর ও কল্যাণ তহবিলের নিজ অংশ পেতে পেতে অবসর জীবনের ৫–৭ বছর চলে যায়। ফলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনযাপনের মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হয়। অনেকেই মানসিক, পারিবারিক,সামাজিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকসময় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকগণের জীবদ্দশায় এই অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ ঘটে না।
বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকসমাজের উন্নয়নে আমার নিজস্ব ভাবনা:
১.শিক্ষাদানে ব্রতী ও নিত্য নতুন কৌশলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিবিধ দিকে মনোনিবেশ করাতে নিবেদিত ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় যুক্ত হওয়া। ২. শিক্ষকতায় আগ্রহীদের শিক্ষকতায় যোগদানের পূর্বে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ সনদ অর্জনের পাশাপাশি পেশাগত ডিগ্রি বিএড সম্পন্ন করা। ৩.শিক্ষকতায় সামাজিক দায়বদ্ধতাকে অগ্রাধিকার বিবেচনা করা। ৪.জাতীয়ভাবে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের আর্থিক সংস্থান যুগোপযোগী, পদভিত্তিক পে–গ্রেড, ভাতা ও সুবিধাদি সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের সদৃশ ও সামাজিক অবস্থান উন্নীত করা; ৫.অন্যান্য দপ্তরের চাকরিজীবীদের ন্যায় বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন–ভাতাদি প্রতি মাসের ০১ তারিখে ইএফটির মাধ্যমে জমাকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ অবিলম্বে কার্যকর করা। ৬.মানবিকতার বিচারে অবসরগ্রহণের পরবর্তী অনূর্ধ্ব তিন মাসের মধ্যে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রাপ্য অবসর ও কল্যাণ তহবিলের অর্থ ইএফটির মাধ্যমে ব্যাংকে অটোপ্রাপ্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
পরিশেষে বলতে চাই, কোনো যন্ত্রতে তার কাম্য জ্বালানি পর্যাপ্তমাত্রায় প্রয়োগ করা না হলে যেমন যন্ত্র কাজ করতে অক্ষম, তেমনি বেসরকারি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষকসমাজের যথাযোগ্য ও যুগোপযোগী চাহিদাপূরণ ব্যতিরেকে সমাজ তথা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি কখনোই সম্ভব নয়। লেখক : শিক্ষক