সমন্বয়ে বাধা কোথায়?

সেবা সংস্থাগুলোর ইগো নাকি জবাবদিহিতার অভাব

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

শেখ মুজিব রোডের চৌমুহনী পার হতেই বিশাল গর্তে পড়ে হেলে উঠে যাত্রীবাহী বাস। তখন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এক যাত্রী তার পাশের জনকে বলে উঠলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার করা হচ্ছে। কিন্তু ভাঙা রাস্তা ঠিক করছে না। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের জন্য তিনি সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করেন। প্রতিত্তুরে ওই যাত্রী বলেন, পত্রিকায় দেখলাম, সিডিএ ফ্লাইওভার করছে। তাই আপাতত রাস্তা ঠিক করার দায়িত্বও নাকি তাদের।
এবার প্রথম যাত্রী বলেন, তাদের ঠেলাঠেলিতে জনগণের কষ্ট বাড়ছে। নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাদিয়া মারা গেল। সিডিএ-চসিকের উচিত ছিল, ভবিষ্যতে এমন প্রাণহানি এড়াতে একসাথে বসে করণীয় ঠিক করা। কিন্তু তা না করে একে অপরকে দোষারোপ করছে। অথচ দুটোই সরকারি প্রতিষ্ঠান। মিলেমিশে কাজ করতে তাদের সমস্যা কোথায়? সমন্বয় করতে বাধা কোথায়? এবার দ্বিতীয় যাত্রী বলেন, দুঃখ তো সেখানেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান স্বাধীন। কে কার কথা শুনবে। সিডিএ-সিটি কর্পোরেশনে তো রাজনৈতিক প্রতিনিধি। অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও স্ব স্ব জায়গায় নিজেকে বড় ভাবেন। তাই এক প্রতিষ্ঠানের কথা অন্য প্রতিষ্ঠান শুনতে ‘ইগো’তে ভুগেন। গতকাল দুপুরে ইপিজেডগামী বাসের এ দুই যাত্রীর কথোপকথন বাদ দিলেও এটা স্বীকার্য, দীর্ঘদিন ধরে সমন্বয়হীনতা আছে নগরের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে। ফলে কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছেন না জনগণ। সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীতার কারণে রীতিমত জনদুর্ভোগ বেড়েছে। তবু তারা সমন্বয় করে না কেন? সমন্বয়ে বাধা কোথায়? বাসযাত্রীর কথায় কি সঠিক তবে। কেবল ইগো? নাকি এক সংস্থার প্রতি অন্য সংস্থার জবাবদিহিতা না থাকা। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ইগো তো থাকেই। কিন্তু কাজ করাতে গেলে অনেক সময় জনপ্রতিনিধিকে একটু নমনীয় হতে হবে। গো ধরে বসে থাকলে হবে না। এতে কেউ কো-অর্ডিনেশন (সমন্বয়) করবে না। জনপ্রতিনিধিকে মনে করতে হবে, কাজটা নিজের ও জনগণের, তাই শহরের স্বার্থে সবার কাছে গিয়ে ও সবাইকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু সবাই ব্যুরোক্রেটিক ওয়ে’তে করতে চায়। এভাবে সমন্বয় হবে না তো। তাই একদিকে পলিটিক্যাল চাপ এবং অন্যদিকে প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে কাজ করতে হবে। অন্যথায় কেউ কারো কথা শুনবে না।
তিনি বলেন, সবার সাথে মিলেমিশে কাজ করার পন্থা বের করাটাই হচ্ছে সমন্বয়। সমন্বয়ের অর্থই হচ্ছে এক ধরনের সহযোগিতা। যেমন এক সংস্থা কাজ করছে, অন্য সংস্থা সেখানে তাদের সম্পৃক্ততা কোথায় বের করে পরষ্পরকে সহযোগিতা করবে। তবে কো-অর্ডিনেশন মানে কিন্তু বাধ্য করা না। কো-অর্ডিনেশন এমন মেকানিজম, যেটা মোটিভেশন করে করতে হয়। মোটিভিশনের বিষয়টা প্রণোদনা দিয়ে করাতে হয়। কিন্তু মেয়র যদি মনে করেন, আমি পাওয়ার নিয়ে বসে থাকবো, সবাইকে ডাকবো ও তারা আসবে এবং তাদের সাথে সমন্বয় করবো, তা কোনোদিন সম্ভব হবে না। সেখানে প্রশাসনের আর্ট কাজে লাগাতে হবে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, সমন্বয় নিশ্চিতে শহরের মানুষকে নিয়েই কাজ করতে হবে। যে এলাকায় প্রকল্প আছে সে এলাকার মানুষকে দিয়ে বাধ্য করাতে হবে। এটা হচ্ছে রাজনৈতিক চাপ। আরেকটি হচ্ছে সংস্থাগুলোর প্রধানদের সঙ্গে আলাদা আলাদা বসা। প্রয়োজনে তাদের কাছে যেতে হবে। একবার-দুইবার বসলে সমস্যা কি? রেজাল্ট তো আসবে। কেবল তাদের ডাকলেই আসবেন, সেটা হবে না।
‘সমন্বয় সভাগুলোতে সেবাসংস্থার দায়িত্বশীল কেউ না এসে তাদের প্রতিনিধি পঠানো হয়। ফলে অগ্রগতিও হয় না।’ এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তোফায়েল আহমেদ বলেন, সিডিএ বা বন্দর চেয়ারম্যান কি মিটিংয়ে আসবেন? সংস্থাগুলোর সিনিয়র অফিসার আসতে পারেন। সেটা সিডিএ বা বন্দরের চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে মেয়রকে ঠিক করে নিতে হবে, সবসময় মিটিংয়ে কে আসবেন। এটাই হচ্ছে, কো-অর্ডিনেশন। এখানে প্রশাসনের আর্ট কাজ লাগাতে হবে।
অবশ্য সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সমন্বয়ের অভাবের জন্য সেবাসংস্থাগুলোর উপর মেয়রের কর্তৃত্ব না থাকা এবং সেবাসংস্থাগুলোর জবাবদিহিতা না থাকাকে দায়ী করেছেন। তিনি আজাদীকে বলেন, সমন্বয়ের জন্য সেবাসংস্থাগুলোর সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ করি। কিন্তু মেয়র আহ্বান করলেও তারা আসুক বা না আসুক জবাবদিহি করতে হয় না। জবাবদিহিতার যদি বাধ্যবাধকতা থাকতো তাহলে সমন্বয় ঠিকই হতো এবং সমন্বয় সভার সিদ্ধান্তও বাস্তবায়িত হতো।
মেয়র বলেন, সমন্বয় নিশ্চিত করার জন্য মেয়রকে অভিভাবকত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি হিসেবে মেয়রকে সেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা দিতে হবে। মেয়র যদি চার্জ করতে পারতো তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত। শহরটা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে। এখানে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে গেলে মেয়রকে অবহিত করতে হবে। সমন্বয় করতে হবে। সেখানে মেয়রের ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, সবকিছুর জন্য সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করা হয়। বাস্তবে একাধিক সংস্থা কাজ করতে গিয়ে শহরে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সমন্বয়হীনতার কারণে নাগরিক দুর্ভোগ ও সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে পরপর যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে তাতে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে কষ্ট পেলেও তা লাঘবে আমার ক্ষমতা খুবই সীমিত। অভিভাবকত্ব থাকলে , জবাবদিহি করার সুযোগ থাকলে এমন হতো না।
সমন্বয় না হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে নগরপরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার দৈনিক আজাদীকে বলেন, বর্তমানে যে ব্যবস্থা তাতে কোনদিন সমন্বয় হবে না। হলে কলাগাছ দিয়ে ফার্নিচার বানাতে পারতাম। এখানে যে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আছে তারা ২৮ থেকে ৩০টি মন্ত্রণলায়ের অধীন। ফলে ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে তারা জবাবদিহিতা করে। যেমন সিডিএ গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং সিটি কর্পোরেশন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন। সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশন বসে যদি কোনো সিদ্ধান্তও নেয়, বা সিডিএ চেয়ারম্যান এসেও যদি কথা দিয়ে যান তবু সমন্বয়ে বাধা থাকবে। কারণ কাজটা অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হবে মন্ত্রণালয়ে। আবার প্রতিটি মন্ত্রণালয় কিন্তু নিজেদের মত করে ভাববে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় তো তখন মেয়রকে চিনবেন না। তারা নিজেদের পরিকল্পনা মতো কাজ করবেন। এ প্রকৌশলী বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছে শুধুমাত্র সিটি কর্পোরেশনে। তাই সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে মেয়রের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে এবং মেয়রের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। অন্যথায় সমন্বয় সম্ভব না। তিনি বলেন, দিল্লি ও নিউইয়র্ক সিটিতে সবকিছু মেয়রের অধীনে।
সমন্বয়ের আইনগত দিক : স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ এর ধারা ৪৯ এর উপ-ধারার আলোকে সমন্বয় নিশ্চিতে কিছুটা সুযোগ রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। এক্ষেত্রে চসিকের আমন্ত্রণে বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রধানগণ ও তাদের প্রতিনিধিগণ সাধারণ সভায় যোগ দিতে পারবেন। এবং বিভিন্ন মতামত দিতে পারবেন। যদিও বিগত সময়ে চসিকের সাধারণ সভায় বিভিন্ন সেবাসংস্থার প্রধানগণের উপস্থিতি ছিল না। বর্তমান মেয়রের মেয়াদকালে প্রতিনিধি হিসেবে যারা আসেন তারাও গুরুত্বপূর্ণ পদধারী নন। ফলে সমন্বয়ের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থাকে।
অবশ্য এক সময় ‘অর্ডিন্যান্স অব সিটি কর্পোরেশন-১৯৮২’র আলোকে চট্টগ্রামসহ দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলো পরিচালিত হতো। আইনটির আলোকে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত যারা মেয়র ছিলেন তারা বিভিন্ন সেবাসংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে পারতেন। ওই সময় চট্টগ্রামের সাতটি সেবা সংস্থা তথা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা, সিডিএ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত অধিদপ্তর, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও সড়ক ও জনপথ বিভাগের দপ্তরে প্রধানগণ সিটি কর্পোরেশনের ‘অফিসিয়াল কমিশনার’ ছিলেন। তারা মেয়রের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত প্রতি মাসের সমন্বয় সভায় উপস্থিত থাকতে বাধ্য ছিলেন। পরবর্তীতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহা-ব্যবস্থাপকসহ অন্য সেবাসংস্থার প্রধানগণের উপস্থিতি অনেকটা বাধ্য ছিল। ১৯৯৩ সালে আইনটি বিএনপি সরকার রহিত করলে ক্ষমতা হারান মেয়রগণ।
পরবর্তীতে সমন্বয়ের দাবি উঠার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালের ২৭ জুন ‘সিটি কর্পোরেশনের সাথে সেবা প্রদানকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি দপ্তর সমূহের মধ্যে সমন্বয়’ করার জন্য একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, ‘সিটি কর্পোরেশনের অধিক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরের প্রধানগণ সিটি কর্পোরেশনের আমন্ত্রণে সভায় যোগদান করত: সভায় গৃহীত সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন এবং বাস্তবায়ন অগ্রগতি সিটি কর্পোরেশনকে অবহিত করবেন’।
এরপরও সমন্বয় নিশ্চিত না হওয়ায় ২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, ‘চসিক নিয়মিত সমন্বয় সভার আয়োজন করেছে। সভায় সকল উন্নয়ন কাজে চসিকের সাথে সমন্বয়ে বারবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও বাস্তবে কোন সংস্থা-ই কার্যকর সমন্বয় পূর্বক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে না’।
এরপর ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে জারিকৃত পূর্বের পরিপত্রের নির্দেশনা যথাযথ অনুসরণ’ করার নির্দেশ দিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ ১৫টি মন্ত্রণালয় ও সরকারের বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে নগরে অসংখ্য সমন্বয় সভা হয়েছে। এমনকি স্থানীয় সরকার মন্ত্রীও যোগ দেন সভায়। ওসব সভায় সমন্বয় নিশ্চিত করারও কথা বলেছিলেন সেবাসংস্থার প্রধান বা প্রতিনিধিগণ। এতকিছুর পরও নগর উন্নয়নে সমন্বয় নিশ্চিত হয়নি। কারণ, ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯’ এর আলোকে আহূত সমন্বয় সভায় সেবাসংস্থার প্রতিনিধি না এলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কোন এখতিয়ার বা ক্ষমতা নাই কর্পোরেশনের। ফলে সমন্বয়সভাগুলো ফলপ্রসু হয় নি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিপত্রে চসিকের আহূত সমন্বয় সভায় কেউ অনুপস্থিত থাকলে বা সমন্বয় না করলে সংস্থাগুলোর প্রতি সিটি কর্পোরেশনের করণীয় নির্ধারণে কোন বিধান ঠিক করা হয়নি।
এদিকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর চসিকের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের উদ্যোগে গঠিত একটি পরামর্শক কমিটির সভায় প্রয়োজনে আইন সংশোধন করেও চসিকের ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন বিশিষ্টজনরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত
পরবর্তী নিবন্ধটিআইবির দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষক হতে ঘুষ লাগে ১৫ লাখ পর্যন্ত