পৃথিবীতে যুদ্ধাশঙ্কা কমার বদলে কেবল বেড়েই চলেছে। এরই মাঝে ইতালিতে জি –৭ এর বৈঠক থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে বিপুল সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ঝেলেনেস্কির মুখে তাতেও খুব একটা হাসি ফোটেনি। এই হাসি না ফোটর কারণ রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। এর বাইরেও রাশিয়ার ক্রম অগ্রসরমান সেনাবাহিনী বিপুল বিক্রমে কিয়েভকে কাবু করার জন্য কেবলি এগিয়ে আসছে।
এমন প্রেক্ষাপটে ইতালির জি–৭ বৈঠকের পরপরই সুইজারল্যান্ডে পৃথিবীর ৯২টি দেশের বিভিন্ন স্তরের রাষ্ট্র, সরকার প্রধান/প্রতিনিধিদের শান্তি সম্মেলন আয়োজিত হয়। পরিহাসের বিষয় হল জামাই নাই মেয়ের বিয়ের মত, ঘটনার মূল নায়ক রাশিয়ার অনুপস্থিতিতে এই শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। চীনও এ বৈঠকে যোগ দেয়নি। আবার যোগ দেওয়াদের মাঝে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব সহ অনেকগুলি দেশ এই শান্তি সম্মেলনের ঘোষণা পত্রে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকে।
ইতালি এবং সুইজারল্যান্ডে যখন এমন এক কূটনৈতিক চাল চলমান তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তার চালে পশ্চিমাদের হতবাক করে উড়াল দেন উত্তর কোরিয়ায়। উত্তর কোরিয়া ইতিমধ্যে এমন এমন কাণ্ডকীর্তি করে যাচ্ছে যা শুধু অবাক করার নয় অভিনবও বটে। যেমন ময়লা ভর্তি শত শত বেলুন দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্দেশ্যে উড়িয়ে দেওয়া। সে বেলুন উড়ে এসে দক্ষিণ কোরিয়ায় পড়ছে আর দক্ষিণ কোরিয়ানরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া সেসব ময়লার ভাগার পরিষ্কার করতে তটস্থ। এর মাঝে নিত্য নতুন ব্যালেস্টিক মিসাইলের পরীক্ষা তো আছেই। বলাবাহুল্য এসব পরীক্ষার লক্ষ্য মূলত মার্কিন স্বার্থাভিমুখি।
পশ্চিমাদের অর্থাৎ ইতালির জি –৭ এবং সুইজারল্যান্ডের ইউক্রেন শান্তি সম্মেলনের বিপরীতে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন’ তার পাল্টা কৌশল হিসাবে উত্তর কোরিয়া এবং ভিয়েৎনাম সফর করেন। পুতিনের পিয়ং ইয়ং পৌঁছার আগের দিন উত্তর কোরিয় সৈন্যরা দুই কোরিয় সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে উস্কানীমূলক আচরণ করেছে বলে দক্ষিণ কোরিয়া অভিযোগ করে। এ থেকে দুদেশের উত্তেজনা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়। পুতিনের সফর বিশেষ করে উত্তর কোরিয়া সফর আমেরিকার কৌশল প্রণেতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। এর পিছনে দুটি কারণ বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল বলে প্রতীয়মান। প্রথমত রাশিয়া–কোরিয়া দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা চুক্তি আর দ্বিতীয়ত প্রয়োজনে এই চুক্তিবলে রাশিয়ার জন্য সামরিক রসদ সরবরাহের নিশ্চয়তা।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ যখন পাশ্চত্যাকে দারুণ বিপর্যস্ততার মুখোমুখি করছে তখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমেরিকা হামাস–ইসরাইল, হিজবুল্লাহ–ইসরাইল যুদ্ধের পাশাপাশি তাইওয়ানে আরো একটি ফ্রন্ট খোলার জন্য উদগ্রীব। কারণ ইতিপূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক চীন নীতি গ্রহণ করেছিল। এই নীতি অনুযায়ী এটাও স্বীকৃত হয় যে তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্ত্তু ২০২২ সালের অগাস্ট ২–৩ মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ’এর স্পীকার ন্যানসি পেলোসি পাঁচ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল নিয়ে তাইওয়ান সফরে যান। সফরকালীন পেলোসি তাইওয়ানের গণতান্ত্রিক ক্রমযাত্রায় দৃঢ়ভাবে তার পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
ন্যানসি পেলোসি’র এ সফরে চীন তার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। চীন তার প্রতিক্রিয়ায় এ ডি আই জেট (এয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোন)’এর তোয়াক্কা না করে পিপলস লিবারেশন আর্মির ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধ বিমান তাইওয়ানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রর্দশনে নিয়োজিত করে। একই সাথে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির নৌ বাহিনী ‘মেডিয়ান লাইন’ অতিক্রম করে, এই লাইন এ যাবৎ চীনের মূল ভূখণ্ড এবং তাইওয়ানের মাঝে একটি সীমারেখা হিসাবে বিদ্যমান ছিল। ‘মেডিয়ান লাইন’ এর পরোয়া না করে চীনের যুদ্ধ জাহাজ তাদের সক্ষমতার পরিচয় দিতে মহড়ায় নামে। চীনের তাইওয়ানকে ঘিরে পিপলস লিবারেশন আর্মির সামরিক এইসব মহড়ার বিপরীতে তাইওয়ান প্রণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন রণতরীগুলিও নানা ধরনের উপস্থিতি জানান দিতে গিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
এর বাইরেও আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়জন গভর্নরও তাইওয়ান সফর করে।
চীন ২০২৪ এর মে মাসে তাইওয়ানকে সবদিক থেকে ঘিরে অর্থাৎ কিনম্যান, মাটসু, ওয়াকিউ এবং ডংজিন দ্বীপ থেকে তাদের সামরিক, নৌ এবং বিশাল বহরের বিমান মহড়া পরিচালনা করে। চাইনীজরা তাদের এ মহড়ার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন এভাবে ‘স্ট্রং পানিশমেন্ট ফর দি সেপারেটিস্ট এ্যাক্ট অব তাইওয়ান ইন্ডিপেনডেন্ট ফোর্সেস এ্যান্ড এ্যা স্টার্ন ওয়ারনিং এগেইনস্ট ইন্টারফেয়ার এ্যান্ড প্রোভোকেশন বাই দি এ্যক্সটারনাল ফোর্সেস’। অর্থাৎ এই মহড়া তাইওয়ানের বিচ্ছিন্নতাবাদী তথা স্বাধীনতাকামীদের জন্য চরম শাস্তির বার্তা এবং অযাচিত হস্তক্ষেপকারী বহিঃশক্রর প্রতি কড়া হুশিয়ারী।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাইওয়ানকে ঘিরে আরো একটি যুদ্ধের আশঙ্কা কেন? আশঙ্কা এজন্য যে এখানে বর্তমানে দুটি পরাক্রমশালী শক্তি পরস্পরের মুখামুখি। এর এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর অপর দিকে চীন। এ যাবৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক চীন নীতিতে তার পররাষ্ট্র নীতিতে অনেকটা পরির্বতন এনেছিল। চীন ও তার তাইওয়ান সংক্রান্ত পররাষ্ট্র নীতি এক দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনায় এগিয়ে নিয়ে আসছিল। এ বিষয়ে এক সময়ের লিজেন্ডারি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার বর্ণীত, কিশোর মাহবুবানির বই ‘হ্যাজ চায়না ওয়ান?’ এ বিবৃত বিষয়টি উল্লেখ করা প্রণিধানযোগ্য। হেনরী কিসিঞ্জার উল্লেখ করেছেন, ‘Chinese strategy was guided by the Chinese game of “Wei qi”, not Western chess, the emphasis is on finding the fastest way to capture the king. In “Wei qi” the goal is slowly and pertinently built-up assets to tip the balance of the game in one’s favor. The emphasis is on long term strategy, not short-term gains. অর্থাৎ চাইনীজ কৌশল প্রণীত হয় তাদের “ওয়েই কি” খেলার নিয়মে, পাশ্চাত্যের দাবা খেলার মত লাফিয়ে বা দৌড়িয়ে রাজাকে কুপোকাত করার মত নয়। “ওয়েই কি” তে ধীরে সুস্থে ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ পরিকল্পনায় শক্তি সঞ্চয়ের পর রাজাকে কাবু করা হয়। দেখা গেছে চাইনীজরা ইতিপূর্বে হংকং এর ক্ষেত্রে এ কৌশল প্রয়োগ করেছিল।
তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও চাইনীজরা একই দীর্ঘ মেয়াদি কৌশল প্রয়োগে রত। এখানে সমস্যা হবে আমেরিকার যুদ্ধংদেহী মনোভাব এবং অন্যান্য বৈশ্বিক বিষয়াদি। যেমন ওয়াশিংটনে ৯ জুলাই অনুষ্ঠিত ন্যাটো’র ৭৫ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে “The People Republic of China’s stated ambitions and coercive policies continue to challenge our interest, security and values. The deepening strategic partnership between Russia and the PRC and their mutually reinforcing attempts to undercut and reshape the rules- based international order, are a cause for profound concern. অর্থাৎ পিপল’স রিপাবলিক অব চায়না তার ঘোষিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং এর সাথে সমন্বিত গৃহীত কৌশল আমাদের স্বার্থ, নিরাপত্তা এবং মূল্যবোধের প্রতি ক্রমাগত হুমকির সৃষ্টি করে চলেছে। রাশিয়ার সাথে চায়না’র কৌশলগত গভীর সম্পর্ক এবং এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বিদ্যমান আইন কানুনকে অবজ্ঞার প্রয়াসও গভীরভাবে বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ন্যাটোর আলোচ্য ঘোষণাপত্রের ২৬ এবং ২৭ অনুচ্ছেদে যথাক্রমে চীনকে উল্লেখ করে বলা হয়েছে,
The PRC has become a decisive enabler of Russia’s war against Ukraine through its so called ‘no limits partnership and its large-scale support for Russia’s defense industrial base. “সীমাহীন বন্ধুত্বের” মাধ্যমে চায়না ইউক্রেন যুদ্ধে সক্ষমতা যোগাতে রাশিয়ার সামরিক শিল্পে ব্যাপক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
‘The PRC continues to pose systematic challenges to Euro-Atlantic security’ চীন ক্রমাগত এবং পরিকল্পিতভাবে ইউরো–আটলান্টিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ধরে নেওয়া যায় ন্যাটো জোটের এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ১৫ এবং ১৬ জুলাই ২০২৪ দক্ষিণ চীন সাগরে রাশিয়া–চীন ব্যাপক এবং সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের যৌথ নৌ মহড়া চালায়। বলাবাহুল্য দক্ষিণ চীন সাগর ঘিরে আমেরিকা এবং তার মিত্ররা চীনের বিরুদ্ধে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এটি তার বিরুদ্ধে একটি হুশিয়ারী মাত্র।
এখন আমেরিকা বা ন্যাটোকে তাদের ধর্তব্যের মধ্যে চীন রাশিয়ার এ অবস্থানকে যেমন বিবেচনায় নিতে হবে তেমনি চীনের ঘোষিত তাইওয়ান তাদের ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ এ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। চীন এও ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, প্রয়োজনে বল প্রয়োগে তারা তাইওয়ান দখলে নেবে।
ন্যানসি পেলোসিদের তাইওয়ানের গণতান্ত্রিক ক্রমযাত্রায় দৃঢ়ভাবে পাশে থাকার প্রত্যয় আর চীনের প্রয়োজনে বল প্রয়োগে তাইওয়ান দখলের ঘোষণা বাস্তবে রূপ দিতে গেলে তাইওয়ানকে ঘিরে একটি মারাত্বক সংর্ঘর্ষ অনিবার্য। বিশ্ববাসীকে হয়ত এ দৃশ্য দেখার জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
লেখক: সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।