মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.)
আমাদের দুই ভৌগলিক প্রতিবেশীর একটি মায়ানমার। সাম্প্রতিক কালে মায়ানমার তার অভ্যন্তরীণ ঘটনা প্রবাহে আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং তথ্য প্রবাহ থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান মায়ানমার সেনাবাহিনী তাদের অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী দমনে ব্যস্ত। মায়ানমারে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কার্যক্রম তাদের স্বাধীনতার অবব্যহিত পর থেকে চলমান। এর রাজনৈতিক এবং নৃতাত্ত্বিক বিষয়গুলি একটু পিছন ফিরে আলোচনা করলে বর্তমান সংঘাতের কারণ আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে বলে আমার বিশ্বাস।
বৃটিশ দখল পূর্ব তৎকালীন বার্মা বর্তমানের মায়ানমারের বাইরে বেশ কিছু স্বাধীন সত্তা ছিল। তারা স্ট্যাট অভিধায় অভিষিক্ত ছিল। যেমন শান স্ট্যাট, কারেন স্ট্যাট, চিন স্ট্যাট, মন স্ট্যাট, কাইয়া স্টে, কাচিন স্ট্যাট এবং আরাকান স্ট্যাট।
ঐ সব স্টেটের বাইরে সাতটি ডিভিশন নিয়ে গঠিত ছিল বার্মা। এসব ডিভিশন হল মান্দালয়, রেঙুন, ইরাবদি, ম্যাপওয়ে, বাগো এবং সাগাইং। বৃটিশ সাম্্রাজ্যবাদীরা ক্রমান্বয়ে স্ট্যাট অভিধার স্বাধীন সত্তার স্ট্যাটগুলিকে দখল করে নেয়। জেনারেল অং সানের নেতৃত্বে বার্মা স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তখন বৃটিশ দখলপূর্ব স্ট্যাটগুলির ব্যাপারে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিশেষ করে শান কাচিন আরাকানিজদের মাঝে স্বাধীনতা উত্তর তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরই ফলশ্্রুতি ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে শান স্ট্যাটের পাংলুনে প্রথম এবং ১৯৪৮ সালের ১২ ফেব্্রুয়ারি দ্বিতীয় পাংলুন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জেনারেল অং সানের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন সমূহে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তৎকালীন বৃটিশ বার্মার সকল জাতি সত্তা স্বাধীনতার জন্য সম্মিলিতভাবে সংগ্রাম করবে। স্বাধীনতাত্তোর স্ট্যাট অভিধার যারা তারা ইচ্ছা করলে স্বাধীন সত্তা হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারবে বা চাইলে লুজ ফেডারেশন হিসাবে বার্মার সাথেও যুক্ত থেকে যেতে পারবে। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার উষালগ্নে জেনারেল অং সান তার হবু মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা সহ আততায়ীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিছুদিনের জন্য শা শোয়ে রাষ্ট্রপতি আর উ নু প্রধান মন্ত্রী হিসাবে র্বামা শাসন করেন। যদিও পিছন থেকে সেনা প্রধান জেনারেল নে উইন সব কলকাটি নাড়েন। ১৯৬২ সালে নে উইন স্বরূপে আর্বিভূত হন এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
জেনারেল নে উইন পাংলুন সমঝোতার কোনও কিছু মানতে অস্বীকৃতি জানান। শান, কারেন, মন, চিন, কাইয়া, আরাকানিজরা তারা তাদের স্বাধীনতার দাবী আরো জোরদার করার চেষ্টায় ব্রতী হয়। গঠিত হয় শানদের শান ন্যাশনাল আর্মি, কাচিনদের কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি, আরাকানিজদের আরাকান আর্মি, মনদের মন আর্মি। স্বতন্ত্র জাতিসত্তা সমূহ তাদের লক্ষ্য অর্জনে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে অবিরাম লড়াই শুরু করে।
মায়ানমার সেনাবাহিনী বিদ্রোহী দলগুলির সাথে সময়ে সময়ে সমঝোতা করেছে কিন্ত্তু স্বতন্ত্র আবাসভূমি বা কোনও ধরনের অটনমি’র ব্যাপারে কোনও ছাড় দেয়নি। এই ছাড় না দেওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ইতিহাসের পাতা একটু পিছনের দিকে উল্টালে পাওয়া যাবে।
১৯৪৮ সালের ১১ ফেব্্রুয়ারি স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবিতে ৪ লক্ষেরও অধিক কারেন এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে মিলিত হয়েছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে বার্মার তৎকালীন সরকার তাদের দাবী পূরণের আশ্বাস দেয়। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে বার্মিজ সেনাবাহিনী অতর্কিত এক অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে কারেন ন্যাশনাল ডিফেন্স র্অগানাইজেশানের সম্মুখ সারির সব নেতাকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় কারেনদের স্বশস্ত্র আন্দেলন। দীর্ঘ সশস্ত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে কারেন যোদ্ধারা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল মানারপ্লাউ’এ তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে। চলতে থাকে কারেনদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারির পূর্ব পর্যন্ত বার্মিজ সেনাবাহিনীর মানারপ্লাউ দখলের বহু অভিযান শুধু ব্যর্থই হয়নি সাথে হাজার হাজর সৈন্যকে অকাতরে জীবনও দিতে হয়েছে। ১৯৯৪ সালে বার্মিজ গোয়েন্দা সংস্থা সুকৌশলে কারেনদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টিতে সফল হয়। কারেনরা বিভক্ত হয় বুড্ডিষ্ট কারেন আর খ্্িরষ্টান কারেনে। এ ভাঙনের পিছনে কলকাঠি নাড়েন ভানতে উ থুজানা। কারেন ন্যাশনাল ডিফেন্স অর্গানাইজেশান বিভক্ত হয় বুড্ডিস্ট কারেন আর খ্্িরষ্টান কারেন। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৪০০(চারশত) বুড্ডিষ্ট কারেন আর্মি আর ১০০০০(দশ) হাজার বার্মিজ সেনার যৌথ অভিযানে ২৬ জানুয়ারি কারেনদের অজেয় সদর দপ্তর মানারপ্লাউ’এর পতন ঘটে। হাজার হাজার কারেন যোদ্ধার রক্তে মো ই এবং সালউইন নদীর পানি রক্তে রঞ্জিত হয়। কারেনরা তাদের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হয়।
মায়ানমারের বর্তমান প্রেক্ষাপটও প্রায় একই হলেও এবার কিছু ভিন্ন দৃশ্যপট রয়েছে। ২০২১ সালের ১ ফেব্্রুয়ারি সেনাবাহিনী অং সান সুকি’কে সরিয়ে নিজেরা সরাসরি ক্ষমতার দৃশ্যপটে আসে। সুকির অনুসারীরা এন ইউ জি তথা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট গঠন করে। একই সাথে তারা একটি সামরিক জোট এম এন ডি এ’ বা মায়ানমার ন্যাশনাল ডিফেন্স এ্যালায়েন্স ও গঠন করে। এর মাধ্যমে সুকির অনুসারীরা কোথাও কোথাও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবী জানিয়ে আসছে। তবে এই প্রতিরোধ আরাকান আর্মি বা শান আর্মি বা থাং আর্মির মত কোথাও তেমন প্রবল অবস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে তেমন নয়। যদিও পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম এম এন ডি এ’র অর্জন বা অগ্রগতি নিয়ে সময়ে সময়ে সরব।
বরং কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আরাকান আর্মি কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি আর ওয়া আর্মি মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের জোরদার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংগঠনগুলির জোট আবার আলাদা। এরা জোট বদ্ধ কখনো নর্দান এ্যালায়েন্স আবার কখনো ফ্রেন্ডশীপ এ্যালায়েন্স নামে। এদের পিছনে মদদ রয়েছে চীনের। আর এম এন ডি এ’ বা মায়ানমার ন্যাশনাল ডিফেন্স এ্যালায়েন্স অনেকটা পশ্চিমা সমর্থন নির্ভর। বলাবাহুল্য এটা যুক্তরাষ্ট্রের বার্মাএ্যাক্ট এর ছায়ায়।
বর্তমানে আরাকান আর্মি আরাকান জুড়ে বিশেষ করে আরাকানের উত্তরাঞ্চল জুড়ে মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবলভাবে লড়ে যাচ্ছে। এ লড়াই এর তাপ সময়ে সময়ে আমরাও আঁচ করছি যখন যুদ্ধরত পক্ষের মর্টার সেল এসে আমাদের এ পাড়ে পড়ছে। এ যুদ্ধের যাতাকলে পড়ে পকতো, রথিডং, বুথিডং এবং মংডোর অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আমাদের সীমান্তের দিকে যাত্রা করতে পারে এরকম এক আশঙ্কা আমাদের অনেককে পেয়ে বসেছে। তবে আমার মতে এ আশংকা প্রবল হওয়ার কোনও কারণ নেই। এর কারণ ২০১৭ সালের আগস্টের প্রেক্ষাপটের সাথে এবারের দৃশ্যপট ভিন্ন। সে সময় মায়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযান ছিল রোহিঙ্গা তাড়ানো এবার আরাকান আর্মিকে শায়েস্তা করা। সুতরাং যুদ্ধমান কোনও পক্ষেরই রোহিঙ্গা বিতাড়ন লক্ষ্য নয়। আমাদের জন্য এখন যা শঙ্কার বিষয় তা হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ক্রমেই জটিলতার গর্ভে বিকলাঙ্গ রূপ নিতে যাচ্ছে। বিষয়টি চীনা রাষ্ট্রদূত যেমন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতে এই বলে জানান দিয়েছেন, যে অবস্থা স্বাভাবিক হলে রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসিত হবে, জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি কূটনীতির আরো মার্জিত ভাষায় বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের এখন ভালো সময় নয়।
এসব বক্তব্য ধর্তব্যে নিয়ে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় রাখাইন স্ট্যাটের অবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এর কারণ মায়ানমার সেনাবাহিনী যেমন সহজে আরাকান আর্মির হাতে রাখাইনের কর্তৃত্ব ছাড়বে না তেমনি আরাকান আর্মিও এতদূর অগ্রসর হয়ে সহজে পিছুটান দেবে বলে মনে হয় না। আরো ভাববার বিষয় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ থেকে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আমাদের অর্জন শূন্য। এটা মায়ানমারের সামরিক জান্তার একগুঁয়েমির কারণে বা আমাদের কূটনীতির ব্যর্থতা যে কারণেই হোক না কেন।
রাখাইনে অদূর ভভিষ্যৎ এ মায়ানমার সেনাবাহিনী স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেও তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি নানা বেড়াজালে দীর্ঘায়িত করার একটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যাবে। আর ক্ষীণ সম্ভাবনার আলোকে যদি আরাকান আর্মি রাখাইনে নিজেদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষমও হয় তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি আরো এক জটিলতর বলয়ে ঘুরপাক খাবে। মনে রাখতে হবে রোহিঙ্গাদের সাথে রাখাইনদের এক মনস্তাতিক দূরত্ব বিদ্যমান। এ দূরত্ব ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব–যুদ্ধকালীন সময়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা সৃষ্টি করেছিল, যেমন পাক ভারত উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান ডিভাইড এন্ড রুল।
পুনশ্চঃ দীর্ঘ ২৬ বছর কঠোর হস্তে বার্মা শাসনের পর ২৩ জুলাই ১৯৮৮ সারা বিশ্বকে হতবাক করে জেনারেল নে উইন জেনারেল শ মং’এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পর্দার অন্তরালে চলে যান। জেনারেল শ মং কঠোর হস্তে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে ব্যর্থ সেই অজুহাতে জেনারেল থা শোয়ে এপ্রিল ১৯৯২ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। জেনারেল থা শোয়ে’র পথ ধরে বর্তমানে ক্ষমতায় জেনারেল মি অং লাইং। জেনারেল মি অং লাইং বিদ্্েরাহীদের সামাল দিতে ব্যর্থ হলে আরেকজন জেনারেল হয়ত ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। মায়ানমারে এই মুহূর্তে এর বেশি আর কিছু হবার নয়।
লেখক : কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।