সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ২৩ নভেম্বর, ২০২৫ at ৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি চ্যানেল ২৪ এর একটি অনুষ্ঠান ‘মুক্তমঞ্চ’ দেখছিলাম। উপস্থাপক জান্নাতুল নাইম’এর এক প্রশ্নে দেশের প্রখ্যাত আইনজ্ঞ এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. স্বাধীন মালিক যখন বললেন, মনে হয় যারা অন্তর্বর্তী সরকারে ক্ষমতা নিয়েছেন তারা হয়ত পরদিন কী করতে হবে তাও জানতেন না। এ বিষয়টি আমাকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে যায় মিশরীয় আদালতের কয়েকটি কথিত ঘটনা। সেই ঘটনাসমূহ ছিল এরকম।

সাদাতকে কেন হত্যা করেছ তুমি? আদালতে বিচারকের প্রশ্ন।

হত্যাকারী জবাব দেয় ‘কারণ সে সেকুল্যার ছিল’

বিচারক তখন জানতে চান ‘সেকুল্যার মানে কী?’

হত্যাকারীর জবাব ‘আমি জানি না।’

প্রয়াত মিশরীয় লেখক নাগিব মাহফুজকে ছুরি মেরে হত্যা প্রচে’ার অপরাধীকে বিচারক প্রশ্ন করেন, ‘নাগিব মাহফুজকে তুমি ছুরিকাঘাত করেছিলে কেন?’

জবাবে ছুরিঘাতকারী জানায় ‘কারণ সে ধর্মবিরোধী’।

বিচারক তখন জানতে চান কী করে বুঝলে নাগিব মাহফুজ ধর্ম বিরোধী?

ছুরিঘাতকারী জবাব দেয় ‘কারণ তিনি ধর্ম বিরোধী ‘চিলড্রেন অব গেবালাবি’ উপন্যাসটি লিখেছেন!

এবার বিচারক আগ্রহভরে জানতে চান ‘তুমি উপন্যাসটি পড়েছ?’

ছুরিঘাতকারীর জবাব ‘না’।

মিশরীয় বিখ্যাত সাহিত্যিক ফারাজ ফাউদাকে হত্যাকারী ব্যক্তিটিকে বিচারক প্রশ্ন করেন ‘ফারাজ ফাউদাকে হত্যা করলে কেন?’

হত্যাকারীর জবাব ‘কারণ তার ঈমান নাই’

বিচারক কৌতূহলভরে জানতে চান ‘তুমি কিভাবে বুঝলে তার ঈমান নাই?’

হত্যাকারীর জবাব ‘তার বইগুলি পড়লেই সব বুঝা যায়’!

বিচারকের কৌতূহল বাড়ে, তিনি আরো আগ্রহের সাথে জানতে চান ‘তার কোন বইটি পড়ে তুমি জানতে পারলে তার ঈমান নাই?’

হত্যাকারীর জবাব ‘বইয়ের নাম আমি জানি না। তার কোন বই আমি পড়িনি!’

বিস্মিত বিচারক জানতে চান পড়নি কেন?

হত্যাকারীর আরো বিস্ময়কর উত্তর ‘আমি লেখা পড়া জানি না’।

আমাদের দেশের বর্তমান নেতৃত্বও কি তাহলে পড়িনি, জানিনা’র কবলে পড়ে দিশাহীন? গতিহীন?

না হলে আই সি সি (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) তে, ডাউটি স্ট্রিট চেম্বার্সের অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের পক্ষ হয়ে যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তা পর্যালোচনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান কেন লিখবেন ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন, বা গ্রেফতারের মুখে আছেন। প্রমাণিত কোন সত্য তথ্যের ভিত্তি ছাড়াই অনেককেই হত্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ এমন কোন ব্যবস্থা করতে পারেনি যা প্রকৃত অপরাধের মামলাকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ বা সম্পর্কের কারণে করা মামলা থেকে আলাদা করতে পারে’।

১৩ নভেম্বর ২০২৫ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখায় ডেভিড বার্গম্যান আরো উল্লেখ করেন ‘যারা আশা করেছিলেন আওয়ামী লীগের পতন বাংলাদেশে মানবাধিকার ও জবাবদিহির জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করবে, তাদের কাছে বাস্তবতা একেবারেই হতাশাজনক’।

. স্বাধীন মালিকের কথায় আবারো ফিরে যাই। চ্যানেল ২৪ এর ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থাপক জানতে চান ড. স্বাধীন মালিক অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের পারফরম্যান্সের উপর ১০ এর মধ্যে কত দিতে চান? স্মিত হেসে কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে তার উত্তর ছিল ৩ বা ৪ এর বেশি নয়। এর কারণও রয়েছে। যেমনদীর্ঘ দেড় বছরে নানা ধরনের সংস্কার কমিশন, এইসব কমিশনের সুপারিশের ওপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের পর বৈঠক, জুলাই ঘোষণা পত্রে স্বাক্ষর এবং অতঃপর আমরা এখন দেখছি রাজনৈতিক দলগুলির অনৈক্য তথা বিপরীতমুখী নানা তৎপরতা। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরম্যান্সের উপর ড. স্বাধীন মালিকের খাতা পরীক্ষা করে বা খাতা কেটে ঐ নাম্বার। বি এন পি স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য এবং ঐকমত্য কমিশনে বি এন পি’র প্রতিনিধি জনাব সালাউদ্দিন আহমদ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেনঅন্তর্বর্তী সরকার ৬ (ছয়) টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এই সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশন ২৩(তেইশ) টি বৈঠকে মিলিত হয়। যে সমস্ত বিষয়ে ঐকমত্য হয় তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এবং আইনগত ভিত্তি কী হবে এসব বিষয়াদিও আলোচিত হয়। ৮৪ (চুরাশি) দফা এবং নানা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সহ জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়।

আলোচনায় তিনি আরো বেশ কিছু বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন যা আমার কাছে এ লেখায় প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।

যেমন আমেরিকান শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছে ১৭৮৯ সালে। সেই হিসাবে আমেরিকান শাসনতন্ত্রের বয়স এখন ২৩৬ বছর প্রায়। এই এত দীর্ঘ সময়ে তারা তাদের শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন বা সংশোধনী এনেছেন মাত্র ৭ (সাতবার)

১৯৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দুনিয়ার তাবত বাঘা বাঘা সংবিধান বিশারদদের মাধ্যমে বর্তমান রাশিয়ান সংবিধান প্রণীত হয়েছে। কিন্ত্তু এ সংবিধান পুতিনের একনায়কতন্ত্র কি বারিত করতে পেরেছে? মধ্য এশিয় দেশ যেগুলো একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল তাদের সংবিধান সমূহও কোন অংশে কম অগ্রগামী, কম গণতান্ত্রিক নয়। এরপরও এইসব দেশ নিজ নিজ প্রচলিত রীতিতে পরিচালিত হচ্ছে। ভারতচীন পাশাপাশি দুটি সামরিক অর্থনৈতিক পরাশক্তির দেশ। এই দুটি দেশ দুই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত। দুটি দেশই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন, সামরিক শক্তি অর্জনে বিকাশমান। এখানে জাতীয় অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে স্বীয় জনগণকে তারা কিভাবে পরিচালিত করছে সেটিই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে নিশ্চিতভাবে।

আমাদের ঐক্যমত্য কমিশন প্রণীত জুলাই ঘোষণাপত্র ঘটা করে স্বাক্ষর করা হয় তবে এন সি সি বাদে। পরবর্তীতে এই ঘোষণা পত্র আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হলে বি এন পি’র স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য জনাব সালাউদ্দীন আহমেদ তাদের দেওয়া নোট ডিসেন্ট বাদ দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করেন। তিনি তার বক্তব্যে আরো উল্লেখ করেন ‘অর্ন্তর্বতী সরকার হাত দিয়ে গোল করেছে’। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বা সংবিধান সংশোধনী আনীত প্রস্তাব কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তা উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে ২৭২ দিনের মধ্যে প্রস্তাবিত সংশোধনী সংসদে গৃহীত না হলে তা আপনা আপনি সংবিধানে গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে। এখন প্রশ্ন আসবে তাহলে সংসদের সার্বভৈৗমত্ব কোথায় গিয়ে ঠেকবে? একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অর্নিবাচিত কোন কমিশন কি এরকম প্রস্তাব কোন সংসদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে?

এবার প্রসঙ্গক্রমে আমাদের সংবিদানের প্রস্তাবনার দিকে পাঠকদের মনোযোগ ফিরাই। এতে স্পষ্ট বর্ণিত ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করিয়াছি’।

সংবিধানের প্রথমভাগ ‘প্রজাতন্ত্র’ অনুচ্ছেদ ৭ এর () এ সংবিধানের প্রাধান্য, বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।

৭ এর () এ বলা হয়েছে জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিররূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইবে।

৭ এর ক () এও বলা আছে ‘কোন ব্যক্তি শক্তি প্রর্দশন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যকোনো অসাংবিধানিক পন্থায়

() এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে কিংবা

() এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে

তাহার এই কার্য রাষ্ট্র দ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে’।

উপরোক্ত পাঠ আমি আমাদের পবিত্র সংবিধান থেকে উদ্ধৃত করলাম। আমার জানামতে যেহেতু আমাদের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি সেহেতু এসব বিষয় কিভাবে বিবেচিত হবে তা সংশ্লিষ্ট সবার বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে মনে করি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসুখের সময় শিশুকে কীভাবে খাওয়াতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধশহীদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী স্মৃতি সংসদের স্মরণসভা