সমকালের দর্পণ

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ঘূর্ণাবর্তে স্বদেশ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

সংঘাত সংঘর্ষ অসংখ্য প্রাণহানির পর বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ। এ দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পথচলা শুরুতে যে রকম মসৃণ হবে বলে অনেকেই ধারনা করেছিলেন সে ধারনা দিন যেতে ভ্‌্রান্ত বলেই প্রতীয়মান। বরং দিন যত গেছে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে দায়িত্ব ততই কঠিন এবং সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লা ততই ভারী হয়ে উঠেছে। এর অন্যতম কারণগুলি একে একে আলোচনা করা যায়।

রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞতা। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মেধাবী অনেক মানুষের ভিড় অন্তর্বর্তী সরকারে হয়েছে। কিন্ত্তু মনে রাখতে হবে এরা প্রায় সবাই তাদের কর্মজীবনে চাকরি করে এসেছেন কিন্ত্তু রাষ্ট পরিচালনা করেননি। ফলশ্রুতিতে যে দূরদর্শীতা নিয়ে তাদের রাষ্ট্রের হাল ধরার কথা তা তারা করতে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। এর বাইরেও আরো একটি মনস্ত্তাত্ত্বিক বিষয় আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, সেটি হল রাষ্ট্র পরিচালনায় বা দেশের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখার জন্য পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে যেসব মেধাবী/বিশেষজ্ঞদের অন্তর্বর্তী সরকারে জড়ো করা হয়েছে তারা অন্তর থেকে খুব সম্ভব দেশের প্রতি তথা দেশের মানুষের প্রতি তেমন দায়বদ্ধ নন। তারা যদি দ্বায়বদ্ধ হতেন তবে দেশ ছেড়ে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে বিদেশে পাড়ি দিতেন না। বাকী যারা আছেন তারাও কাজ করেছেন এন জি ও তথা মাইক্রো লেবেলেক্ষুদ্র গণ্ডিতে ম্যাক্রো লেবেল বা বৃহত্তর পরিসরে নয়। পরিণতিতে এসব মিলিয়ে আমাদের সর্া্বিক রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এক ধরনের কানাগলিতে ঘুরপাক খাওয়ার অবস্থায় পড়ে গেছে।

এসব অবলোকন করে মাঝে মাঝে ভাবি আমরা কি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাস ‘দি সান অলসো রাইজেস’ এ বেদনাময় এক প্রেক্ষাপট বা পটভূমিতে সৃষ্ট ‘দি লস্ট জেনারেশন’ এর কবলে কবলিত কিনা? আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তার এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন কী করে একদল মানুষ ঘর থেকে বের হওয়ার আগে নিকটজনদের তথা ভাইবোন, মা বাবা, স্ত্রী সবাইকে আশার বাণী শুনায় তারা সাগরে যাচ্ছে মাছ ধরতে। কিন্ত্তু বাস্তবে তারা সাগরে না গিয়ে যায় সুরি খানায়। দিনভর আকণ্ঠ মদ পান করে মদের নেশা কাটতে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। বাড়িতে আপন জনরা আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় থাকে মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরবে স্বজনরা, যারা সাগরে গেছে। ঢুলু ঢুলু চোখে তারা বাড়ি ফিরে শুন্য হাতে, ‘অশান্ত সাগরের প্রবল ঢেউয়ে মাছ মারতে পারিনি একটাও’ এমন মিথ্যার বেসাতিতে আপন জনদের ভোলায় সাগরে না গিয়ে সুরি খানায় সময় কাটানোরা। আশায় বুক বেঁধে থাকা দুর্ভাগা মানুষগুলি সময় কাটায় অনাহার অর্ধাহারে। এটি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাসের ‘লস্ট জেনারেশান’ দের নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।

আমরাও কি তবে এখন তেমন কিছুর মুখামুখি? সাম্প্রতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের ওয়ালে এমন আশঙ্কা প্রকাশিত হচ্ছে অনবরত। যেমন হোসেন তৌফিক নামের একজন লিখেছেন ‘আপনারা সফল, চূড়ান্তভাবে সফল। যে হাতে কলম ধরে বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন আঁকার কথা ছিল, সেই হাতে আপনারা ধরিয়ে দিয়েছেন অন্ধ শ্লোগানের পতাকা। যে মাথায় ধারণ করার কথা ছিল গণিতের জটিল সূত্র, সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন রাজনীতির নিকৃষ্টতম বিষ। ওদের কান্না ভেজা প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস আপনাদের বিলাসী হেলিকপ্টারের পাখা ঘোরায়। ওদের পোড়া ভবিষ্যৎ এর ছাই দিয়েই সাজানো আপনাদের হেয়ার রোডের বাগানবাড়ি। আজ যখন লাখো বাবার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার, লাখো মায়ের আঁচল ভিজছে কান্নার নোনা জলে, আপনারা তখন সেই ধ্বংস স্ত্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে বিজয়ের উল্লাস করছেন। এই প্রজন্মের প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস আপনাদের তাড়া করবে’।

যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক তেমন কোন অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকেই শুধু আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাপকাঠিতে ছাত্র প্রতিনিধিদের মন্ত্রীত্বের মত গুরু দায়িত্বে বসানো হয়েছে। সচিবালয়ের দ্বার বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের এমনকি প্রধান উপদেষ্টার অফিসের দ্বারও তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরিণতিতে এইসব তরুণ নেতা অর্জন থেকেও নানা রকম বিতর্কে জড়িয়ে জাতির পথ চলাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় ধাবিত না করে নানামুখি গোলকধাঁধা সৃষ্টি করেছেন। অথচ জাতির আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা ছিল যারা জাতি গঠনে, জাতীয় অগ্রগতি অর্জনের আন্দোলন সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করবেন তারা নিজেদের সকল লোভ লালসার উর্ধ্বে পরিশোধিত হিসাবে নিজেকে তুলে ধরবেন।

পরপর বিশ্বের দুই দুইটি পরাশক্তিকে প্রবল প্রতিরোধে পরাস্ত করে নিজেদের মুক্তি অর্জনকারী জাতিসত্তা ভিয়েতনামীদের একটি ঘটনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে যুক্তরাষ্ট্র অনুধাবন করে এ যুদ্ধ তাদের জন্য জয়ের নয় বরং পরাজয় কড়া নাড়ছে তাদের দরজায়। দীর্ঘদিনের সামরিক ব্যয়, বিপুল প্রাণহানি যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট বার্তা দেয় পরিণতির। যুক্তরাষ্ট্র এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে গিয়ে ভিয়েৎনামের সাথে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। এ প্রস্তাবে ভিয়েৎনামের আলোচক দলকে প্যারিসে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। আলোচনার আহবানে হ্যানয় সাড়া দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল প্রণেতাদের ধারনা ছিল আলোঝলমল প্যারিস শহরের ভোগ বিলাসে দীর্ঘদিনের গেরিলা যোদ্ধারা হয়ত আলোচনা টেবিলে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দিবে এবং অনেক নমনীয় হবে। ভিয়েৎনামের প্রতিনিধি দলে দুই নারী দুই পুরুষ। এই প্রতিনিধি দলকে পরিবহনের জন্য প্যারিস অর্লি বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল গাড়িবহর। সবাইকে হতবাক করে প্রতিনিধিদলটি ঐ গাড়িবহরে উঠেননি। বিনয়ের সাথে তারা জানান তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা তারা নিজেরাই করবেন।

উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রীয় অভ্যুত্থনাকারীরা জিজ্ঞেস করেন আপনারা কোথায় থাকবেন। প্রতি উত্তরে তারা জানান প্যারিসের উপকণ্ঠে ভিয়েৎনামী এক ছাত্র আছে তারা সেখানে তার বাসায় উঠবেন। এ উত্তরে আমেরিকানরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। আমেরিকানরা ভিয়েৎনামী প্রতিনিধি দলকে জানান তারা, তাদের জন্য বিশ্ব মানের হোটেল এবং খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

উত্তরে ভিয়েৎনামীরা যা জানান তা ইতিহাসে আত্মত্যাগের মহিমায় সমুজ্জল সংগ্রামী মানুষদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ভিয়েৎনামের দল নেতা জানান

আমরা পাহাড়ে আপনাদের বিরুদ্ধে লড়েছি, বনে জঙ্গলে ঘুমিয়েছে, অনেক সময় গাছের পাতা খেয়েও বেঁচে থেকেছি। আজ যদি কিছু সুযোগ সুবিধা পেয়ে আমরা আমাদের জীবনধারা বদলে ফেলি তাহলে শঙ্কা আমরা আমাদের বিবেকও যেকোন সময় যে কোন সুবিধার বিনিময়ে বিকিয়ে দিতে পারি। তিনি আরো বলেন যে ব্যক্তি বিবেক বিকিয়ে দিতে পারে সে যে কোনো সময় সুযোগের বিনিময়ে নিজের দেশও বিক্রি করে দিতে পারে।

চরিত্রের এই দৃঢ়তা, নৈতিক এই শক্তি নিয়ে প্যারিসের উপকণ্ঠে ভিয়েৎনামী ঐ ছাত্রের বাসায় গিয়ে উঠেন ভিয়েৎনামী প্রতিনিধি দল। কয়েকদিন পর শুরু হয় আমেরিকাভিয়েৎনাম আলোচনা। এই আলোচনা শেষ হয় ১৯৭৩ সালে প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে।

আমেরিকানরা বুঝে নেয় যারা বিলাসিতায় গা ভাসায় না তাদের সাথে যুদ্ধ জিতা সম্ভব নয়। প্যারিস চুক্তির ফলশ্রুতি মাত্র ৬০ দিনের মাথায় সমস্ত আমেরিকান সৈন্য ভিয়েতনাম ত্যাগ করে। ভিয়েতনামী অজেয় মানুষদের ইতিহাস এখানে থেমে থাকেনি। জেনারেল নগুয়েন ভ্যান গিয়াপ যার কৌশলের কাছে ফরাসী আমেরিকান দুই পরাশক্তির সৈন্য বাহিনী পরাস্ত। সেই জেনারেল গিয়াপ সফরে যান মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে। ঐ দেশে বিপ্লবী সরকার ক্ষমতাসীন। জেনারেল গিয়াপ দেখেন বিপ্লবীরা সেখানে রাজপ্রাসাদে বাস করেন। মূল্যবান সুগন্ধি ব্যবহার করেন। ভোগ বিলাসে গা ভাসিয়েছেন। সব দেখে জেনারেল গিয়াপ বলেন আপনাদের বিপ্লব সফল হবে না। বিস্মিত ঐ ভোগ বিলাসরত নেতারা জানতে চান কেন?

উত্তরে গিয়াপ বলেন ‘বিপ্লব আর বিলাসিতা কখনো এক সাথে চলতে পারে না। যে বিপ্লব নীতি, আর্দশ আর চেতনা দ্বারা পরিচালিত হয় না তা সন্ত্রাসে পরিনত হয়। গণ বিপ্লব তখন গণসন্ত্রাসে রূপ নেয়। যে বিপ্লবে নেতারা অর্থে গা ভাসায় পরিনামে সেই নেতা দিন যেতে গণ শক্রতে পরিণত হন।

ভিয়েতনামীদের সংগ্রাম কোনো যুদ্ধ ছিল না বরং এটি ছিল বিবেকের লড়াই। এখানে অস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী ছিল আদর্শ, বিলাসিতার চেয়েও প্রাধান্য পেয়েছিল আত্মত্যাগ আর অভীষ্টে পৌঁছার দৃঢ় সংকল্প।

একজন সংগ্রামী তিনিই, একজন বিপ্লবী তিনিই যিনি সম্পদে হয়ত ধনী নন কিন্ত্তু তার নীতি আদর্শে অটল। তিনি সময়ের সাথে বদলে যান না পরিস্থিতি বুঝে তিনি কখনো রঙ বদলান না।

চলমান রাজনৈতিক নানামুখী টানাপোড়েন দেখে মনে আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে, অনিশ্চয়তার ঘূর্ণাবর্তে কি আমার স্বদেশ? (চলবে)

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংস্কৃতির অন্তঃপ্রাণ মানুষ প্রদীপ ভট্টাচার্য
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে