সমকালের দর্পণ

গণহত্যা আর ধ্বংসলীলার বিচারবিহীন গাজা শান্তি চুক্তি -২

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ২৬ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

গত সংখ্যার লেখায় গাজা শান্তি চুক্তির ১৪ ধারা পর্যন্ত তুলে ধরেছিলাম। বাকী অংশ তুলে ধরে এ চুক্তি নিয়ে আজকের লেখা।

১৫। অবিলম্বে গাজায় মোতায়েনের লক্ষ্যে আমেরিকাআরব এবং আর্ন্তজাতিক অংশীজনদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী আই এস এফ (ইর্ন্টান্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স) গঠন করবে। আই এস এফ গাজায় প্যালেস্টাইনী পুলিশ বাহিনী গঠনে তাদের বাছাই এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। এক্ষেত্রে আই এস এফ জর্দান এবং মিশরের সহায়তা গ্রহণ করবে কারণ এ ব্যাপারে তাদের ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। গঠিতব্য বাহিনী দীর্ঘকালীন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। সীমান্ত নিরাপত্তায় আই এস এফ মিশর এবং ইসরাইলের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখে চলবে, এক্ষেত্রে তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্যালেস্টাইনী পুলিশ বাহিনীকেও সাথে রাখবে, গাজায় গোলাবারুদ প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরী এবং নিরাপদে সাহায্যসমূহের প্রবাহ সৃষ্টি একটি দুরূহ কাজ হবে এক্ষেত্রে সংঘাতবিহীন গাজা গঠনে সকল পক্ষ ঐক্যমত পোষণ করেছেন।

১৬। ইসরাইল গাজা দখল করবে না বা নিজের মাঝে অর্ন্তভুক্তিও করবে না। ইসরাইল, মিশর বা সন্নিহিত অঞ্চলের জন্য গাজা যখন হুমকি বা নিরাপত্তা বিঘ্নের কারণ হবে না এটি প্রতীয়মান হবে এবং যখন আইডিএফ (ইসরাইলী ডিফেন্স র্ফোসেস), আই এস এফ, নিঃশ্চয়তাপ্রদানকারী দেশসমূহ এবং আমেরিকা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবে তখন ইসরাইলী ডিফেন্স ফোর্সেস ক্রমান্বয়ে গাজা থেকে প্রত্যাহৃত হবে এবং গাজার নিয়ন্ত্রণ আই এস এফ’এর কাছে হস্তান্তর করবে।

১৭। হামাস এই চুক্তি কার্যকরণ বিলম্বিত করার প্রয়াস পেলে যেসব জায়গা সন্ত্রাসমুক্ত ঘোষণা করে আই ডি এফআই এস এফ’র কাছে হস্তান্তর করবে সেসব অঞ্চলে পূর্ণোদ্যমে ত্রাণ তৎপরতা পরিচালনা করা হবে।

১৮। শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে যে অগ্রগতি অর্জন সম্ভব তা তুলে ধরে গাজায় আন্তঃধর্মীয় পুনর্মিলনের জন্য মতবিনিময়মূলক সভা সমাবেশ, আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।

১৯। গাজার যথাযথ উন্নয়ন সাধনের পর এবং প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের পর প্যালেস্টাইনীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অথবা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনের বিষয় যা আমরা প্যালেস্টাইনীদের আখাংকা হিসাবে গণ্য করি তা বিবেচনা করা হবে।

২০। পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান, অগ্রগতি অর্জনে আমেরিকা প্যালেস্টাইন এবং ইসরাইলের মধ্যে কার্যকর সংলাপের আয়োজন করবে।

উপরোক্ত চুক্তির ধারাসমূহ বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা করলে অবশ্যম্ভাবীভাবে যে কোন যুক্তিবাদী মানুষের কাছে যে বিষয়টি স্পষ্ট হবে সেটি হল এ চুক্তিটি হামাস’এর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার অকাট্য প্রমাণ চুক্তির নিম্নোক্ত ধারা সমূহ।

যেমন চুক্তির ৬ নাম্বার ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, সকল বন্দী বিনিময়ের পর হামাসের যেসব সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনে ইচ্ছুক হবেন তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হবে। হামাসের যেসব সদস্য গাজা ত্যাগ করে অন্যকোনো দেশে চলে যেতে ইচ্ছুক হবেন তাদের সে সুযোগ দেওয়া হবে।

৯ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে, গাজার প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং উন্নয়নের জন্য গঠিতব্য ‘দি বোর্ড অব পিস’ এর প্রধান হবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, এই বোর্ডে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদেরও মনোন্নয়ন দেওয়া হবে।

১৩ নাম্বার ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে ‘হামাস গাজার প্রশাসনে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ বা অন্য যেকোন প্রকার পন্থায় অংশগ্রহণে জড়িত না থাকার সম্মতি প্রদান করেছে। গাজার সকল প্রকার সামরিক স্থাপনা, অস্ত্রপাতি, টানেল ধ্বংস করা হবে’।

১৬ নাম্বার ধারাও হামাস’এর উপর এ চুক্তি চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে, যেমন এতে বলা হয়েছে, ‘যখন আই ডি এফ (ইসরাইলী ডিফেন্স ফোর্সেস), আই এস এফ, নিশ্চয়তাপ্রদানকারী দেশসমূহ এবং আমেরিকা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবে যে গাজা কারো জন্য হুমকি হবে না,তখন ইসরাইলী ডিফেন্স ফোর্সেস ক্রমান্বয়ে গাজা থেকে প্রত্যাহৃত হবে এবং গাজার নিয়ন্ত্রণ আই এস এফ’এর কাছে হস্তান্তর করবে’।

এ প্রসঙ্গে ৮ আগস্ট ২০২৫ ইসরাইলী মন্ত্রীসভা সামরিক অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে গাজা দখলে নেওয়ার প্রস্তাব এবং এ প্রস্তাবের সাথে গাজা সিটি দখলের বাইরে আরো যে পাঁচটি বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এগুলি বিবেচনায় নিলে ‘ইমপ্লিমেনটেশন স্টেপস ফর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফর এ কম্প্রেয়েনসিভ এনড অব গাজা ওয়ার’ এর ২০ দফা’র এক দারুষ এবং করুণ মিল খুঁজে পেতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ৮ আগস্ট ২০২৫ ইসরাইলী মন্ত্রীসভায় গৃহীত প্রস্তাবগুলি ছিল নিম্নরুপ :

১। হামাসকে পুরাপুরি নিরস্ত্রীকরণ, ২। সকল জিম্মি মুক্তকরণ, ৩। গাজাকে অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল হিসাবে গড়ে তোলা ৪। গাজায় ইসরাইলী সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ৫। গাজায় বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা যাতে ফিলিস্তিনি তথা হামাসের কোন অংশগ্রহণ থাকবে না।

আর্শ্চযের বিষয় হল এ চুক্তিতে গাজা’র নিরীহ হাজার হাজার মানুষের উপর পরিচালিতর এবং গাজায় পরিচালিত পৃথিবীর অদৃশ্যপূর্ব এক ধ্বংসলীলার বিচারের একটি শব্দও সংযোজিত হয় নাই। গাজা পুনর্গঠনে বা এর নিরাপত্তা রক্ষায় কোথাও হামাসকে সামান্যতম সম্পৃক্ত করার বিষয়ও উল্লেখ নাই।

দ্বি রাষ্ট্র যা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৪২ টি সদস্য রাষ্ট্র এবং নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের ১৪ টি দেশ দ্বারা স্বীকৃত তার ব্যাপারে কোন উচ্চবাচ্যও নাই।

ইতিহাসের নির্মম পাঠ হল ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূমিতে বালফোর ঘোষণা অনুযায়ী যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি স্বীয় বাসভূমি হারিয়ে উদ্ভাস্ত্তু হন। ইসরাইলী মিলিশিয়ারা পাশ্চাত্যের বিশেষ করে আমেরিকার মদদে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে ব্যাপক হারে উৎখাত করে। ফিলিস্তিনিদের উপর পরিচালিত জায়ানবাদের নিদারুন হত্যাকাণ্ড, ক্রমান্বয়ে লক্ষ ফিলিস্তিনিকে স্বীয় আবাসভূমি থেকে অত্যাচার নিপীড়নের মাধ্যমে উদ্বাস্ত্তুকরণ কোন কিছুই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা শান্তি চুক্তি ‘ইমপ্লিমেনটেশন স্টেপস ফর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফর এ কম্প্রেয়েনসিভ এনড অব গাজা ওয়ার’ শিরোনামের ২০ দফার ভাষ্যে স্থান পায়নি।

অতীতে যখন পৃথিবীর ভূরাজনীতির শক্তিধর পক্ষগুলি ভূস্বার্থ জনিত কারণে ফিলিস্তিনিদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন শেখ আহাম্মদ ইয়াসিন ১৯৮৭ সালে হামাস গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। তার এ পদক্ষেপ ছিল ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষার। আহাম্মদ ইয়াসিনও ছিলেন তখন স্বীয় বাসভূমি থেকে বিতাড়িত একজন উদ্বাস্ত্তু। অন্যায় অত্যাচারের কোনো সুরাহা না পেয়ে ৮ ডিসেম্বর ১৯৮৭ ফিলিস্তিনি সাধারণ জনগণ প্রতিবাদে উত্তাল হন। বহিঃপ্রকাশ ঘটে প্রথম ইন্তেফাদা’র । প্রথম ইন্তেফাদা ৮ ডিসেম্বর ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে চলমান থাকে।

২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে সব কিছুকে উপেক্ষা করে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী এ্যারিয়েল শ্যারন মুসলিমদের পবিত্র স্থান মসজিদুল আকসা পরিদর্শনে আসলে প্রতিবাদে শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তেফাদা যা ২০০৫ পর্যন্ত চলমান থাকে। উভয় ইন্তেফাদায় হাজার হাজার মানুষ আত্মাহুতি দেন। পশ্চিমের স্বার্থান্বেষী পক্ষাবলম্বনে ফিলিস্তিনিদের সকল ত্যাগ প্রতিকারের কোনো পথ খুঁজে পায়নি।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি, ২০ জানুয়ারি ২০২৫ আমি অনেক আগ্রহ ভরে ট্রামের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান দেখছি। ট্রাম আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বয়সী হিসাবে শপথ নিয়েছেন, সি এন এন এর ভাষ্যকার এ তথ্য প্রকাশ করে সাথে আরো একটি তথ্য দর্শকদের জ্ঞাতার্তে তুলে ধরেন তা হল কোন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম শপথ গ্রহণ। এসব আমাকে মোটেও আন্দোলিত করেনি। কিন্ত্তু যখন ফাদার এসে বাইবেল থেকে জলদ গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করলেন “প্রভু আমাদের দূরদর্শীতা, মানবিক শক্তি, ন্যায়পরানতার ক্ষমতা দান কর’। এ কথা গুলি উচ্চারিত হবার সময় আমার চোখ বারবার বিদায়ী আর শপথ নিতে যাওয়া দুই আমেরিকান প্রেসিডেন্টের দিকে নিবদ্ধ হচ্ছিল, তারা কি এই কথা গুলি মনে রেখেছিলেন বা মনে রাখবেন দায়িত্ব পালনকালীন।

অত্যাচার নীপিড়ন উৎখাত ইত্যাদির চলমান প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে ১৯৯৩ সালে ইসরাইল আর ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ওসলো চুক্তি স্বাাক্ষরিত হয়্‌। চুক্তি অনুযায়ী স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠন করার কথা। স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠন ত দূরের কথা ঐ চুক্তির সুযোগ নিয়ে ইসরাইলীরা ১৯৬৭ সালে দখল করা ফিলিস্তিনি ভূমির উপর দখল আরো বিস্তৃত করেছে মাত্র।

সাম্প্রতিকের গাজা যুদ্ধে শহীদ হওয়া হামাস’এর সামরিক প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়াত্রা ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশ্যে তার আহবানে লিখেছেন

স্বাধীনতার অবিচলতার এক

অবিনাশী জোয়ার সৃষ্টি করুন

এবং এ থেকে কখনো নিবৃত্ত হবেন না,

যতক্ষণ না পৃথিবী আমাদের

মাতৃভূমির উপর

আমাদের নায্য অধিকার

স্বীকার করে নেয়’

উপরোক্ত কথাগুলি যদি গাজার মানুষের মনে অনুরণিত হতে থাকে, তবে কি ট্রাম্পের আর ধ্বংসলীলার বিচারবিহীন গাজা’র এ শান্তি চুক্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে?

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানে এয়াছিন শাহ্‌ কলেজে ঈদে মিলাদুন্নবী (দঃ) ও ফাতেহা ইয়াজদাহুম