সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১২ অক্টোবর, ২০২৫ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সৌর্ন্দেয্যের এক অপূর্ব লীলাভূমির নাম। আমাদের র্পা্বত্যাঞ্চল, খাগড়াছড়িরাঙ্গামাটি বান্দরবান সবুজে শ্যামলে নৈসর্গিক এক জনপদ। এই জনপদে যেমন রয়েছে বিচিত্র বর্ণিল তেরটি উপজাতি তেমনি রয়েছে কঠোর পরিশ্রমী আর উৎপাদনশীল হাজারো বাঙালি জনগোষ্ঠীরও বসবাস।

এখানে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়। মেঘেরা ঝরিয়ে যায় ভালোবাসার জল। এ জল ঝর্না হয়ে কলকলিয়ে আকাঁবাকাঁ পথ বেয়ে মিশে কাপ্তাই হ্রদে।

এমন এক জনপদে সময়ে সময়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনায় সংঘাত সংর্ঘষের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। এখানে এ সংঘর্ষ সমূহের একটি স্পস্ট মেরুকরন বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, যা পাহাড়ী এবং বাঙালী অভিধায় অভিসিক্ত। পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘদিন নিযুক্তির সূত্রে আমি এ অঞ্চলের সহজ সরল মানুষগুলির সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এই কারণে যখনই এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে হন্তারক বিদ্বেষ নিয়ে মুখামুখি দাঁড়িয়েছে তা আমাকে শুধু ব্যতীতই করেনি বরং তা আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণও হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এর পিছনে কারণগুলি জানার চেষ্টাও আমি করেছি। আমি সমাজবিজ্ঞানী হলে হয়ত আমার পর্যবেক্ষণ সমাজ বিজ্ঞানের আলোকে সমাজ বিশ্লেষণের গভীরতর এক দ্যোতনায় সত্য উদ্ভাসিত হত। এটি হবার নয়। আমি সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান সমাজ বিভক্তি এবং এর পিছনে জাতি হিসাবে আমাদের ব্যর্থতা এবং এই সুযোগে ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে স্বার্থান্বেষী মহলের সংশ্লিষ্টতার বিষয়াদি এখানে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি।

এটি এখন কঠিন বাস্তব, পার্বত্য চট্টগ্রামে পুরা সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত। পাহাড়ী এবং বাঙালি। ফলশ্রুতিতে যে কোন ঘটনা সেটি চুরিচামারী হোক, জায়গা জমি নিয়ে বিরোধ হোক বা ধর্ষণের মত ন্যক্কারজনক ঘটনা হোক তা বিচারিক প্রক্রিয়ার আগেই পাহাড়ীবাঙালি বিভক্তির মাধ্যমে সে বিচার হাতে তুলে নেওয়ার নিন্দনীয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত এক উলঙ্গ প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। এরই প্রকৃষ্ট প্রমাণ ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রাতে খাগড়াছড়ির সিংঙ্গিনালায় মারমা তরুণীকে ধর্ষণ অভিযোগ পরবর্তী সহিংসতা এবং ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মোটর সাইকেল চুরির অভিযোগ পরবর্তী ব্যাপক সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ।

পার্বত্যাঞ্চলের বসবাসরত মানুষদের এ বিভক্তি মোচনে আমাদের রাজনৈতিক উদ্যোগ বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব বরাবরই চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। এর উদাহরণ ১৯৮০’র দশকে যখন হাজার হাজার বাঙালি পরিবারকে সমতল থেকে পাহাড়ে বসতি স্থাপনার্থে নিয়ে যাওয়ার সময় তৎকালীন নীতি নির্ধারকরা গোড়ায় একটি গলদ রেখে দেন। যা আমার দৃষ্টিতে বসতি স্থাপনকারীদের সমতল থেকে বসতি স্থাপনে পাহাড়ের মানুষদের সাথে সৌজন্য স্থাপনে কি ধরনের ব্যবহার করা উচিত একই সাথে পাহাড়ে বসবাসকারীদেরকেও কোন প্রেক্ষিতে সমতলের মানুষকে পাহাড়ে বসতি স্থাপনে আনা হচ্ছে তার একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে দুটি পক্ষের মাঝে এক ধরনের মেল বন্ধন হয়ত সৃষ্টি করা যেত। এ ব্যাপারে সে সময় কিছুই করা হয়নি আর এখনও সেরকম কিছু লক্ষ্যণীয় নয়।

১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তিতে পার্বত্য রিজিওনাল কাউন্সিল, জেলা পরিষদ সমূহে উপজাতীয়দের জন্য চেয়্যারম্যান পদটি আজীবনের জন্য নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। এ ব্যবস্থা হয়ত একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হতে পারত অতঃপর এটি আপনাআপনি রহিত হয়ে যেত। সে ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি হয়ত দুটি পক্ষের পুনর্মিলনের পরিবর্তে দূরত্বই সৃষ্টি করে যাবে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সমূহের মনস্তত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে সামরিক সমস্যা হিসাবেই বেশী করে বিবেচনা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ফলশ্রুতিতে তারা সামরিক বাহিনীর দিক থেকেই এ সমস্যার সমাধান প্রত্যাশা করেছেন। এরই কার্যকারণ হিসাবে দেখা গেছে সামরিক বাহিনীকে পার্বত্যাঞ্চলে একাধারে সৈনিকের, উদ্বুদ্ধকারকের এবং রাজনীতিকের ভূমিকা পালন করতে। এটি রাজনীতিবিদ বা সরকারের নীতি নির্ধারকদের অদূরদর্শীতার পরিচায়ক। ফলে ভূরাজনীতির লক্ষ্য অর্জনে তৎপর মহল তাদের লক্ষ্য অর্জনে একটি তৈরী ক্ষেত্র সহজেই পেয়ে যেতে পারে। এরকম ক্ষেত্র পেয়ে অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাইরের শক্তি সময়ে সময়ে হস্তক্ষেপের হাত বাড়িয়েছে, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী সেসব হস্তক্ষেপ সাফল্যের সাথে বিফল করেছে। হস্তক্ষেপের এসব বিষয় পরবর্তী লেখায় তুলে ধরার ইচ্ছে আছে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে পাঠকদের পার্বত্যাঞ্চলের কিছু বিষয় অবগত করাতে চাই।

র্পা্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, পূর্বে মিজোরাম, পূর্ব দক্ষিণে মায়ানমার এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রামের দক্ষিণ পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান। ৫,০৯৫ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে এর বিস্তৃতি, এটি বাংলাদেশের প্রায় এক দশমাংশ। পার্বত্য এই অঞ্চল প্রায় পুরাটাই পাহাড় ঢাকা। উত্তর থেকে দক্ষিণের পাহাড় শ্রেণী তুলনামূলক ভাবে খাড়া। র্পা্বত্য চট্টগ্রামের উত্তারাঞ্চল তথা খাগড়াছড়ি থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে বয়ে গেছে তিনটি নদী যথাক্রমে চেঙ্গী, মাইনী এবং কাচালঙ্গ। এই তিন নদীকে ঘিরে তিন উপত্যকা চেঙ্গী, মাইনী এবং কাচালঙ্গ। দক্ষিণে তথা বান্দরবানকে ঘিরে তিন নদী যথাক্রমে সাংগু, মাতামুহুরি আর রাইকিয়াং এবং এদের ঘিরে তিন উপত্যকা। মধ্যে রাঙ্গামাটি, বুকে ধরে আছে বিপুল জলরাশির মানুষ সৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদ। এ হ্রদ প্রায় ৩৫০ বর্গমাইল বিস্তৃত। র্পা্বত্য চট্টগ্রামে সংরক্ষিত বনভূমি রয়েছে প্রায় ১৪০০ বর্গমাইল জুড়ে। এই সংরক্ষিত বনভূমির মধ্যে কাচালং, সাংগু, রাইকিয়াং এবং মাতামুহুরি অঞ্চল অন্যতম। সমগ্র র্পা্বত্য চট্টগ্রাম মোট ৩৬৫টি মৌজা নিয়ে গঠিত। প্রতি মৌজায় রয়েছেন একজন হেডম্যান। কয়েকটি পাড়া নিয়ে একটি মৌজা। প্রতিটি পাড়া একজন কারবারীর শাসনাধীন।

প্রকৃতির অর্পূব লীলাভূমি র্পা্বত্য চট্টগ্রাম ১৮৬০ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা লাভ করে। পরবর্তীতে প্রশাসনিক সুবির্ধাথে র্পা্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি র্সাকেলে বিভক্ত করা হয়। ১৮৮১ সালের এই প্রশাসনিক পদক্ষেপে তিনটি সার্কেলকে যথাক্রমে চাকমা, বোমাং এবং মঙ সার্কেল হিসাবে নামকরণ করা হয়। চাকমা সার্কেলের সদর দপ্তর করা হয় রাঙ্গামাটিতে, এর আয়তন ২৪২১ বর্গমাইল। বোমাং সার্কেলের সদর দপ্তর করা হয় বান্দরবানে, এর আয়তন ২০৬৪ বর্গমাইল এবং মঙ র্সাকেলের সদর দপ্তর করা হয় মানিকছড়িতে এর আয়তন ৬৫৩ বর্গমাইল।

১৯৮৩ সালে এই তিনটি সার্কেল চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেলকে তিনটি র্পা্বত্য জেলা যথাক্রমে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান র্পা্বত্য জেলা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। রাঙ্গামাটী জেলার অধীনে উপজেলা ১০টি খাগড়াছড়ির অধীনে উপজেলা ৮টি এবং বান্দরবান জেলার অধীনে উপজেলা রয়েছে ৭টি।

৬ মার্চ ১৯৮৯ সালে বলবৎকৃত স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন কর্তৃক তিনটি র্পা্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ এবং জেলা প্রশাসক দ্বারা শাসিত হচ্ছে।

আমাদের প্রতি প্রকৃতির অপার দান র্পা্বত্য চট্টগ্রাম পাকভারত স্বাধীনতা লগ্ন থেকে নানা ধরনের আঞ্চলিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। এ বির্তক সত্তরের দশকে এসে ভূরাজনীতির নানা কূটচালে জড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সশস্ত্র সংঘাতের মুখে ঠেলে দেয়। দীর্ঘ দু দশকেরও বেশী সময় র্পা্বত্য চট্টগ্রামে বয়ে যায় সংঘাত সংঘর্ষের ঝড়ো হাওয়া। অপার সম্ভাবনার পার্বত্য চট্টগ্রাম হন্তারক সময়ের যাতাকলে পিষ্ট হতে থাকে ক্রমাগত।

সরকার গঠনের পরপরই তৎকালীন সরকার তার অগ্রাধিকার তালিকায় স্থান দেন র্পা্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপনকে। দীর্ঘ দুদশকেরও বেশি সময় ধরে পাহাড়ের সংঘাত সংঘর্ষের পাগলা ঘোড়ার লাগাম তারা শক্ত হাতে টেনে ধরেন। ক্ষমতা গ্রহণের দ্রুততম সময়ে বিচক্ষণতা আর দূরদর্শিতায় ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ তৎকালীন সরকার শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর নিশ্চিত করেন। চুক্তি অনুযায়ী র্পা্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।

এরই ফলশ্রুতিতে সংঘাতের, রক্তক্ষরণের জনপদ পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্রমে শান্তির সুবাতাসে আন্দোলিত হয়। অস্ত্রের ঝনঝনানির পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মহোৎসবের প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত হয়ে ওঠে। শুরু হয় যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন। এ যোগাযোগ ব্যবস্থা র্পা্বত্য চট্টগ্রামের এক সর্া্বিক উন্নয়নে বয়ে আনে আমূল পরির্বতন। যোগাযোগ ব্যবস্থার এ উন্নয়নের পথ বেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের যেকোন নাগরিক চট্টগ্রাম থেকে উত্তরের ফটিকছড়ি খাগড়াছড়ি বাঘাইহাট হয়ে অপরূপ সাজেকের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। চট্টগ্রাম থেকে সোজা পূর্বের পথ ধরে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ঘাঘড়া, মানিকছড়ি হয়ে রাঙ্গামাটি, অবলীলায় এখান থেকে পর্যটক মাত্রই চলে যেতে পারবেন সুবলং মাইনীর রূপ দর্শনে মুগ্ধতায় আপ্লুত হতে।

চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণে কক্সবাজারের পথ ধরে চলে গেলে কেরানিহাট হয়ে হয়ে বান্দরবান। বান্দরবান হয়ে দক্ষিণে চিম্বুক আরো পরে নীলগিরি মেঘেদের সাথে গলাগলি, আরো দক্ষিণে চলে গেলে থানচি রূপের অর্পূব পসরা বিছিয়ে আছে।

কাপ্তাই হ্রদ। রাঙ্গামাটি থেকে এ হ্রদে জনযান ভাসিয়ে আপনি উত্তরে শিশকমুখমারিশ্যা যেতে পারেন প্রকৃতির কোলে স্নাত হতে হতে। রাঙ্গামাটি থেকে দক্ষিণে কাপ্তাই। হ্রদের বুকে মেঘেদের প্রতিচ্ছবি আর দুপাশে আকাশে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকা পাহাড় শ্রেণী। নৈসর্গের এই লীলাভূমি তার অপার মোহন সৌন্দের্যে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ করে রাখছে পর্যটকদের। সড়ক পথে পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম এখন উত্তর থেকে দক্ষিণে সরাসরি সংযুক্ত। উত্তরের সাজেক থেকে আপনি যাত্রা করলে, বাঘাইহাট, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি, মহালছড়ি মানিকছড়ি ঘাঘড়া হয়ে কাপ্তাই। কাপ্তাই থেকে নির্বিঘ্নে আপনি পৌঁছাতে পারেন বান্দরবান। এসব পথের দৃশ্য স্বর্গীয়। এ পর্যটন এ যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে শান্তি চুক্তির ফলস্বরূপ। (চলবে)

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক, সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের ঐতিহ্য জৌলুসে সমৃদ্ধ আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা
পরবর্তী নিবন্ধগ্লোবাল স্পেস চ্যালেঞ্জে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন চুয়েটের টিম এসরো