সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ৫ অক্টোবর, ২০২৫ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

যে বিষবৃক্ষের ফল এখন পৃথিবী ভোগ করছে

১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট জাপানী শহর হিরোশিমা’য় ৬.৪ কিলোগ্রাম ওজনের প্লুটুনিয়াম ‘ফ্যাটম্যান’ এবং নাগাসাকিতে ৬০ কিলোগ্রাম ওজনের ইউরেনিয়াম ‘লিটল বয়’ নাম দিয়ে আমেরিকানরা পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এই বিস্ফোরণে প্রায় ২৫০০০০ (আড়াই লক্ষ) মানুষ বোমাবর্ষণের সাথে সাথেই গলিত লাভায় পরিনত হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ পারমাণবিক তেজক্রিয়ায় পরবর্তীতে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেন। বলাবাহুল্য এইসব মানুষেরা ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। বিষণ্ন বিমর্ষ বিস্ময়াবিভূত পৃথিবীর মানুষ বোবা কান্না বুকে নিয়ে সে দৃশ্য দেখে। আমার জানা মতে পৃথিবীর শোকস্তব্ধ মানুষেরা হিরোশিমা-নাগাসাকি’র মানব ইতিহাসের সে বেদনা বিধূর দৃশ্য দেখেছে বিপন্ন এক পৃথিবীর বুকে দাড়িয়ে। লক্ষণীয় ৬ আগস্টের হিরোশিমার অবর্ণনীয় ধ্বংস লীলা দেখার পরও ৯ আগস্ট পুনরায় আমেরিকা নাগাসাকিতে দ্বিতীয় বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। কী হৃদয়হীন নিষ্ঠুর বর্বরতা।

সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের অবসান হয়। পৃথিবীর মানুষ মানুষের বর্বরতার হাত থেকে কিছুটা হলেও নিস্কৃতি লাভ করে। কিন্ত্তু পরিতাপ এবং দুর্ভাগ্যের বিষয় হল পৃথিবীর সচেতন মানুষেরা মানবতার বিরুদ্ধে তথা মানুষের বিরুদ্ধে আমেরিকার পরিচালিত গণহত্যার জন্য আমেরিকাকে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য কোন সোচ্চার দাবী উত্থাপন করেনি।

এমন এক প্রেক্ষাপটকে পিছনে রেখে পৃথিবীর বুকে যেন আর কোন বিশ্ব-যুদ্ধ নেমে না আসে সে লক্ষ্যে গঠিত হয় জাতিসংঘ। ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনে পারমাণবিক অস্ত্রকে মানব বিধ্বংসী আখ্যায়িত করে এ অস্ত্রের বিলোপ সাধনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।

এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, জাতিসংঘের গঠন প্রক্রিয়ায় একে বিকলাঙ্গ অথর্ব ক্লিব হিসাবে সৃষ্টি করা হয়। এই অথর্বতার নাম হল পাঁচ স্থায়ী সদস্য আর তাদেরকে দেওয়া ভেটো পাওয়ার। ফলশ্রুতি পৃথিবীর সবদেশ তথা সব মানুষও যদি একটি সম্মত সিদ্ধান্তে আসে তাহলেও এই পাঁচ দেশের যে কোন একটি দ্বিমত পোষণ করলে যত সম্মত সিদ্ধান্তই হোক তা আর কার্যকরী হবে না। এরই প্রমাণ রোহিঙ্গা বিষয়ক সিদ্ধান্তে চীন রাশিয়ার ভেটো, এরই জলজ্যান্ত প্রমাণ নিরাপত্তা পরিষদের সবদেশ একমত কিন্ত্তু গাজায় গণহত্যা বন্ধে আমেরিকার সায় নাই অতএব গাজায় ইসরাইল কর্তৃক গণহত্যা চলেই যাচ্ছে। পৃথিবীর শান্তি স্থিতিশীলতার জন্য কি মহাসৃষ্টি!

১৯৫৩ সালের ৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অষ্টম অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডেইট ডি আইসেন হাওয়ার তার বিখ্যাত বক্তব্য “এটম ফর পীস” উপস্থাপন করেন। এই বক্তব্যে আইসেন হাওয়ার পারমাণবিক শক্তির ধ্বংসলীলার বিষয়টি তুলে ধরে এর বিস্তার রোধে পৃথিবীকে সংঘবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণের উদাত্ত আহবান জানান। the dread secret and the fearful engines of atomic might are not ours alone….If at one time the United States possessed what might have been called a monopoly of atomic power, that monopoly ceased to exist several years ago….the knowledge now possessed by several nations will eventually be shared by others, possibly all others.

‘পারমাণবিক শক্তির লোমহর্ষক গোপনীয়তা আর বিভৎস শক্তির অধিকারী আর আমরা একা নই, এক সময় এই শক্তির একক অধিকারী হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গণ্য করা হলেও এখন আর তা সত্য নয়, এই একচেটিয়ার অধিকার ছয় সাত বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছে। পারমাণবিক শক্তির গোপনীয়তা তথা জ্ঞান এখন অনেক দেশরই রয়েছে এবং এখন থেকে আরো বেশি সংখ্যক দেশ তা জেনে যাবে সম্ভবতএকসময় সব দেশই জেনে যাবে’। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডেইট ডি আইসেন হাওয়ার তার চার্তুয্যপূর্ণ ভাষণে পারমাণবিক শক্তির প্রলয় যেন পৃথিবী বিপন্ন হয়ে না পড়ে সে জন্য পারমাণবিক শক্তির বিস্তার রোধে বিশ্বকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

আর এ থেকেই আনবিক শক্তির ‘নন প্রলিফেরেশন’ বা এনপিটি বা নন প্রলিফেরেশন ট্রিটি’র যাত্রা শুরু।

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট তার ভাষনে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে জোর দেন, এতে বলা হয় যেসব দেশ শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারে উদ্যোগী হবে তাদের র্স্বোতভাবে সহায়তা প্রদান করা হবে। তবে পারমাণবিক শক্তি সামরিক উদ্দেশ্য তথা একে মারণাস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। পারমাণবিক শক্তিকে মারণাস্ত্র হিসাবে ব্যবহার না করা বা সে লক্ষ্যে কোন দেশের প্রণীত পরিকল্পনাকে নিবারণ করার জন্য ১৯৫৭ সালে আই এ ই এ বা আন্তর্জাতিক এ্যাটমিক এনার্জি এসোসিয়েশান গঠিত হয়।

আইসেন হাওয়ার’ এর ভাষণ জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টল র্চাচিল এক ধাপ এগিয়ে আইসেন হাওয়ার’এর ভাষণকে উল্লেখ করেন ‘ a great pronouncement ’ অর্থাৎ এ এক মহৎ ঘোষণা। আর ইউরেপিয়রা একে অভিনন্দিত করে ‘ most significant America had yet delivered at the UN ’ জাতিসংঘে এ যাবতকালে আমেরিকার সবচেয়ে বড় অবদান। আরব উপদ্বীপের নেতারাও আইসেন হাওয়ার’ এর ভাষণকে ‘মারহাবা মারহাবা’ বলে অভিনন্দিত করে।

কিন্ত্তু সেদিন একটি দেশ যা বুঝার বুঝে নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল, শুধু বেলজিয়ান প্রতিনিধিদল সেদিন জাতিসংঘে উল্লেখ করেছিলেন, তথা প্রতিবাদ করেছিলেন এই বলেthe proposal was insufficient because it excluded any disarmament commitments and left the USA and the USSR with their nuclear stockpiles. অর্থাৎ আইসেন হাওয়ার-এর ভাষণে উত্থাপিত প্রস্তাবনা অসম্পূর্ণ এবং যথার্থ নয়, এ প্রস্তাবে আমেরিকা এবং সোভিয়েৎ ইউনিয়নের কাছে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের নিরস্ত্রীকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত কিছুই উল্লেখ নাই। সেদিন বেলজিয়ান প্রতিনিধিদল যে টুদূরপ্রসারী চিন্তা এবং আগামীর আশঙ্কাকে ধারণ করতে পেরেছিলেন বাকীরা তাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন চুড়ান্তভাবে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সেই অনুধাবনে ব্যর্থতা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডেইট ডি আইসেন হাওয়ার’এর কূটনৈতিক চাতুর্য বিশ্বকে তখন এখন এবং ভবিষ্যৎ এর জন্য এক বিভিষিকাময় বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

বিশ্বকে বিপন্ন করার নিয়তই ধ্বংসের মুখামুখি করার সে যাত্রায় একে একে সামিল হয় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত এবং পাকিস্তান।

১৯৫২ সালের ৩ অক্টোবর যুক্তরাজ্য অষ্ট্রেলিয়ার ওয়েস্ট কোস্টে তার পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। ১৯৬০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সাহারা মরুভূমিতে ফ্রান্স তার পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। ১৯৬৪ সালের ১৬ অক্টোবর চীন জিয়ানজিয়াং এ তার পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। ১৯৭৪ সালের ১৮ মে ভারত রাজস্থানের মরুভূমিতে তার পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।

১৯৯৮ সালে পর পর পাঁচটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাকিস্তান তার পারমাণবিক শক্তি অর্জনের বিষয়টি বিশ্বকে জানান দেয়। এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও এটা নিশ্চিত ইসরাইল পারমাণবিক বোমার মওজুদ গড়ে তুলেছে। ১৯৭৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইসরাইল এবং তৎকালীন বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা যৌথভাবে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল সেই থেকে ইসরাইল পারমাণবিক বোমার অধিকারী এটা নিশ্চিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এটি নিতান্ত লজ্জার এবং দুর্ভাগ্যের যে তারা ইসরাইলকে আই এইএ বা আন্তর্জাতিক এ্যাটমিক এনার্জি এসোসিয়েশান এর আওতায় আনতে পারেনি। ইসরাইলের এই ঔদ্ধ্যত্যের পিছনে আমেরিকার মদদই হয়ত কাজ করে যাচ্ছে।

আমার দৃষ্টিতে বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘ তার যাত্রারম্ভে দুটি মহা ভ্রান্তিকে ধারণ করে। স্থায়ী সদস্য তথা পাঁচটি দেশ আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং চীনকে ভেটো পাওয়ার দেওয়া। এই ভুলের পরিণতি জাতিসংঘের সমস্ত সদস্য একত্রিত হয়ে একটি সিদ্ধান্তে ভোট দিলেও ভেটো অধিকারীর স্বার্থে এর কোন ব্যত্যয় হলে ভেটো প্রয়োগে তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। গাজা’র যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে এর উলঙ্গ বহিপ্রকাশ বিশ্ব সম্প্রদায় বেদনার্ত চিত্তে প্রত্যক্ষ করেছে অহরহ। ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘ একটি অর্থব অক্ষম সংস্থা হিসাবে পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কাছে প্রতি নিয়তই প্রতিভাত হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত ১৯৫৩ সালের ৮ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অষ্ঠম অধিবেশনে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডেইট ডি আইসেন হাওয়ার এর বিখ্যাত ভাষণ ‘এটম ফর পীস’। এ ভাষণের উপর পরবর্তীতে ‘নন প্রলিফেরেশন’ বা এনপিটি বা নন প্রলিফেরেশন ট্রিটি’র উদ্ভব। অথচ সেদিন যদি প্রস্তাব গৃহীত হত পারমাণবিক অস্ত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, পৃথিবীর শোকাস্তব্ধ মানুষেরা হিরোশিমা-নাগাসাকি’র মানব ইতিহাসের সে বেদনা বিধূর দৃশ্য সদ্য অবলোকন করেছে মাত্র, এজন্য সে সময় ছিল উপযুক্ত সময় পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধের প্রস্তাব উত্থাপন করার। অথচ সেটি হয়নি, এমনকি আমেরিকার দ্বারা সংঘটিত হিরোশিমা-নাগাসাকি’র পাপ মোচনের জন্য মার্জনা ভিক্ষার কোন জোরালো দাবীও পৃথিবীর সভ্য মানুষেরা তোলেনি। এরই পরিণতি পৃথিবীতে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার, পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টা।

এরই ফলশ্রুতি পারমাণবিক শক্তিধরদের সময়ে সময়ে মুখামুখি হওয়া আর পৃথিবীর ধ্বংস হওয়ার খাদের কিনারায় পৌঁছে যাওয়া। এরই মাঝে পশ্চিমারা পরমাণু চুক্তির নানা অজুহাতে ‘নিষেধাজ্ঞা’র সিন্ধবাদের দৈত্য হয়ে ইরানের ওপর চেপে বসেছে। পরিত্রাণের পথ খুঁজতে ইরান ইতিমধ্যে রাশিয়ার সাথে ২৫ বিলিয়ন ডলারের পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ নিয়ে পরবর্তীতে লেখার ইচ্ছা আছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ মানবপাচার- বিরোধী পদক্ষেপ জোরদার করেছে
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে