সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৯:০৪ পূর্বাহ্ণ

১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সৌদি আরব এবং ফ্রান্স, প্যালেস্টাইন এবং ইসরাইল এর মধ্য বিদ্যমান দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্যালেস্টাইন এবং ইসরাইল দ্বি রাষ্ট্র গঠনের একটি যৌথ প্রস্তাব উত্থাপন করে। আনিত এ প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১৪২ ভোট, বিপক্ষে ১০ ভোট এবং ১২ টি দেশ ভোট দানে বিরত থাকে। উল্লেখ্য বিপক্ষের এ ১০ ভোটের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অন্তর্ভুক্ত বাকী ৯ দেশের মধ্যে রয়েছে খোদ ইসরাইল, আর্জেন্টিনা, হাঙ্গেরি, মাইক্রোনেশিয়া, নাউরু, পালাউ, পাপুয়া নিউগিনি, প্যারাগুয়ে এবং টোঙ্গা। নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত এই প্রস্তাবকে ‘নিউইর্য়ক ডিক্লারেশন’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অনেকের ধারণা ‘নিউইর্য়ক ডিক্লারেশন’ হয়ত দীর্ঘ প্রায় ৮০ বছর ধরে চলে আসা মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ করে নিপীড়িত প্যালেস্টাইনীদের জন্য একটি নিরাপত্তা নিশ্চিতের উপায় হবে। জুলাই ২০২৫ থেকে চলে আসা এ উদ্যোগের সফল সমাপ্তির পূর্বে জাতিসংঘের মহাসচিব তার মন্তব্যে উল্লেখ করেন the central question for Middle East peace is implementation of the two State solustion where two independent sovereign, domocratic States Isreal and palestine live side by side in peace and security’. এর সরল অর্থ হল মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের মূল কেন্দ্রে রয়েছে দুই রাষ্ট্র প্যালেস্টাইন এবং ইসরাইল প্রতিষ্ঠা, দুটি রাষ্ট্রই হবে স্বাধীন, র্সা্বভৌম, গণতান্ত্রিক। প্যালেস্টাইনইসরাইল শান্তি এবং নিরাপত্তার সাথে পারস্পরিক সৎ প্রতিবেশী হিসাবে বসবাস করবে।

দুর্ভাগ্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সৌদি আরব এবং ফ্রান্স’এর এ প্রস্তাব উত্থাপিত হতেই ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন প্যালেস্টাইন বলে কোন রাষ্ট্র হবে না। একই সময় তিনি পশ্চিমতীরকে বিভক্ত করে একটি ডিক্রিও জারী করেন। এতে পশ্চিমতীরে ইসরাইলী বসতি স্থাপনের পথকে সুগম করা হয়। অথচ এই পশ্চিমতীর প্যালেস্টাইনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নেতানিয়াহু’র এ ঘোষণার সাথে চরম দক্ষিণপন্থী ইসরাইলী অর্থমন্ত্রী আরো এক দাপ এগিয়ে ঘোষণা করেন, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের পদক্ষেপ পশ্চিমা দেশগুলির প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ার উত্তর, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের পদক্ষেপ এর উদ্যোগ প্যালেস্টাইনের কফিনে একেকটি পেরেক।

ইসরাইল কর্তৃক এসব ঘোষণা এসব উদ্যোগ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রতি একই সাথে আন্তর্জাতিক সমস্ত রীতিনীতির প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শনের নামান্তর।

ইসরাইল ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সমস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রতি উপেক্ষা, আন্তর্জাতিক আইন এবং সিদ্ধান্ত লংঘনে চরম বেপরোয়া পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে।

বেপরোয়া এই কর্মকাণ্ডের মাঝে সিরিয়ায়, লেবাননে, ইয়েমেনে, তিউনিসিয়ায়, ইরাকে, গাজার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য মানবাধিকার সংস্থা সমূহের খাদ্যবাহী ফ্লোটিলায় বোমাবর্ষণ উল্লেখযোগ্য।

ইসরাইলের ইরান আক্রমণ ছিল বিশ্ব শান্তির প্রতি চরম উসকানিমূলক। একসময় ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পৃথিবীব্যাপী এ যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা সৃষ্টি করেছিল।

ইসরাইলী বেপরোয়া আচরণের র্স্বশেষ উদাহরণ কাতারের রাজধানী দোহায় বিমান আক্রমণ। এই আক্রমণ পরিচালিত হয় আমেরিকার প্রস্তাবিত গাজা শান্তি আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে আসা হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে। এই হামলায় একজন কাতারি কর্মর্কতা সহ ছয়জন নিহত হন। কাতারে ইসরাইলী হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জড়িত না হলেও হামলা সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল। এই হামলায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠে।

কাতারে হামলা পরবর্তী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলের বিরুদ্ধে র্স্বসম্মত নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। কাতারের আহ্বানে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ দোহায় এই হামলায় করণীয় নির্ধারণে ওআইসি ভুক্ত এবং ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের রাষ্ট্র, সরকার প্রধান এবং প্রতিনিধিদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রাসিপ তাইয়েপ এরদোগান, ইরানী প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেস্কানি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল সিসি, জর্দানের বাদশা আবদুল্লাহ, সিরিয় প্রেসিডেন্ট আহাম্মেদ আল সারা, মালয়েশিয় প্রধানমন্ত্রী ডঃ আনোয়ার ইব্রাহিম, সম্মিলিত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান, সুদানিজ ট্রানজিশনাল কাউন্সিল প্রধান আবদুল ফাত্তাহ আল বুরহান, আলজেরিয় প্রেসিডেন্ট, লেবানিজ, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশসমূহের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি উজ্জ্বল এবং অর্থবহ করেছে নিঃসন্দেহে।

ক্রমবর্ধমান ইসরাইলী আগ্রাসন এর মুখে বিলম্বে হলেও মুসলিম বিশ্বের দেশসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের অবস্থান ভূরাজনীতির মোড়লদের সামনে তুলে ধরেছে। এই সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল:

সম্প্রসারণবাদী মনোভাব থেকে ইসরাইল কর্তৃক গাজায় ফিলিস্তিনীদের উপর পরিচালিত গণহত্যার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন।

৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ দোহায় ইসরাইল কর্তৃক কাপুরুষিত আক্রমণ পরিচালনার চরম পরিণতি সম্বন্ধে ইসরাইলের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ।

কাতারসহ পুরা ইসলামী দেশ সমূহের উপর যে কোন ধরনের আক্রমণ বা হুমকি মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঘোষণা।

কাতার শান্তি আলোচনার একটি নিরপেক্ষ ভেন্যু। কাতার এ পর্যন্ত সফলভাবে সংঘাত পরিহার করে বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি স্থাপনে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভূমিকা পালন করে এসেছে। এই কাতারের উপর আক্রমণকে ইসলামী বিশ্ব শান্তির উপর আক্রমণ বলে গণ্য করে।

কাতার, মিশর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গাজা শান্তি আলোচনাকে এই সম্মেলন সমর্থন জ্ঞাপন করে।

এই সম্মেলন কাতারের উপর পরিচালিত আক্রমণকে আন্তর্জাতিক সমস্ত আইন কানুন এবং রীতিনীতি লঙ্ঘন এবং গাজায় শান্তি স্থাপনের বিপক্ষে ইসরাইলী উলঙ্গ এক ন্যাক্কারজনক আক্রমণ বলে গণ্য করে।

মুসলিম বিশ্বের দেশ সমূহের কাতার সম্মেলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ‘Shared Vision for Security and Cooperation in the Region’ ঘোষণা অর্থাৎ নিরাপত্তা বিষয়ে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সহযোগিতা।

ইসরাইলের আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে মর্জিমাফিক অবস্থানের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে এ অবস্থা মোকাবেলার ঘোষণা।

গাজা, অধিকৃত পশ্চিমতীর ইত্যাদি অঞ্চলে ইসরাইল কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণের ব্যাপক দুর্দশা সৃষ্টির পরিণতি সম্পর্কে ইসরাইলকে সতর্ক করা হয়েছে।

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলের মাধ্যমে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে ইসরাইলকে চরম পরিণতি ভোগ করার বিষয়টি সম্মেলন থেকে ঘোষণা করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরাইলী সম্প্রসারণমূলক মনোভাবের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও এই সম্মেলন থেকে আহবান জানানো হয়। এ যাবৎকাল আন্তর্জাতিক পরাশক্তি বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলী আগ্রাসন বা বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি এরকম মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বানও এ সম্মেলন থেকে জানানো হয়।

উপরে আলোচিত বিষয়াদির বাইরে গিয়ে আমার মতে আরব দেশগুলি যেমন ইউ এ ই, ওমান, বাহরাইন, কাতার, সুদান, মরোক্কো দেশগুলি আব্রাহাম এ্যাকর্ড থেকে বেরিয়ে এসে ইসরাইলকে একটি কড়া বার্তা দিতে পারত, কিন্ত্তু কোন দেশই তা করেনি।

বর্তমানে একদিকে ইসরাইল যেমন সম্প্রসারণবাদী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে সে তার প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে কেউ যেন শক্তিশালী না থাকে সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইতিমধ্যে ইসরাইল অনেকটা সফল হয়েছেও বলা যায়। ইসরাইল তার পরিকল্পনা অনুসারে লেবাননে হিজবুল্লাহ তথা লেবাননকে, সিরিয়ার বাশার আল আসাদকে সরিয়ে ক্রমাগত সিরিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করে, ইয়েমেনে বোমাবর্ষণের মাধ্যমে সেদেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার মাধ্যমে, হামাসকে ক্রমাগত দুর্বল করার মাধ্যমে বৃহত্তর ইসরাইল গঠনের লক্ষ্যে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। দুর্বল প্রতিবেশীরা যেন ভবিষ্যৎ এ ইসরাইলকে কোন ধরনের ঝুঁকিতে বা চ্যালেঞ্জ করতে না পারে সে রকম একটি ভূরাজনৈতিক অবস্থার দিকে ইসরাইল তার পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে চলেছে। বলা বাহুল্য আমেরিকা ইসরাইলের এ কৌশলে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে চলেছে। কাতার আক্রমণের পর আমেরিকান পররাষ্ট্র মন্ত্রী রোবিও তেলআবিব পৌঁছে ইসরাইলকে সে নিশ্চয়তাই প্রদান করেছেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানে বস্ত্র বিতরণ