দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুই দেশ দুই বলয়ে দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে শীতল যুদ্ধের সূচনা করে। শীতল যুদ্ধের কবলে পড়ে পৃথিবীর নানা দেশ সংঘাত, সংঘর্ষ এবং যুদ্ধে জড়িয়ে বহু অঘটনের জন্ম দেয়। ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ইয়েমেন এবং জার্মানীর মত দেশ নিজেরা নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এমনকি জার্মানী নিজেদের মাঝে বিভক্তির দেওয়াল রচনা করে। সে দেওয়াল বার্লিন ওয়াল হিসাবে ইতিহাসে খ্যাতি অর্জন করে।
আমেরিকান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের এই দ্বিবিদ বলয় যেমন ছিল রাজনৈতিক তেমনি অর্থনীতির মতার্দশগতও। আমেরিকাকে ঘিরে গণতান্ত্রিক আর পুঁিজবাদী বিশ্ব আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আবর্তিত হয়। এরই মাঝে আমেরিকান এবং সোভিয়েতত ইউনিয়ন এই দুই বলয় পৃথিবীকে দুই সামরিক জোটেও বিভক্ত করে। ন্যাটো এবং ওয়ারশ।
৯০ এর দশকে এসে পুঁজিবাদী নানা কূটচাল এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বল নেতৃত্বের কবলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। এ অবস্থায় পৃথিবী দ্রুত একটি একক বলয়ের কবলে দাবিত হলেও তখনও চীন, কিউবা, ল্যাটিন আমেরিকান কিছু কিছু দেশ যার মধ্য নিকারগুয়া, ভেনিজুয়েলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ ইয়েমেনের মত দেশগুলি সমাজতান্ত্রিক ভাব ধারাকে সম্বল করে পথ চলতে থাকে। তবে এ চলা ছিল পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রবল বিপরীত স্রোতে।
১৩ জুন ১৯৯০ বার্লিন ওয়াল ভাঙার সময় তৎকালীন আমেরিকান পররাষ্ট্র মন্ত্রী জেমস বেকার রাশিয়ানদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন জার্মানীর পুনর্মিলন তথা একত্রিকরণের পর জার্মানী ন্যাটোভূক্ত থাকলে, ন্যাটো পূর্ব দিকে আর এক পাও এগুবে না। এমনও কথা হয়েছিল ওয়ারশ জোট ভেঙে দেওয়া হলে ন্যাটোও বিলুপ্তির পথে হাঁটবে।
ওয়ারশ জোট বিলুপ্ত হয়। ন্যাটো হয়নি। জেমস বেকারের আর এক পাও না আগানোর সেই প্রতিশ্রুতিও রাখা হয়নি। ন্যাটো ক্রমাগত একে একে পূর্বের সোভিয়েত বলয়ভুক্ত রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ইত্যাদি ছাড়াও এমনকি সোভিয়েতভুক্ত মোলদোবা, লিথুয়ানিয়া ইত্যাদিকে ন্যাটোভুক্ত করার পর ইউক্রেনের দিকে আগাতে থাকে।
এর মাঝে ভ্লাদিমির পুতিন’এর দৃঢ় এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে ৯০ এর দুর্বল রাশিয়ান ফেডারেশন সামরিক এবং অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকে নিজের ভিতকে মজবুত করে গড়ে তোলে।
পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়ান ফেডারেশন ইতিমধ্যে ন্যাটো জোটকে চ্যালেঞ্জ করার মত পর্যায়ে উপনীত হয়। রাশিয়ানরা এ সক্ষমতা ক্রিমিয়া দখলের সময় প্রর্দশন করে। ন্যাটোর কৌশল প্রণেতারা হয়ত বিষয়টিকে তখন ধর্তব্যের মধ্য নেননি।
পশ্চিমের শক্তির উন্মাদনা তাদের রাশিয়ার ন্যাটো জোটকে চ্যালেঞ্জ করার বিষয়টি ধর্তব্যের বাইরে রাখতে প্ররোচিত করে। এরই ফলশ্রুতি ন্যাটোর ক্রমাগত ইউক্রেন অভিমুখি নানা ধরনের উসকানি। পরিণতিতে রাশিয়ার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে ইউক্রেনে তার বিশেষ অভিযান শুরু করে।
ইউরোপিয় ইউনিয়ন, আমেরিকা তথা ন্যাটো তাদের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং যাবতীয় কূটনৈতিক শক্তি নিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ায়।
আমেরিকার ৩০০ (তিনশত) বিলিয়ন ডলার আর ইউরোপিয় ইউনিয়নের ১০০ (একশত) বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক সহযোগিতা, সামরিক সরবরাহ, কূটনৈতিক যত চাল কিছুই ইউক্রেনে রাশিয়ার অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করতে পারেনি। আমেরিকা রাশিয়ার উপর কড়া অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। অর্থাৎ রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যে জড়ালেই আমেরিকা তার সাথে বাণিজ্যে খড়গ হস্ত হবে।
আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধ ভোতা হয়ে যায় চীন এবং ভারতের রাশিয়া থেকে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানী আমদানীতে। ভারত শুধু আমদানীই করেনি, কমমূল্যে আমদানীকৃত ক্রুড নিজেদের শোধনাগারে পরিশোধিত করে সে জ্বালানী আবার অন্যদেশে রপ্তানী করে বিপুলভাবে লাভবানও হয়েছে। আমেরিকা দেখেও জেনেও চোখ বুজে সহ্য করেছে। এর পিছনের কারণ চীনের বিরুদ্ধে ভূ-রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বনে শক্তিশালী ভারতকে পাশে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এ কৌশলের অংশ হিসাবে ইন্দো-প্যাসিফিককে ঘিরে চীনের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা জোট ‘কোয়াড’ এ ভারত অন্যতম অংশীদার হিসাবে রয়েছেই।
এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। ট্রাম ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের তার প্রচেষ্টার কথা সরবে ঘোষণা করেন।
এ লক্ষ্যে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি’কে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিশ্ববাসীকে রীতিমত হতবাক করে, কূটনীতির সব রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে হায়াইট হাউজে জেলেনেস্কি’র সাথে এক ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়। ইলেট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে সে দৃশ্য আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
এরপর আসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন’এর সাথে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রামের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। এটি অনুষ্ঠিত হয় আলাস্কায়। সে বৈঠকের ফলাফলের দিকে বিশ্বের সমস্ত সচেতন মানুষের আগ্রহ ছিল ব্যাপক। সবাইকে হতাশ করে বৈঠক ফলাফল শুন্যভাবে শেষ হয়। কোন ধরনের যুদ্ধবিরতি ত নয়ই। অনুষ্ঠানের রেটিং এ দেখা গেল পুতিন ঐ বৈঠকে তার ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে শেষ করেছেন।
এসব দেখে শুনে সম্ভবত আমেরিকান ‘ডিভ স্টেট’ (এটি হল সরকারের ভিতর আরো শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী বা সরকার) অনুধাবন করে চীন এবং ভারতের রাশিয়া থেকে জ্বালানী আমদানি ভারত প্রাপ্ত অর্থ রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিচালনায় সক্ষমতা দান করে যাচ্ছে। রাশিয়ার সক্ষমতাকে দুর্বল করতে হলে তার জ্বালানী লব্ধ অর্থের উৎসে আঘাত করতে হবে অথবা তা বন্ধ করতে হবে।
যেহেতু ভারত রাশিয়া থেকে ক্রুড আমদানীকারক অন্যতম দেশ সুতরাং ভারতকে চাপ দিতে হবে রাশিয়া থেকে জ্বালানী আমদানী বন্ধ করতে। এ লক্ষ্যে প্রথম আমেরিকায় রপ্তানিকৃত ভারতীয় পণ্যের উপর ২৫% শুল্কারোপ করে হুমকি দেওয়া হয় রাশিয়ান জ্বালানী আমদানী বন্ধ করা না হলে এ শুল্কারোপ দ্বিগুণ করা হবে।
ভারত স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তাদের জ্বালানী নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা কোন প্রকার আপস করতে রাজি নয়। প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকায় রপ্তানিকৃত ভারতীয় পণ্যের উপর ২৫% শুল্কারোপ বাড়িয়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫০% করে।
এ বাস্তবতায় ৩১ আগস্ট -১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ চীনের তিয়ানজিয়ানে অনুষ্ঠিত হয় সাংহাই কো-অপারেশন কাউন্সিল এর সম্মেলন।
ভারত আমেরিকানদের দিক থেকে অনেকটা মুখ ফিরিয়ে সমস্ত মনোবেদনা বহন করে তিয়ানজিয়ানে হাজির হয়। র্স্বোচ্চ পর্যায়ে বৈঠক হয় চীন ভারতের। তারা দীর্ঘদিনে বৈরিতা ভুলে পরস্পরের কাছাকাছি এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্মতি জ্ঞাপন করে।
ভারত চীনের নৈকট্যের মাঝে উৎসুখ পর্যবেক্ষকরা ‘এশিয়ান সেঞ্চুরির’ আভাস খুঁজে পান। তাদের যুক্তি চীন ভারতের নৈকট্য অর্থ বিশ্বের ৩৫% উৎপাদনশীল মানুষের জোট বন্ধন।
তিয়ানজিয়ানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং আমেরিকার দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করে ঘোষণা করেন চীন কারো Bullying বা Intimidating অর্থাৎ চীন কারো ধমক বা ভয় দেখানোকে পরোয়া করে না। আমেরিকার বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ Prof Jeffrey Sachs (অধ্যাপক স্যাক্স) এবং John Mearshemer (অধ্যাপক জন মারসিমার) এর মত চিন্তাশীল মানুষেরা তিয়ানজিয়ানের এবারের সাংহাই কো-অপারেশন কাউন্সিল’এর ফলাফল আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির বির্পয্যয় হিসাবে বিবেচনায় নিয়েছেন।
এরই মাঝে সাংহাই কো-অপারেশন কাউন্সিল’কে ঘিরে তিয়ানজিয়ানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন’এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর হৃদ্যতাপূর্ণ হাস্যোজ্জ্বল ছবি বিশ্বের ভূ-রাজনীতি সচেতন মানুষদের পৃথিবীতে নতুন এক মেরুকরণের বার্তাও দিয়েছে। সাংহাই কো-অপারেশন কাউন্সিল’ শেষ হতেই দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধে জাপানীদের বিরুদ্ধে চীনের বিজয় উৎসব উৎযাপিত হয় ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫। তিয়ানমিন স্কোয়ারের এ সামরিক কুজকাওয়াজ পৃথিবীর মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখেছে। এ উৎসব ছিল চীনের সামরিক শক্তির উত্থানের এক অভূতপূর্ব প্রর্দশনী। এখানে ২০০০০ (বিশ হাজার) কিঃমিঃ দূরত্বের লক্ষ্যবস্ত্তুকে নিখুঁত নিশানায় পরিণত করতে সক্ষম পারমাণবিক ব্যালেস্টিক মিসাইল থেকে শুরু করে সমুদ্র তলদেশে শত্রুর লক্ষ্যবস্ত্তুতে হানা দিতে সক্ষম মনুষ্যবিহীন ড্রোন, সাবমেরিন হন্তারক টর্পেডো, ফিফথ জেনারেশন জঙ্গী বিমান ইত্যাদির বিভীষিকা জাগানো এক মহা প্রর্দশনী অনুষ্ঠিত হয়।
এ উৎসবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর পাশে উত্তর কোরিয় প্রেসিডেন্ট কিম ঝং উন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন’ এর সহাস্য উজ্জ্বল উপস্থিতি বিশ্বকে একটি স্পষ্ট র্বাতা দেয় যা হল পশ্চিমের পুঁজিবাদী তথাকথিত গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিপরীতে একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলির প্রবল শক্তিশালী একটি বলয় গড়ে উঠতে যাচ্ছে যা পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক বিশ্বের ভিতকে নড়বড়ে করে তুলতে পারে। এটি আঁচ করেই হয়ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম কিছুটা স্বগোক্তি করেছেন ‘ China, Russia and North korea conspiring against USA ’ অর্থাৎ চীন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া আমেরিকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। উল্লেখ্য চীনের সামরিক বাহিনী বর্তমান বিশ্বে বৃহত্তম। এমন এক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করে ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং স্বগৌরবে ঘোষণা করেন China’s rise is Ôunstoppable ’ চীনের উত্থান অপ্রতিরোধ্য এবং আগামী বিশ্ব তাই দেখতে যাচ্ছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।











