আমার সুহৃদ পাঠকরা নিশ্চয়ই পৃথিবীর দৃশ্যপটে একে একে মঞ্চস্থ হওয়া দৃশ্যাবলীর দিকে নজর রেখেছেন এটি আমি নিশ্চিত। এসব প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছি বাঙালি জাতির ইতিহাসে দেদীপ্যমান উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি তার জীবনের সোনালি সময় বাঙালি জাতিসত্তার উদগাতায় অকুণ্ঠ নির্ভীক চিত্তে নিবেদন করেছেন। সেই মানুষটির জন্যই তো লেখা হয়েছিল এই পংক্তিমালা–
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মত দীপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জন সমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার ব্রজকণ্ঠ বাণী?
গণ সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
১৫ আগস্ট স্বাধীনতার এই কবিকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৭২ সালে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ঊষালগ্নে সাম্্রজ্যবাদীদের সমস্ত রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিপীড়িত ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজ ফিলিস্তিনে বিশেষ করে গাজায় ইসরাইল– আমেরিকার মদদে শিশু নারী পুরুষ নির্বিশেষে যে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে সে প্রসঙ্গে আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর ফিলিস্তিনী নিপীড়িত মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের জন্য তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে গাজায় চলমান নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলির প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আর্কষণ করছি।
৮ আগস্ট ২০২৫ ইসরাইলী মন্ত্রীসভা সামরিক অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে গাজা দখলে নেওয়ার প্রস্তাব পাশ করে। যদিও সামরিক বাহিনী প্রধান এবং নিরাপত্তা বাহিনী প্রধান উভয়েই এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তাদের যুক্তি এতে করে ইসরাইলী সামরিক বাহিনীকে অনেকগুলি ফ্রন্টে লড়তে হবে এবং এটি হবে বিপদজনক। এর বাইরে তাদের বিরোধিতায় তারা যুক্তি তুলে ধরেন এতে জিম্মিদের জীবনের উপর সমূহ বিপদ নেমে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের জীবন হানিও ঘটতে পারে। এরপরও নেতানিয়াহুর একগুয়েমিতে গাজা পুরাপুরি দখলের প্রস্তাব ইসরাইলী মন্ত্রীসভায় পাশ হয়। এ প্রস্তাবে গাজা সিটি দখলের বাইরে আরো পাঁচটি বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এগুলি হলো–
১। হামাসকে পুরাপুরি নিরস্ত্রীকরণ, ২। সকল জিম্মি মুক্তকরণ, ৩। গাজাকে অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল হিসাবে গড়ে তোলা, ৪। গাজায় ইসরাইলী সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ৫। গাজায় বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা যাতে ফিলিস্তিনী তথা হামাসের কোন অংশগ্রহণ থাকবে না।
ইসরাইলী মন্ত্রীসভার এ প্রস্তাবকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের তুমুল ঝড় ওঠে। লন্ডন, প্যারিস, সিডনী, বুয়েনেসইয়ার্স, নিউইয়র্ক, জাকার্তা, বার্লিনের মত শহরগুলি এ প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করে। এর বাইরে খোদ ইসরাইলীরা প্রতিবাদে বিপুলভাবে রাস্তায় নামে। তারা অবিলম্বে স্থায়ী যুদ্ধ বিরতি এবং জিম্মি মুক্তির দাবী তোলে। অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, গ্রীস, স্লোভানিয়া এবং রাশিয়ার আহবানে ১০ আগস্ট ২০২৫ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি পানামার সভাপতিত্ব এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচীব মিরুস্লাভ জেনকা সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন। মিরুস্লাভ তার বক্তব্যে গাজার র্সাবিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন ইসরাইল পরিকল্পিত সামরিক অভিযান গাজার মানুষদের চলমান দুর্ভোগ দুর্দশাকে আরো ভয়ানক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে।
ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস ফর দি কোর্ডিনেশন অব হিউমেনেটারিয়ান এ্যাসিটেন্স (OCHA) এর পরিচালক রমেশ রাজসিঙ্গাম ইসরাইল গাজা দখলের পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছে বলে পরিষদকে তার প্রতিবেদনের মাধ্যমে অবগত করেন। তিনি তার প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করেন, ইসরাইল সৃষ্ট গাজার মানবিক দুর্যোগ ক্রমে মারাত্মক পরিণতির দিকে এগুচ্ছে। রাজসিঙ্গাম তার প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করেন, গাজায় ইসরাইলী অভিযান কেবল মানুষের জীবনকে আরো বিপর্যস্ত করবে। তিনি ফিলিস্তিনের উপর আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের বিষয়টি টেনে এনে সেখানে ইসরাইলের বে আইনী দখলদারিত্বের বিষয়টির প্রতিও নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রমেশ রাজসিঙ্গাম নিরাপত্তা পরিষদকে জানান গাজায় ত্রাণকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ইসরাইলীদের হাতে ৫০০ (পাঁচ শত) ত্রাণকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন, তিনি গাজার বর্তমান পরিস্থিতিকে ভয়াবহ এবং বর্ণনাতীত বলে উল্লেখ করেন।
মিরুস্লাভ জেনকা এবং রমেশ রাজসিঙ্গাম এর প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলি আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। আলোচনার শুরুতে অংশ নিয়ে বৃটিশ প্রতিনিধি জেমস কারুইকি গাজায় ত্রাণ কার্যক্রমের উপর থেকে বাধা নিষেধ তুলে নেওয়ার জন্য ইসরাইলের প্রতি আহবান জানান। তিনি দ্বি–রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে ঐ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মন্তব্য করে ইসরাইলকে তার আগ্রাসী ভূমিকা থেকে বিরত থাকার আহবান জানান।
ফরাসী প্রতিনিধি জয় ধর্মাধিকারী গাজায় সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্তকে তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এটি শুধু গাজার মানুষদের দুর্ভোগ আরো বাড়াবে। তিনি ইসরাইলীদের কারণে বর্তমানে গাজার মানুষেরা নিধারুন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি জাতিসংঘকে নির্বিঘ্নে গাজায় ত্রান কার্যক্রম চালানোর সুযোগ করে দিতে ইসরাইলের প্রতি আহবান জানান এবং একই সাথে হামাসকে তাদের হাতে জিম্মিদের মুক্তিরও আবেদন জানান। তিনি গাজার ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি উল্লেখ করেন, ফিলিস্তিনে ইসরাইল আন্তর্জাতিক সমস্ত আইন কানুন লংঘন করে চলেছে।
আলজেরিয় প্রতিনিধি আমের বিন জামা অত্যন্ত জোরালো কণ্ঠে ইসরাইলের সমালোচনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন বিগত ২২ মাসের যুদ্ধে ক্ষুধায় ১৮০০০ (আঠার হাজার) শিশু, ১২০০০ (বার হাজার) নারী সহ ৬১০০০ (একষট্টি হাজার) এর ও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। প্রতিদিন গাজায় ২০০ (দুইশত) মানুষ ইসরাইলীদের হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিনত হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আসিম ইফতেখার বলেন, ইসরাইল আন্তর্জাতিক সমস্ত আইন–কানুন রীতি–নীতি ক্রমাগত লংঘন করে চলেছে যার মধ্যে জাতিসংঘ প্রস্তাব ২৪২, ৩৩৮ এবং ২৭৩৫ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনি উল্লেখ করেন বৃহৎ শক্তির রাজনৈতিক ছত্রছায়া, সামরিক সহায়তা এবং কূটনৈতিক রক্ষাকবচ ইসরাইলকে বেপরোয়া করে তুলেছে।
রুশ প্রতিনিধি আলোচনায় অংশ নিয়ে ইসরাইলী পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে গায়েনার প্রতিনিধি তিনটি মৌলিক প্রশ্নের অবতাড়না করে পুরা নিরাপত্তা পরিষদকে নাড়া দেন। তার প্রশ্ন সমূহ–
Why does the occupying power act in such defying of the international communities even though it is contravention of international law including international humanitarian law and international human rights law. দখলদার শক্তি জানে তারা আন্তর্জাতিক আইন তথা মানবাধিকার আইন ভঙ্গ করছে তবুও তারা এই অবজ্ঞা প্রদর্শনের দুঃসাহস দেখাচ্ছে কীভাবে?
Why the action of occupying power not met strong united and collective position of this council. দখলদার শক্তি এই পরিষদের সম্মিলিত, ঐক্যবদ্ধ শক্ত অবস্থানের মুখামুখি হচ্ছে না কেন?
Will any member state of this council allow its citizen to be subject to this type of inhumane treatment by any actor including a fellow member state of UN ? এই পরিষদের কোন দেশ বা জাতিসংঘের কোন দেশ কি তার দেশের মানুষ এরকম অপমানকর দুর্দশায় পতিত হোক তা চাইবেন?
বরাবরের মতই আলোচনায় অংশ নিয়ে আমেরিকান প্রতিনিধি ইসরাইলের সমস্ত কু–কীর্তির পক্ষ নিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। তার যুক্তি ইসরাইল যাই করছে সে তা তার নিরাপত্তার স্বার্থেই করছে। উল্টা তিনি নিরাপত্তা পরিষদের বাকী সদস্যদের এই আলোচনার সুযোগ নিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে অংশ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ তোলেন।
এতেই কি গায়েনার প্রতিনিধির উত্থাপিত প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না? একই সাথে এরই মাঝে আমেরিকার রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা, কূটনৈতিক অদূরদর্শিতা আর সামরিক দূরাচার স্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে উঠে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।