সমকালের দর্পণ

ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের প্রদেশসমূহ ভারত-বাংলাদেশ চলমান সম্পর্ক -১২

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১০ আগস্ট, ২০২৫ at ১১:০১ পূর্বাহ্ণ

কালাদান মাল্টি মোডাল মাল্টি ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট। এটি ভারতের র্পূ্বাঞ্চলীয় তথা উত্তরপূর্ব ভারতের সাথে যোগাযোগের জন্য একটি বিকল্প পথ হিসাবে ভারতীয় কৌশল প্রণেতাদের উদ্যোগ। শিলিগুড়ি কড়িডোরের বিকল্প পথ হিসাবেও এটাকে ভাবা হচ্ছে। ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা শিলিগুড়ি কড়িডোর তথা চিকেন নেকের ওপর বিদ্যমান ঝুঁকি কমানোর একটি বিকল্প হিসাবেও এ পথকে বিবেচনায় নিয়েছেন নিশ্চিতভাবে। কোন কোন ভারতীয় এ পথকে উত্তরপূর্ব ভারতের সাগরে প্রবেশের পথ হিসাবেও দেখছেন। দীর্ঘদিন ধরে ভারত এ পথ খোলার প্রচেষ্টায়। আমি যখন ১৯৯৯ এ সিটওয়েতে আমাদের মিশন প্রধান তখন থেকে এ পথের সন্ধান এবং জরীপে ভারতীয়দের সে অঞ্চলে আনাগোনা।

ভারত তার মেইনল্যান্ডের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে শিলিগুড়ি করিডোর তথা চিকেন নেক’এর উপর নির্ভরতা এবং চাপ কমাতে বাংলাদেশের উপর দিয়ে রেল সংযোগ স্থাপনে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা চুক্তিতেও উপনীত হয়েছিল। এই সমঝোতা অনুযায়ী তিনটি রেলওয়ে সংযোগের পরিকল্পনা করা হয়।

এর একটি আখাউড়াআগরতলা, ১২.২৪ কিঃমিঃ এই রেল সংযোগের ৬.৭৮ বাংলাদেশে এবং ৫.৪৬ ত্রিপুরায়।

কুলাউড়া শাহবাজপুর এটি আসামের সাথে সংযোগ স্থাপন করে বিদ্যমান সংযোগকে বেগবান করবে।

খুলনামংলা ৬৫ কিঃমিঃ ব্রডগেজ রেল সংযোগ স্থাপন।

এই সব রেল যোগাযোগের লক্ষ্য ভারতীয় উত্তরপূর্বাঞ্চলকে ভারতীয় মূলভূখণ্ডের সাথে সংযোগ এবং একই সাথে বন্দর ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করা। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ৫০০০ (পাঁচ হাজার) কোটি ভারতীয় রুপি। এই পুরা প্রজেক্টের কাজ ২০ এপ্রিল ২০২৫ ভারতীয় কর্তৃপক্ষ স্থগিত করেছে। এই স্থগিতকরণের পিছনে কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর শ্রমিকদের নিরাপত্তার অভাব।

এর বাইরেও ভারত তার উত্তরপূর্বাঞ্চলকে সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে ফেনী নদীর উপর দীর্ঘ সেতু নির্মাণের মাধ্যমে রামগড়সাবরুম সড়ক যোগাযোগের সূত্রে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছে। ইতিমধ্যে কৌশলগত পদক্ষেপ হিসাবে ভারত উত্তর প্রদেশ থেকে বিহার হয়ে শিলিগুড়ি কড়িডোরে ফিডার পথ হিসাবে তার রেলপথকে দ্বিগুণ তিনগুণ স্বক্ষমতায় উন্নীত করার পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। অন্যদিক বাংলাদেশের সাথে চলমান সম্পর্ক মাথায় রেখে এবং হয়ত বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য ভারত কৌশলগত অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে নেপাল ভূটান হয়েও তার র্পূ্বাঞ্চলের সাথে রেল যোগাযোগ পথ অবারিত করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

উপরে বর্ণিত বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে ভারত কালাদান মাল্টি মোডাল মাল্টি ট্রান্সর্পোট প্রজেক্টকেও তার উত্তর র্পূ্বাঞ্চলের সাথে সংযোগ এবং যাতায়াত মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পটি চালু হলে তা কলকাতাসিটওয়ে হয়ে কালাদান নদীর বুক বেয়ে মায়ানমারের চিন স্টেটের প্লাটোয়া পৌঁছাবে। প্লাটোয়া থেকে মিজোরামের আইজল। এখান থেকে এটি ভারতের ন্যাশনাল হাইওয়ের সাথে সংযুক্ত হওয়ার কথা।

ভারতীয় অভ্যন্তরীণ জল পরিবহন সংস্থা কালাদান মাল্টি মোডাল মাল্টি ট্রান্সর্পোট প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে, এটি সম্পূর্ণ ভারতীয় বিনিয়োগে বাস্তবায়িত হবে।

কালাদান মাল্টি মোডাল মাল্টি ট্রান্সর্পোট প্রজেক্টটি সাগর নদী এবং সড়ক পথে বাস্তবায়িত হবে।

সাগর পথে এর দৈর্ঘ ৫৩৯ কিঃ মিঃ, যা কলকাতা সিটওয়ে পথে বিস্তৃত।

নদী পথে ১৫৮ কিঃ মিঃ, যা সিটওয়ে থেকে কালাদানের বুক বেয়ে প্লাটোয়া পর্যন্ত।

সড়ক পথে ১১০ কিঃ মিঃ যা চিন স্টেট তথা প্লাটোয়া থেকে মিজোরামে ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানা পর্যন্ত।

মায়ানমার ভারত আর্ন্তজাতিক সীমানা থেকে ভারতীয় ন্যাশনাল হাইওয়ে ৫৪ তথা লংলাই পর্যন্ত ১০০ কিঃ মিঃ।

ইতিমধ্যে ভারত বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে তার উত্তরপূর্বাঞ্চলের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনে আরো একটি পথ উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে। এটি শিলং থেকে শিলচর পর্যন্ত। এটি চার লেইন বিশিষ্ট মহা সড়ক হবে। ভারতীয়রা এ সড়ককে তাদের কৌশলগত প্রকল্প হিসাবে গণ্য করছেন। তারা এ সংযোগ সড়ককে তাদের পূর্বাঞ্চলের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে বলে প্রত্যাশা করছেন। ভারতীয় অন্যতম সংবাদ মাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস শিলংশিলচর প্রকল্পকে কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ভারতের একটি পদক্ষেপ হিসাবে গণ্য করে প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা চীন সফরের সময় ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চলকে ভূমি বেষ্টিত এবং সাগরে যাওয়ার তাদের কোন পথ নেই বলে উল্লেখ করেন। একই সাথে তিনি বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের সাগরের অধিকর্তা হিসাবে উল্লেখ করেন এ বিষয়টিও শিলংশিলচর প্রকল্প গ্রহণে ভারতীয় কৌশল প্রণেতাদের ধাবিত করে।

৩০ এপ্রিল ২০২৫ ভারতীয় মন্ত্রীসভা শিলংশিলচর প্রকল্প বাস্তবায়নে ২২হাজার ৮৬৪ কোটি রুপির বাজেট অনুমোদন করে।

শিলংশিলচর প্রকল্পের ১৪৪.৮ কিঃমিঃ পড়েছে মেঘালয়ে এবং ২২ কিঃমিঃ পড়েছে আসামে। এন এইচ আই ডি সি এল এর এক কর্মকর্তা এ কড়িডোর সম্পর্কে বলেন এটি চালু হলে তা বাংলাদেশকে এড়িয়ে বিশাখাপত্তম এবং কলকাতা হয়ে উত্তর পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবহনকে সহজতর করবে। যা শিলংশিলচর মহা সড়ক ধরে উত্তর পূর্ব ভারতে পৌঁছে যাবে।

শিলংশিলচর প্রকল্পটি শিলং এর কাছে মাওলিঙ্গখুং থেকে আসামের শিলচর’এর কাছে পাঁচগ্রামে এসে মিলিত হবে। চার লেইন বিশিষ্ট ১৬৬.৮ কিঃমিঃ দীর্ঘ এ মহাসড়ক হবে জাতীয় মহাসড়ক ৬ এর অংশ। ২০৩০ সালে এ মহাসড়ক সম্পন্ন হলে এটি হবে উত্তর পূর্ব ভারতের প্রথম হাইস্পিড কড়িডোর।

এন এইচ আই ডি সি এল এর এক কর্মকর্তারা বলছেন শিলংশিলচর প্রকল্পটি তাদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ এই পথে আছে বন্ধুর র্পা্বত্যাঞ্চল, এখানে স্লোপ স্টাবিলাইজেশন, ভূমিধস র্পূ্বাভাস এর জন্য সেন্সর স্থাপন সহ র্স্বাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রকৌশল গত র্স্বাধুনিক প্রযুক্তিও প্রয়োগ করে কাজ করতে হবে।

শিলংশিলচর হাইস্পিড কড়িডোর সাথে যুক্ত হবে কালাদান মাল্টি মোডাল মাল্টি ট্রান্সর্পোট প্রজেক্ট। একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে যোগায়োগের এই সব নানা উদ্যোগে ভারতের একটিই লক্ষ্য, বাংলাদেশের উপর তার নির্ভরতা কমানো।

অন্যদিকে গত ১৭ মে ২০২৫ থেকে ভারত বাংলাদেশ থেকে স্থল বন্দর দিয়ে সমস্ত আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারও পূর্বে ভারত তার বিমান বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিও বন্ধ করেছে।

ভারতীয় এসব নেতিবাচক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য মোটেও অনুকূল কোন প্রভাব বয়ে আনবে না বরং প্রতিকূলতাই সৃষ্টি করবে। কারণ সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহনে সময় এবং ব্যয় দুটিই বাড়বে, এতে রপ্তানি আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

কানেক্টিভিটি তথা যোগাযোগের সুবর্ণ পথ ধরে বিশ্ববাণিজ্য যখন নব নব দিগন্ত উন্মোচন করছে সেখানে আমাদের দুই প্রতিবেশী এখন বাণিজ্য পথ অবারিত না করে বন্ধের প্রতিযোগিতায়, এতে লাভ কারোরই হবার নয়। উল্লেখ্য অর্থনীতিতে ঊহফড়সিবহঃ শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ, এর সরল বাংলা করলে দাঁড়ায় প্রকৃতি প্রদত্ত সুযোগ। এই সুযোগের বলে ভারতবাংলাদেশ দুটি দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা বা গড়ে উঠা উচিৎ। এটি মনে রেখে পথ চললে দুটি দেশই বাণিজ্য থেকে লাভবান হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতিতে অধ্যাপক লোকমান হাকিম : বাবার অনুপস্থিতিতে তাঁর উপস্থিতি
পরবর্তী নিবন্ধসাংবাদিক তুহিন হত্যা: কে এই গোলাপী, কী কারণে গ্রেপ্তার