এস এ টি ভি’র অতি সাম্প্রতিকের এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপক আমাকে ঠিক শিরোনামের প্রশ্নটি করেছিলেন। অনুষ্ঠানটিতে আমার সাথে সহ–আলোচক ছিলেন আমেরিকার ওয়াশিংটন ডি সি থেকে এ্যাম্বেসেডর নরমান এবং পাকিস্তানি সাংবাদিক এস এ টিভি’র পাকিস্তান প্রতিনিধি মোহাম্মদ মুসাভ। সেই আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থাপক রাশেদ কাঞ্চনের প্রশ্নের উত্তরে যে বিষয়গুলি আমি তুলে ধরে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম তা আমার প্রিয় পাঠকদের জন্য নিবেদন করছি।
প্রথমত নৈতিকতার দিক থেকে ইরান আক্রমণ ইসরাইল এবং পরবর্তীতে আমেরিকার সে আক্রমণে অংশগ্রহণ ছিল তাদের দেউলিয়াপনা উলঙ্গ বহিঃপ্রকাশ। কেন দেউলিয়াপনার উলঙ্গ বহিঃপ্রকাশ? কারণ ইরানের পারমানবিক জ্বালানী সমৃদ্ধকরণ বিষয়ে আলোচনা যখন চলমান তখন ১৫ জুন ২৫, ৬ষ্ঠ বৈঠকের তারিখ নির্ধারিত ছিল। সে বৈঠকের আগে ১৩ জুন ২৫ ইসরাইল আমেরিকার সম্মতিতে ইরান আক্রমণ করে বসে। এটাকে পশ্চিমা সচেতন, শান্তিবাদী জনগোষ্ঠী এবং সংবাদ পত্রের প্রগতিশীল অংশ এপিক বিট্রায়েল তথা ঐতিহাসিক এক মোনাফেকি হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ইরান–ইসরাইল যুদ্ধের শুরুতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন ‘ইরানী আকাশের পুরা নিয়ন্ত্রণ এখন আমাদের হাতে’ এবং তিনি ইরানের উপর ইসরাইলের আক্রমণকে এক্সেলেন্ট বলে ঘোষণা করেন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট এর বাইরেও ইসরাইলকে তার যুদ্ধ পরিচালনায় নানাভাবে উৎসাহ যোগাতে থাকেন।
ইসরাইলের ইরান আক্রমণ আন্তর্জাতিক সমস্ত আইন কানুন এবং রীতিনীতির চুড়ান্ত লঙ্ঘন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এটি ইসরাইল–আমেরিকার প্রথম পরাজয়।
ইসরাইল আক্রমণের শুরুতে নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিল তাদের আক্রমণের তোড়ে ইরানী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তছনছ হয়ে ভেঙে পড়বে। যদিও ইসরাইলী আক্রমণের প্রথম প্রহরে ইরান তার সম্মুখ সারির প্রায় সব কমান্ডার এবং পারমানবিক বিজ্ঞানীদের হারায়। কিন্ত্তু অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ইরান সে ক্ষত মুছে কমান্ড প্রতিস্থাপন করে ইসরাইলের উপর কার্যকরী প্রতি আক্রমণ চালায়। এটি ছিল ইরান– ইসরাইল যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ র্টানিং পয়েন্ট তথা মোড় ঘুরানো পদক্ষেপ। এরপর ইরান–ইসরাইল পরস্পর আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চালাতে থাকে। এক পর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে আমেরিকা ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে ইরান আক্রমণ করে। এ থেকে প্রমাণ হয় ইসরাইল এককভাবে ইরানকে সামাল দিতে ব্যর্থ হয় এবং আমেরিকাকে শেষ পর্যন্ত ইসরাইলের পাশে দাঁড়াতে হয়। এটি ইসরাইল–আমেরিকার দ্বিতীয় পরাজয়।
আমেরিকা তার বিমান বহরের সবচেয়ে শক্তিশালী বি ৫২ বোমারু বিমানের মাধ্যমে ইরানের পারমানবিক স্থাপনা ‘ফরডো’ ‘নাথানজ’ এবং ‘ইস্পাহান’ আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে অনুযায়ী ২১ জুন ২০২৫ আমেরিকা ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নাম দিয়ে ইরান আক্রমণ শুরু করে। এই হামলায় অংশ নিতে আরিজোয়ানার হোয়াইটম্যান এয়ার বেইস থেকে ৭ টি বি ৫২ বোমারু বিমান আকাশে উড়াল দেয়। প্রতিটি বি ৫২’র বুকে ছিল ৩০০০০ (ত্রিশ হাজার) পাউন্ড ওজনের ২ টি করে জি বি ইউ–৫৭/বি বাংকার বাস্টার প্যাট্্িরয়ট বোমা। উল্লেখ্য বি ৫২ বোমারু বিমানগুলি ৭০০০০ (সত্তুর হাজার) পাউন্ড পর্যন্ত বোমা বা সমরাস্ত্র নিয়ে লক্ষ্যবস্ত্তুর উদ্দেশ্যে উড়াল দিতে পারে। আটলান্টিক মহাসাগর এবং মেডিটেরিায়ন হয়ে বিমানগুলি মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে প্রবেশ করে। এসময় আমেরিকার বি ৫২ বোমারু বিমানগুলি দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা উড়াল সময় পার করে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে বিমানগুলি আকাশে দুবার জ্বালানীও নেয়। এইসব বিমান ভোর রাতে ইরানের পারমানবিক স্থাপনা ফ্রাদো, নাথানজ এবং ইস্পাহানে তাদের বয়ে আনা ১৪টি বোমা বর্ষণ করে।
বোমাবর্ষণান্তে তড়িঘড়ি এক সংবাদ সম্মেলনে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন তাদের অপারেশন শতভাগ সফল এবং তিনি ইংরেজীতে একটি বাক্য স্বদম্ভে উচ্চারণ করেন, Iran’s nuclear facilities is obliterated অর্থাৎ ইরানের পারমানবিক স্থাপনা তথা কার্যক্রমের অবলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। এর পরপরই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিতে দি হেগ’এ গিয়ে উপস্থিত হন। এখানেও তিনি উচ্চকণ্ঠে উচ্চসিতভাবে ঘোষণা করেন ইরানের পারমানবিক স্থাপনা সমূহ মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। একথা শুনে ১৪ বছর নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষে ন্যাটো মহাসচিব হিসাবে সদ্য যোগ দেওয়া মার্ক রুটে বলে উঠেন ‘আপনার মত সাহসী প্রেসিডেন্ট বলেই এ আক্রমণ এবং অর্জন সম্ভব হয়েছে’ কি তেলবাজি।
ইতিমধ্যে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের তথ্যপ্রবাহ ক্রমাগত জানান দিতে থাকে আমেরিকান আক্রমণে ইরানী পারমানবিক স্থাপনাসমূহ তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, এ তথ্য আবার সি এন এন এবং নিউইর্য়ক টাইমস প্রকাশ করে বসে। বেকায়দায় পড়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট এ দুই সংবাদ মাধ্যমকে হেগের সংবাদ সম্মেলনেই এক হাত নেন। এরই মাঝে আন্তর্জাতিক এ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি জানায় ফ্্রাদো, নাথানজ এবং ইস্পাহানে কোন ধরনের পারমানবিক বিকিরণের কোন আলামত তারা পাননি। একই বক্তব্য তুলে ধরে ইরানী এ্যাটমিক এনার্জি কমিশনও। তারাও এও জানায় আক্রমণের আগেই তারা তাদের রি –এ্যাক্টর গুলি বন্ধ করে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মওজুদ অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলেছেন।
এর অর্থ হল আমেরিকার এই এত প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ। এটি হল ইসরাইল–আমেরিকার তৃতীয় পরাজয়।
এতদিন আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বের গর্ব এবং তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বেদ্য, নিশ্চিদ্র এবং নিরাপদ। ইরান এ ধারনাকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে ইসরাইলের ‘আয়রন ডোম’ ‘ডেভিড স্লিং’ ‘এ্যারো–১’ এবং ‘এ্যারো–২’ কে ভেদ করে ইসরাইলী বিভিন্ন লক্ষ্যবস্ত্তুতে একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে সামরিক বিশেষজ্ঞদেরকেও হতবাক করে দেয়। এটি ছিল ইসরাইল–আমেরিকার চতুর্থ পরাজয়।
বার দিন যুদ্ধান্তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরান–ইসরাইল যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা দেওয়ার পর ইসরাইল সদর্পে জানান দেয় তারা ইরানের মিসাইল সিস্টেমের সমূহ ক্ষতি সাধন করেছে। এই ঘোষণার পরপরই ইরান পুনরায় ইসরাইলে মিসাইল আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণ ছিল ইসরাইল–আমেরিকার পঞ্চম পরাজয়।
ইরান তার পারমানবিক স্থাপনা আক্রান্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসাবে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর হওয়ার আগ মুহূর্তে কাতারস্থ আমেরিকান বিমান ঘাঁটিতে আমেরিকাকে জানান দিয়ে ক্ষেপনাস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করে এবং তা লক্ষ্যবস্ত্তুতে আঘাত হানে। এই আক্রমণ ছিল ইসরাইল–আমেরিকার ষষ্ঠ পরাজয়।
Iran’s nuclear facilities is obliterated তথা ইরানের পারমানবিক কার্যক্রমের যেখানে অবলুপ্তি ঘাঁটনো হয়েছে, সেখানে ইরানের সাথে পরমানু বিষয়ে পুনরায় আলোচনায় বসার তৎপরতা বা হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র কর্তৃক ইরানকে আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি কমিশনকে ইরানী পারমানবিক স্থাপনা পরিদর্শনের সুযোগ দেওয়ার আহব্বান জানানো আমেরিকার সপ্তম পরাজয় এবং এটি নৈতিক।
ইউরোপিয় ইউনিয়ন ইসরাইল কর্তৃক অতর্কিতে ইরান আক্রমণের সময় এর বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেনি। এখন ইরান যখন আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি কমিশনকে ইরানী পারমানবিক স্থাপনা পরিদর্শনে অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছে তখন তড়িঘড়ি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান ‘খাজা কালি’ ইরানকে তার পারমানবিক স্থাপনা পরিদর্শনে আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি কমিশনকে অনুমতি দেওয়ার আহবান জানান। এর উত্তরে ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী যথার্থই উত্তর দিয়েছেন, ‘আমরা যখন আক্রান্ত তখন আপনারা একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি বরং আক্রমণকারীর পক্ষাবলম্বন করেছেন, আর এখন আমাদের কি করতে হবে তার উপদেশ দিচ্ছেন, আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করব’। এটি আমেরিকার তাবেদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকার জন্য অষ্টম পরাজয়।
আমেরিকা এবং ইসরাইল ইরান আক্রমণে তাদের অন্যতম লক্ষ্য স্থির করেছিল রিজিম বা শাসকশ্রেণির পরির্বতন। যা ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ এবং বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এম সিক্স তেহরানের পথে পথে দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের পতনের মাধ্যমে ঘটিয়েছিল। এবার সেটা হয়নি বরং ইরানীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের এক নব জাগরণ পরিলক্ষিত হয়েছে। এটি আমেরিকা–ইসরাইলের জন্য নবম এবং সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরাজয়।
পৃথিবীর দেশে দেশে ইসরাইলের ইরান আক্রমণের বিরুদ্ধে যে সোচ্চার প্রতিবাদ এবং ইরানের পক্ষে যে সর্মথন তা এক কথায় অভূতপূর্ব। এ আন্দোলন প্রতিবাদ ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া এবং খোদ আমেরিকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি আমেরিকা–ইসরাইলের জন্য দশম পরাজয়।
আমার দৃষ্টিতে আমেরিকা–ইসরাইলের জন্য সবচেয়ে বড় পরাজয় সমস্ত বিশ্ব জুড়ে বিবেকবান মানুষদের বিশেষ করে নাওম চমস্কি, অধ্যাপক সাক্স, অধ্যাপক মারসিমারদের মত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আমেরিকা–ইসরাইলের বর্তমান বিবেক বিবর্জিত ভূ–রাজনৈতিক স্বার্থান্ধ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান গ্রহণ এবং এর বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেকের উত্থান প্রয়াসে অবিরাম প্রচেষ্টা।
উপসংহারে উল্লেখ করতে চাই ইসরাইল – আমেরিকা তাদের তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, যা ইরানের পারমানবিক স্থাপনা ধ্বংস, রিজিম বা শাসকশ্রেণির পরির্বতন এবং ইরানের নিঃর্শত আত্মসমর্পণ। এটির কোনটিই তারা অর্জন করতে পারেনি, এটি আমেরিকা–ইসরাইলের জন্য লজ্জাজনক পরাজয়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।