বিগত বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে রাখাইনে মানবিক প্যাসেজ বা করিডোর বিষয়টি বেশ জোরেসোরে আলোচনা হয়ে আসছে। এর মধ্যে জাতিসংঘ মহা সচিবের বাংলাদেশ সফর বিষয়টির উপর আলোচনায় আরো উৎসাহ যোগায়, নানা আলোচনা ক্রমাগত ডালপালা বিস্তার লাভ করতে থাকে। এ ক্ষেত্রে সরকারের মৌনতা সম্মতির লক্ষণ হিসাবে অনেকে ধরে নেন। এর মাঝে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক বিশেষ সহকারী এবং পরবর্তীতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ডঃ খলিলুর রহমানের কঙবাজার এবং রামু সেনানিবাস সফর রাখাইনে কানাঘুষার মানবিক করিডোর বিষয়টির উপর সচেতন মানুষের মনে আরো উৎসুক্যের খোরাক যোগায়।
এমন এক প্রেক্ষাপটে ২৭ এপ্রিল ২০২৫ অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জনাব তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে জানান রাখাইনে মানবিক করিডোর দিতে সরকার সম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো উল্লেখ করেন কিছু কিছু শর্ত এখনও চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায়। এব্যাপারে তিনি আর বেশি কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এ বক্তব্যের পরপর দেশব্যাপী বিশেষ করে রাজনৈতিক মহলে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। বিএনপি মহাসচিব সব পক্ষের সাথে আলোচনান্তে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন। জামাতে ইসলামীর আমির মানবিক করিডোর বিষয়টির ব্যাখ্যা জাতির সামনে তুলে ধরার অনুরোধ করেন। এভাবে নানা আলোচনা সমালোচনার মুখে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জনাব তৌহিদ হোসেন’এর বক্তব্যের দুদিন পর এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন রাখাইনে মানবিক প্যাসেজ বা করিডোর বিষয়টি নিয়ে কোন পক্ষের সাথে কোন আলোচনা হয়নি ‘বাংলাদেশ শুধুমাত্র তার উইলিংনেস টা জানিয়ে রেখেছে’। কার কথা সত্য এ নিয়ে সচেতন মহলে আবারো আলোচনা বিস্তার লাভ করে। তবে এ থেকে সরকারের মাঝে রাখাইনে মানবিক প্যাসেজ বা করিডোর বিষয়ে সমন্বয়হীনতার একটি বার্তা পাওয়া যায়।
রাখাইনে মানবিক প্যাসেজ নিয়ে আলোচনায় যেসব বিষয় সামনে এসেছে তার মাঝে, হঠাৎ এখন রাখাইনে মানবিক প্যাসেজ কেন? মানবিক প্যাসেজ এর মাধ্যমে রাখাইনে কী যাবে এবং কাদের জন্য? রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি মানবিক প্যাসেজের সাথে সম্পৃক্ত কিনা? বাংলাদেশ ছাড়া রাখাইনের জন্য মানবিক প্যাসেজের অন্য কোন বিকল্প আছে কি না? রাখাইনকে ঘিরে ভূ–রাজনীতিতে বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়ছে কিনা? মানবিক প্যাসেজ বা কড়িডোড় ঘিরে বাংলাদেশের জন্য কোন ঝুঁকি আছে কিনা? মানবিক প্যাসেজ জাতিসংঘের চাওয়া নাকি অন্য কোন বৃহৎ ভূ–রাজনীতির স্বার্থান্বেষীর চাওয়া?
এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় উল্লেখিত প্রতিটি প্রশ্ন আমাদের জাতীয় স্বার্থ এবং নিরাপত্তার সাথে অঙ্গাআঙ্গিভাবে জড়িত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলির উপর আলোকপাত করার প্রয়াস।
দীর্ঘদিন থেকে রাখাইনে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে রোহিঙ্গারা নানা ধরনের বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এখানে উল্লেখ্য সিটওয়ে তথা আকিয়াবের উপকণ্ঠে দুই থেকে আড়াই লক্ষ মানুষ কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে বন্দী জীবন যাপন করছে। কফি আনান কমিশন এই মানুষগুলিকে সসম্মানে তাদের বাড়ি ঘরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। আজিম ইব্রাহীম, আমেরিকান নাম করা অধ্যাপক, রোহিঙ্গাদের দুঃখ দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে তার বিখ্যাত বই “দি রোহিঙ্গাস ইনসাইড মিয়নমার’স হিডেন জেনোসাইড” লিখেছেন। মজার বিষয় হল এ বইয়ের আবার মুখবন্ধ লিখেছেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, মুখবন্ধের একবারে শুরুতেই তিনি উল্লেখ করেছেন “One of the fundamental challenges for a democracy is to work out how to ensure the voice of the majority does not trample the essential rights of minorities”.
অর্থাৎ গণতন্ত্রের মৌলিক চ্যালেঞ্জ হল এমন একটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাতে করে সংখ্যাগরিষ্ঠের জোর যেন সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার হরণ না করে।
মায়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠদের অশুভ প্রতাপে সংখ্যা লঘিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব থেকে শুরু করে তাদের যাবতীয় মৌলিক অধিকার যেমন খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, চলাচল ইত্যাদি ক্রমান্বয়ে হরণ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা এই অনাচার সম্পর্কে জাতিসংঘ অবহিত থেকেও ছিল নির্বিকার। এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি র্স্বাগ্রে বিবেচনায় না রেখে হঠাৎ করে জাতিসংঘ মানবিক করিডোর নিয়ে মেতে উঠল কেন সেটাই সাধারণ মানুষের অনুসন্ধিৎসার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার মাঝে অন্যতম প্রশ্ন মানবিক প্যাসেজ বা করিডোর ধরে রাখাইন অঞ্চলে অন্য কিছু ঘটতে যাচ্ছে না তো?
অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে সামনে রেখে বিবেচনা করলে রোহিঙ্গারাই সবচেয়ে অমানবিক পরিস্থিতিতে বসবাস করছে। এই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি বিশ্ব–সংস্থার র্স্বাগ্রে গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল। এখন মানবিক প্যাসেজের আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি কীভাবে সন্নিবেশিত হচ্ছে তা আমরা এখনও জানি না, তবে প্রত্যাশা থাকবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি র্স্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকবে।
যদি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি আলোচ্য মানবিক প্যাসেজের সাথে সম্পৃক্ত না থাকে তবে বাংলাদেশকে এ প্যাসেজ সংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে নিজেকে দূরে রাখা উচিত এতে বাংলাদেশ অনর্থক ঝুঁকিতে পড়া থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে সক্ষম হবে। কারণ রাখাইনে মানবিক সাহায্য পাঠানোর আরো পথ অবারিত আছে। এই অবারিত পথের অন্যতম হল সাগর পথ। রাখাইন অঞ্চলের মংডো’র পশ্চিম উপকূল থেকে শুরু করে দক্ষিণে আকিয়াব তথা সিটওয়ে বন্দর এমনকি স্যান্ডওয়ে উপকূল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর অবারিত যার মাধ্যমে রাখাইনে মানবিক সাহায্য পৌঁছানো যাবে। বর্ণিত এসব এলাকার যে কোনখানে ল্যান্ডিং স্টেশান করে সাগর পথে বিপুল সাহায্য ঐ অঞ্চলে প্রেরণ করা যেতে পারে।
মানবিক প্যাসেজ বা করিডোর ঘিরে বাংলাদেশের ঐ অঞ্চলের ভূ–রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা এ বিষয়টি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে বিবেচ্য।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ অঞ্চলের ভূ–রাজনীতি এবং বাংলাদেশের তাতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আলোচনা করা যেতে পারে।
রাখাইনে মূলত বেশ কয়টি বৃহৎ শক্তির ভূ–অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। চীনের এ অঞ্চলে রয়েছে ‘চকপিউ’ গভীর সমুদ্র বন্দর, চীন–মায়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর, থা শোয়ে গ্যাস ফিল্ড, গভীর সমুদ্র বন্দরকে ঘিরে শিল্পাঞ্চল ইত্যাদি, ভারত – ভারত তার উত্তর–র্পূ্বাঞ্চলের সাথে যোগাযোগে শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকের বিকল্প হিসাবে কালাদান মাল্টি মোডাল মাল্টি ট্রানজিট প্রজেক্ট বাস্তবায়নে উদ্যোগী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – মায়ানমারে প্রভাব বিস্তারে ‘বার্মা এ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেছে– এ বিলের বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ‘এনইউজি’ বা ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’ এর সাথে নানাভাবে যোগাযোগ স্থাপন করেছে এবং তাদের বিভিন্ন উপায়ে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ– মায়ানমারের নাগরিক তের কোটি রোহিঙ্গার ভার দীর্ঘ সাত বছরের ও বেশি সময় ধরে বয়ে চলেছে। এসব কারণে বর্ণিত প্রতিটি দেশই এখানে একধরনের ভূ–রাজনীতির আষ্টেপৃষ্টে বাধা পড়েছে।
এমন এক প্রেক্ষাপটে রাখাইনে যে কোন পক্ষের পদক্ষেপ ভূ–রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ার পদক্ষেপ হিসাবেই বিবেচিত হতে পারে। এমনই চিন্তা চেতনা থেকে কোন কোন ভূ–রাজনীতি বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলেছেন রাখাইনের মানবিক করিডোর শুধুই কি মানবিক সহায়তা নাকি একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার সূচনা, যা যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত লক্ষ্য পূরনে সহায়ক হতে পারে। রাষ্ট্রটি গঠিত হলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ এবং খ্রীষ্টান প্রধান এবং এটি হবে ভারত এবং চীনের মাঝামাঝি একটি কৌশলগত অবস্থান।
রাখাইনকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রটি চিন স্টেট, মিজোরাম এবং নাগাল্যান্ডকেও অন্তর্ভুক্ত করে–এরকম একটি গুজব বাতাসে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছুদিন উড়ে বেরাচ্ছে।
গুজবটি আরো ডালপালা বিস্তার লাভ করে যখন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ মাধ্যমে অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন কোন একটি পশ্চিমা শক্তি বাংলাদেশের কিছু অংশ সহ উপরে বর্ণিত অঞ্চলকে নিয়ে একটি খ্রীস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
এসব কিছু বিবেচনায় রাখলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যতীত রাখাইনকে ঘিরে আমাদের যে কোন পদক্ষেপ সচেতন মহলে সন্দেহের নানা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দেয়া অস্বাভাবিক নয়। ইতিমধ্যে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদোমার কিছু কর্মকাণ্ড এবং তার ‘জো ল্যান্ড’ এর স্বপ্ন এ অঞ্চলকে ঘিরে আরো বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। (চলবে)
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক