সমকালের দর্পণ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ৪ মে, ২০২৫ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

হিংসা বিদ্বেষ পারস্পরিক অবিশ্বাসের মধ্যে ১৯৪৭ সালে ভারত উপ মহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ভারতের জন্ম। এই দুই দেশের জন্মের প্রসব বেদনাকালীন সময়ে লক্ষ অসহায় নিরীহ নারী পুরুষ শিশু অকারণ সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুনে পুড়ে মরেছে। মানুষ মানবিকতা ভুলে শত বছরের বন্ধন একপাশে ঠেলে ফেলে দিয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে হিংসার হিংস্‌ আগুনে একে অপরকে পুড়িয়েছে। অসহায় মানুষ দেখেছে যার সাথে এত দিনের হৃদ্যতা পারস্পরিক জন্মের পর থেকে একই সাথে পথ চলা একই সুখ দুঃখের সাথী হওয়া সেই কাছের মানুষটি নাঙ্গা তলোয়ার হাতে বা ধারলো ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সম্মুখে তার হন্তারক হয়ে। মানুষের এমন এক দুঃসময়ে স্ত্রীর সামনে স্বামীকে হত্যা করা হয় আবার স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়। বাবা মা’র সামনে সন্তানদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় পৈশাচিক উল্লাসে। অজস্‌্র বাড়ি ঘর পুড়িয়ে মানুষকে নিঃস্ব করা হয়। ঘরবাড়ি হারা শত জনমের বাস্ত্তুভিটা ছেড়ে উদ্বাস্ত্তু মানুষ অনাহার অসহায়ত্বকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়ে পথে। বেদনার্ত মানুষের জন্য দুঃসহ ছিল অজানা সেই গন্তব্যের পথ। সামান্য যা সম্বল নিয়ে নিরাশ্রয় মানুষ যখন পথে পথে তখন লুঠেরেরা তাও ছিনিয়ে নিয়েছে মাঝপথে।

এভাবেই এই দুর্ভাগা লক্ষ মানুষ এপার থেকে ওপার আবার ওপার থেকে এপার করেছে ১৯৪৭ এর পূর্বাপর। ক্ষমতা মনস্ক রাজনীতি মানুষকে মানুষ হিসাবে বাঁচতে দেয়নি। এই উপ মহাদেশের মানুষেরা পশুর চেয়েও অধম হয়ে ৪৭ এ পরস্পরকে হত্যায়, গৃহহীন নিঃস্ব করায় মত্ত হয়েছিল। পশুর চেয়েও অধম বলার কারণ পশুরা কখনো দলবদ্ধ হয়ে স্বগোত্রের কাউকে হত্যা করেছে সে উদাহরণ বিরল।

১৯৪৭ থেকে সেই যে শুরু তা আর কখনো থেমে থাকেনি। ৪৭ এ কাশ্মীর দখলে নেওয়ার প্রতিযোগিতা, হায়দরাবাদ জুনাগড় দখলে নেওয়া থেকে যে পারস্পরিক আক্রোশ আর আক্রমণ প্রতিযোগিতা তা থেকে এ দুটি দেশ আর কখনো নিবৃত্ত হয়নি। নিচের ইতিহাস তারই প্রমাণ।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীরের উপর ৩৯ নাম্বার প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ প্রস্তাব অনুযায়ী ভারত পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি বজায় এবং যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন ‘ইউ এন সি আই পি’ গঠন করা হয়। অতপর ২১ এপ্রিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২৮৬ তম সভায় র্স্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব পাশ হয়। প্রস্তাবটি জাতিসংঘের ৪৭ নাম্বার প্রস্তাব হিসাবে স্বীকৃত। এ প্রস্তাবে বলা হয়, কাশ্মীরিরা গণভোটের মাধ্যমে ভারত না পাকিস্তানে যোগ দেবে তা তারা নির্ধারণ করবে। ভারত কখনো এ প্রস্তাব মেনে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এ ব্যাপারে প্রস্তাব গ্রহণ বাদে তা বাস্তবায়নে তেমন উদ্যোগী হয়নি। ফলে কাশ্মীরের উপর গৃহীত প্রস্তাব বাংলা প্রবাদের ‘কথার কথা’র মাঝেই ঘুরপাক খেয়েছে আর কাশ্মীরে কেবল রক্তই ঝরেছে।

এরই মাঝে ১৯৬৫ সালে কাশ্মীরকে ঘিরে দুদেশ সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৪৭ এর কাশ্মীর যুদ্ধের পর এটা ভারত পাকিস্তানের দ্বিতীয় সরাসরি যুদ্ধ।

৬৫ সালের যুদ্ধের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে উপলক্ষ করে দেশ দুটি আরো একবার সরাসরি যুদ্ধের মুখামুখি হয়। এটি তাদের মাঝে তৃতীয় সরাসরি যুদ্ধ।

হিংসা বিদ্বেষ হানাহানি এভাবেই এ উপ মহাদেশ থেকে আর কখনো বিদূরিত হয়নি। বরং যতই দিন গড়িয়েছে পাকিস্তান ভারত দুটি দেশ কেবলি মারনাস্ত্রের মওজুদ বাড়িয়েছে একে অপরকে ঘায়েল করতে। এ পথেই হাঁটতে গিয়ে ১৮ মে ১৯৭৪ এ রাজস্তানের পোখরানে ভারত প্রথম পারমানবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। মজার এবং নির্মম পরিহাস হল ভারত এ পরীক্ষার সাংকেতিক নাম রেখেছিল ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’। বুদ্ধ অহিংসার মূর্ত প্রতীক, যার বাণী জীব হত্যা মহা পাপ। আর পারমানবিক বোমার ধ্বংসলীলা পৃথিবী তো বেদনায় বিস্ময়ে বিপন্নবোধে অবলোকন করেছে ১৯৪৫ এ হিরোশিমা নাগাসাকিতে।

১৯৯৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় পরিষদ র্স্বসম্মত সিদ্ধান্তে লাদাখ সহ সম্পূর্ণ জম্মু এবং কাশ্মীরকে তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে ঘোষণা করে। উল্লেখ্য ড. আম্বেদকর রচিত ভারতীয় মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ অনুযায়ী কাশ্মীরকে ভারতীয় কাঠামোয় বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়। ৫ আগস্ট ২০১৯ কাশ্মীরকে দেওয়া এই বিশেষ মর্যাদা ভারতের বি জে পি সরকার বাতিল করে। এটি নিয়ে কাশ্মীর অশান্ত হয়ে উঠে যা এখনও বিদ্যমান।

ভারতের পারমানবিক অস্ত্র সজ্জিত হওয়া পাকিস্তান সহজভাবে নেয়নি। পাকিস্তান ২৮ মে ১৯৯৮ সালে পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জানান দেয় তারা ভারতের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এ দিনটি এখন পাকিস্তানিরা পালন করে ‘ইওমে তাকবির’ বা মহান দিবস হিসাবে। কারণ এই সময়ে তাদের পারমানবিক পরীক্ষা ‘চাগাই১’ এবং ‘চাগাই২’ সফলভাবে পরিচালিত হয়েছিল।

কারগিল যুদ্ধ। এ যুদ্ধকে পাকিস্তান ভারতের মাঝে চতুর্থ সরাসরি যুদ্ধ হিসাবে গণ্য করা হয়। এ যুদ্ধ ১৯৯৯ সালের মে থেকে জুলাই এ সংঘটিত হয়। কারগিল যুদ্ধের সূচনা হয় ভারতীয় সেনাদের ছেড়ে আসা লাদাখের উচ্চ পাহাড় শৃংঙ্গের পোস্টগুলি যখন কাশ্মীরি গেরিলারা চুপিসারে দখল করে নেয়। ভারতীয় বাহিনী তখন তা পুনর্দখলের জন্য মরিয়া অভিযান পরিচালনা করে, এ থেকেই কারগিল যুদ্ধ।

চিন্তার বিষয় হল এখন দুদেশের হাতেই মোটামুটি সমান সমান আনুমানিক ২৫০ (দুইশত পঞ্চাশ) টি করে পারমানবিক বোমা রয়েছে, এর কয়েকটিই একে অপরকে ধুলিসাৎ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পৃথিবীর নয়টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মাঝে এ দুটি দেশের অবস্থান বেশ উপরে যদিও দুটি দেশের মানুষের জীবন যাত্রার মান সে তুলনায় অনেক নিচে।

২০০৮ সালের ২৬ থেকে ২৯ নভেম্বর ১০ জনের একটি সশস্ত্র দল মুম্বাই এ দুর্ধর্ষ এবং ভয়াবহ এক হামলা পরিচালনা করে। এ হামলায় তারা মুম্বাই’এর ছত্রপতি শিবাজী রেলওয়ে স্টেশান, হোটেল তাজ, হোটেল ওবে রয় ইত্যাদিতে হামলা পরিচালনা করে বিশ্বব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এ হামলায় জানমালের বহু ক্ষতি হয়।

১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ জম্মু কাশ্মীরের উরি শহরের নিকটস্থ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড সদর দপ্তরে হামলা চালিয়ে জয়সে মোহাম্মদের ৪ সদস্য ১৯ জন সেনা সদস্যকে হত্যা এবং ৩০ জনকে আহত করে। এটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কাশ্মীরি গেরিলাদের দ্বারা পরিচালিত অন্যতম দুর্ধর্ষ একটি অভিযান ছিল। প্রতিক্রিয়ায় ভারত পাকিস্তানি কাশ্মীরে সার্জিক্যাল অপারেশন পরিচালনা করে।

১৪ ফেব্‌্রুয়ারি ২০১৯ ভারতীয় জম্মু এবং কাশ্মীরে জয়সে মোহাম্মদ এর সদসস্য আদিল আহাম্মদ দার ভারতীয় সি আর পি এফ সদস্যদের বহনকারী বাসের সাথে বিস্ফোরক বোঝাই পিক আপ ভ্যানের বিস্ফোরণ ঘটায়। এই আত্মঘাতী হামলায় ৪১ জন সি আর পি এফ সদস্য নিহত হন। ভারত প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সার্জিক্যাল অপারেশন চালাতে গিয়ে বিমান আক্রমণ পরিচালনা করে। এই অভিযানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি মিগ ২১ ভূপাতিত হয়, ঐ বিমানের পাইলটকে পাকিস্তান আটক করে এবং দ্রুততম সময়ে ভারতের কাছে তাকে হস্তান্তর করে। এতে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।

কাশ্মীর সলিডারিটি ডে’ প্রতিবছর ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান কাশ্মীর সলিডারিটি ডে পালন করে। পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরের সাথে ভারতীয় কাশ্মীরের একাত্মতা প্রকাশে এ দিন পালন করা হয়। এদিন সাধারণ ছুটি। এটি পাকিস্তানি সাধারণ মানুষের মনে কাশ্মীর সংক্রান্ত ক্রমাগত একটি মনস্তাত্বিক অবস্থান সৃষ্টির চেষ্টা বলেই প্রতীয়মান।

১১ মার্চ ২০২৫ জাফর এক্সপ্রেস নামক ট্রেনটি ৩৮০ জন যাত্রী নিয়ে কোয়েটা থেকে পেশোয়ার যাচ্ছিল, সেই ট্রেনই হাইজ্যাক করে বসে বালুচ বিদ্রোহীরা। পাকিস্তানি স্পেশাল ফোর্সের অভিযানে বিদ্রোহী সকল সদস্য নিহত হয়। পাকিস্তান এই ঘটনায় ভারতের ইন্ধন খুঁজে পায়।

২২ এপ্রিল ২০২৫ জম্মু কাশ্মীরের পর্যটক আকর্ষক পহেলগামের বাইসরন উপত্যকায় বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ জন পর্যটক নিহত হন এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে। পাকিস্তান এ ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে যাচ্ছে।

পহেলগামের ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে কেবল দায়ী করেই থামেনি তারা ভারত ভ্রমণরত পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিল করে অবিলম্বে স্বদেশে ফেরত যেতে নির্দেশ জারি করে। দু দেশের কূটনৈতিক মিশনের আকার ছোট করে আনার ঘোষণা দেয়। সিন্ধুর পানি চুক্তি বাতিল করে। ঝিলাম নদীর পানি পাকিস্তানকে অবগত না করে নিয়মের বাইরে অনেক বেশি ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানি কাশ্মীরে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

পরিনামপ্রতিক্রিয়া হিসাবে পাকিস্তান তার আকাশ পথ ভারতের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে, সিমলা চুক্তি স্থগিত করেছে, ভারতীয় ভ্রমণকারীদের ভিসা বাতিল করেছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানি সেনা প্রধান ঘোষণা দিয়েছে সিন্ধুতে পানি বইবে নয় রক্ত।

এর বাইরে পহেলগামের ঘটনার পর থেকে প্রায় প্রতিরাত ভারতপাকিস্তান সীমানা জুড়ে গোলাগুলি চলছে। এ থেকে মনে হয় পারমাণবিক শক্তিধর দুটি দেশ যুদ্ধের মুখামুখি দাঁড়িয়ে। সামান্য অসহিঞ্চুতা অকল্পনীয় এক ধ্বংসলীলা ডেকে আনতে পারে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআইনে নারী কয়েদীদের বিশেষ অধিকার প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধখুন হয়েছেন সাগর-রুনি, হত্যায় অংশ নেন ২ জন