সমকালের দর্পণ

ফিলিস্তিনে আমেরিকার যুদ্ধ

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১৩ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

৭ এপ্রিল ২০২৫ দুপুর বিকেলে গড়াতে গড়াতে আমার প্রিয় শহর চট্টগ্রামের রাস্তায় বিপুল সংখ্যক তরুণ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের প্রতিবাদ গাজায় অবিরাম অমানবিক নির্বিচার মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে। এ প্রতিবাদ একসময় কিছুটা রুদ্র রূপ নেয়। কে এফ সি, পিৎজা হাট, বাটা, কোকা কোলা’র মত বহুজাতিক কোম্পানিগুলির কিছু কিছু স্থাপনা আক্রান্ত হয় তরুণদের মিছিল থেকে। এ আক্রমণ অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল না। কারণ ক্রমাগত অবিশ্রান্ত বোমাবর্ষণের মাধ্যমে যে বর্বরতা আর নৃশংসতায় ইসরাইল গাজায় তথা ফিলিস্তিন জুড়ে সাধারণ অসহায় নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে তা সারা বিশ্বের সচেতন মানুষদের ক্ষোভকে উস্কে দিচ্ছে। আমাদের ইলেক্ট্রনিক আর প্রিন্ট মিডিয়াগুলিতে গাজার গণহত্যা দেখতে দেখতে আমরা দর্শকপাঠকরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি, আমাদের তরুণ সমাজও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। তাদের মাঝে আলোড়ন এবং প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশে তারা প্রতিবাদের ভাষা খুঁজেছে। তারা জানে জায়ানবাদী ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইহুদিবাদী বহুজাতিক অনেক কোম্পানীর মদদপুষ্ট। অস্ত্রের বিপুল অর্থের যোগানদাতা এইসব বহুজাতিক গোষ্ঠী। বিশ্বব্যাপী সচেতন মানুষেরা বিশেষ করে আমাদের তরুণরাও বিষয়টি জানে, জানে বলেই এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

ইসরাইলহামাসের মধ্যে যুদ্ধ বিরতির পর ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ দৈনিক আজাদীর উপসম্পাদকীয়তে আমার লেখা ছিল “গাজায় গণহত্যার বিরতি’। গণহত্যার বিরতি কথাটা লিখতে আমার হৃদয় বেদনায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছিল, পরম স্‌্রষ্টা রাব্বুল আলামিনের কাছে কাতর প্রার্থনা করেছি বিরতি না হয়ে গাজায় যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। আমার সে প্রার্থনা কবুল হয়নি। ‘গাজায় গণহত্যার বিরতি’ ই হয়েছিল, এখন পুরাদমে গাজায় মানুষ হত্যার মাঝে ইসরাইলী কাপুরুষদের বিভৎস উল্লাস চলছে। বিশ্ব বিবেক বিশেষ করে ইসলামী বিশ্বের দেশ গুলিও এ ব্যাপারে অনেকটা নিঃস্পৃহ নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, ইয়েমেন আর ইরান ব্যতিরেখে। এটি প্রত্যক্ষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া কোনো একজনের হৃদয় বিদারক এই পোস্টটি হবহু তুলে ধরার ইচ্ছে সম্বরণ করতে পারলাম না,

ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে

পাকিস্তান ছিল বিশ্বের অন্যতম পারমানবিক শক্তিধর, তবু গাজার মানুষকে রক্ষার্থে তাদের একটা বোমাও উড়ে যায়নি।

মিশরের বুক চিরে নীল নদ বয়ে গিয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, যা প্রাণ যুগিয়েছে আফ্রিকার মরুভূমিকে। অথচ পাশেই গাজার শিশুরা তৃঞ্চায় কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে।

সৌদি আরব, আরব আমিরাত ছিল তেলের সাগরে ভেসে থাকা বিলাসী সাম্রাজ্য কিন্ত্তু গাজার এ্যাম্বুলেন্সগুলো পেট্রল না পেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল নিঃস্তব্দ নিঃশব্দ নিরুপায়। নীরবতা যেন তাদের আর্তনাদ।

সর্বোচ্চ আশা প্রত্যাশার অসংখ্য চোখ তাকিয়ে ছিল তুরস্কের দিকে। নেতৃত্বের স্বপ্নে বিভোর, উম্মার দাবী করা মুখপাত্র। তবু গাজার জন্য তারা কিছুই করল না, না রসদ সামগ্রী সাহায্য, না নিরাপত্তা নিঃশ্চিতে কূটনৈতিক আগ্রাসন।

গোটা মুসলিম বিশ্বের ছিল ৫০ লক্ষ সৈন্য, ছিল ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, স্যাটেলাইট, গোয়েন্দা বাহিনী, ছিল অত্যাধুনিক প্রযুক্তি গাজার জন্য এগুলোর কিছুই ব্যবহার হয়নি।

সব কিছু থাকবে ইতিহাসে। করুণভাবে লেখা থাকবে, তারা চুপ ছিল, নীরব ছিল। মৃত্যুর চেয়েও গভীর ছিল তাদের সেই নীরবতা।

এ অবস্থার দৃশ্যপট রচনায় ডন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক আব্বাস নাসির লিখেছেন ‘পশ্চিমা আর আরব দেশগুলি যেন বোধ শূন্য’। তিনি আরো লিখেছেন, ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকার যেন অবাধ ছাড় পেয়েছে এই জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানোর জন্য। ঘরবাড়ি ধ্বংস, খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ বন্ধ, পরিকল্পিত অনাহার ও মৃত্যুর ফাঁদসবই চলছে একেবারে নির্লজ্জভাবে।

পাশাপাশি ইতিহাসে এও লেখা থাকবে জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট ভাষায় স্লোভানিয়ার প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়হুর উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করেছিলেন ‘নেতানিয়াহু স্টপ জেনোসাইড ইন গাজা’। ইতিহাসে এটাও লেখা থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপ অষ্ট্রেলিয়ার বিবেকবান মানুষেরা বিশেষ করে তরুণরা গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উচ্চকণ্ঠ হয়েছিল এবং এই বাংলাদেশেও। দক্ষিণ আফ্রিকার সংক্ষুদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া এবং সেখানে দাঁড়িয়ে তাদের তরুণী আইনজীবী আদিলা হাশিম’এর কান্নাজড়িত কণ্ঠে গাজার হাজার হাজার শিশুর মৃত্যুবরণ এবং বেঁচে থাকাদের বাকী জীবনের দুর্বিষহ স্মৃতির ভার বহনের দায় তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কথাও ইতিহাস মনে রাখবে।

ইতিহাসে বুশনেল’ এর কথাও লেখা থাকবে। বুশনেল আমেরিকান এয়ারর্ফোসের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ফিলিস্তিনিদের প্রতি তার দেশ এবং ইসরাইলের বর্বরতার প্রতিবাদে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। তার আত্মাহুতির ঠিক পূর্ব মুহূর্ত আগে বুশনেল তার ফোনে রের্কড করেন ‘আই এম এ্যাবাউট টু এনগেইজ ইন এন এক্সট্রিম এ্যাক্ট অব প্রটেস্ট, বাট কমপেয়ার টু হোয়াট পিপল হ্যাভবিন এক্সপিরিয়েন্সিং ইন প্যালেস্টাইন এ্যাট দি হ্যান্ডস অব দেয়ার কলোনাইজার, ইট ইজ নট এক্সট্রিম এ্যাট অল। দিস ইজ হোয়াট আওয়ার রুলিং ক্লাশ হ্যাজ ডিসাইডেট উইল বি নরমাল’। বুশনেলের এ বক্তব্য বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘আমি চরম এক প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছি, আমার এই প্রতিবাদকে ফিলিস্তিনি জনগণের তাদের দখলদারদের হাতে প্রতিদিনের যে সহিংসতার অভিজ্ঞতা তার সাথে তুলনা করলে কিছুই না। আমাদের শাসকরা মানুষের এই চরম পরিণতিকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছেন’।

রুওয়াইদা আমির, ফিলিস্তিনি শিক্ষক মেয়েটির ভয় তাড়িত আকুতি আলজাজিরা’ থেকে অনুবাদ করে ৮ এপ্রিল ২০২৫ দৈনিক প্রথম আলো ছাপিয়েছে তাদের প্রথম পৃষ্ঠায়, রুওয়াইদা’র আকুতি সে কোনো সংখ্যা হয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চায় না। রুওয়াইদা’র আশঙ্কা আর আকুতি ‘মৃতদের অজ্ঞাত ব্যক্তি হিসাবে উল্লেখ করা বা গণকবরে শুইয়ে দিতে দেখার পর আমার মাথায় বিষয়টি গেঁথে আছে। এর মধ্যে কিছু অঙ্গ প্রত্যঙ্গও আছে, যা শনাক্ত করা যায়নি। এটা কি সম্ভব যে আমার কাফনের ওপর শুধু কালো/নীল ব্লাউজ পরা তরুণী লেখা থাকবে? আমি কি অজ্ঞাত হিসাবে মারা যাব? শুধুই একটি সংখ্যা হিসাবে?’

আজ অধিকৃত গাজায় পশ্চিমতীরে তথা সমগ্র ফিলিস্তিনে মানুষ মানুষ হিসাবে মারা যাচ্ছে না তারা সংখ্যা হিসাবে মরছে। এই একবিংশ শতাব্দীতে সভ্যতাদর্পী মানুষের সামনে মানুষ মরছে অন্য মানুষের মারণাস্ত্রে। এখানে এই সংঘাত সংঘর্ষ, নির্বিচারে নিরাপরাধ নারী শিশু হত্যা এর কারণ খুঁজতে গেলে নিশ্চিতভাবে বেরিয়ে আসবে আমেরিকার স্বার্থ এবং ভূরাজনীতি।

আমেরিকা মধপ্রাচ্যে এমন কোনো দ্বিতীয় শক্তির উত্থান চায় না যা তার প্রভাব তথা তেল সাম্রাজ্যের উপর একক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। তার ইচ্ছে পূরনে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটি বরকন্দাজের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। শ্যারন আর উইনন এই দুই ইসরাইলী কৌশল প্রণেতা আমেরিকার স্বার্থের অনুকূলে তাদের স্ব স্ব কৌশল প্রণয়ন করেছেন। দু জনের কৌশল দু ধরনের হলেও আমেরিকার লক্ষ্য পূরণই তাদের মূল উদ্দেশ্য। শ্যারনএর তত্ত্ব হল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে সংঘাত জিইয়ে রেখে সরকার এবং সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে রাখা এবং ঐ দুর্বল সরকারকে টিকিয়ে রাখার আশ্বাসে তার উপর প্রভাব বিস্তার নিষ্কন্টক করা। ইউনন দেশগুলির অভ্যন্তরে গোত্রে গোত্রে, দলের বিরুদ্ধে দলের, ধর্মীয় গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে সংঘাত সংঘর্ষ তথা যুদ্ধ লাগিয়ে রাষ্ট্রগুলিকে ছোট ছোট আঞ্চলিক ভাগে বিভক্ত করে রেখে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের উপর একচ্ছত্র প্রভাব ধরে রাখার প্রবক্তা। আমেরিকার অন্যতম যুদ্ধবাজ নেতা ডিকচেনী এই ব্যবস্থাকে ‘পার্ম্যানেন্ট ওয়ার’ নাম দিয়ে এটি মধ্যপ্রাচ্য বা যেখানে আমেরিকার স্বার্থ জড়িত তা অর্জনে পার্মানেন্ট ওয়ার কৌশল অবলম্বনের সুপারিশ করেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা এখন এ কৌশলেই আগাচ্ছে। এটি পর্যবেক্ষণ করেই হয়ত বব ডিলান অন্তর ছোঁয়া এই কথা গুলি বলেছেন।

‘Come you masters of war. You that build the big guns. You that build the death planes. You that build big bombs.

You that hide behind walls. You that hide behind the desks. I just want you to know I can see through your musks. Let me ask you one question, Is your money that good? Will it buy you forgiveness, do you think that it could? I think you will find, when your death takes it toll, all the money you made, will never buy back your soul’

বব ডিলান’এর উপরের অনূভূতি বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘যুদ্ধের এই যে উদ্যোগী আয়োজক, যে তুমি বানিয়েছ বিশাল কামান, যে তুমি বানিয়েছ মানুষ মারার যুদ্ধ বিমান, যে তুমি বানিয়েছ ব্যাপক বিস্ফোরক !

যে তুমি আড়ালে আছ ঐ দেওয়ালের, যে তুমি বসে আছ ঐ বিশাল ডেস্কের পিছনে। আমি তোমাকে জানাতে চাই আমি তোমাকে দেখছি তোমার ঐ মুখোশের ভিতরও। তোমাকে একটি প্রশ্ন করব, তোমার অর্থের কি এতই জোর? এ অর্থ কি তোমাকে পরিত্রাণ দিতে পারবে? যখন তোমার মৃত্যু হবে তুমি কি মনে কর তোমার সব অর্থের বিনিময়ে তুমি তোমার আত্মাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে? আমার অন্যতম প্রিয় গায়ক রিচার্ড মার্ক্স ’এর গানের কথা দিয়ে শেষ করছি ‘ হ্যাভ মার্চি’প্রভু দয়া কর! দয়া কর তোমার সৃষ্টির প্রতি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফিলিস্তিন : ধরিত্রীর বুকে এক দগদগে ক্ষত
পরবর্তী নিবন্ধভূজপুর কৃষকদলের পরিচিতি সভা