চিকেন নেক বা শিলুগুড়ি কড়িডোর। চিকেন নেক বা শিলুগুড়ি কড়িডোর এর গুরুত্ব অনুধাবনে আমাদের প্রথমত ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চলের কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। আসাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল নিয়ে ভারতের র্পূ্বাঞ্চল। এই রাজ্যগুলির বাইরে পরবর্তীতে স্বাধীন সিকিম তার স্বাধীন স্বকীয়তা বির্সজন দিয়ে ভারতীয় রাজ্য হিসাবে ভারতের সাথে একীভূত হয়। ভারতের কাছে এসব রাজ্যের গুরুত্ব আমরা যদি প্রথমত অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তা হলে সেটি হবে অধিক যুক্তিসঙ্গত।
ভারতের এই র্পূ্বাঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদে সমুদ্ধ। এইসব সম্পদের মাঝে উল্লেখ্য, নানা বৃক্ষরাজির সমাহারে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল, চা, কয়লা, মূল্যবান কাঠ, রেশম, পাট, জ্বালানী ইত্যাদি।
এই অঞ্চলের জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৬৩,২৫৭ মেগাওয়াট। বর্তমানে ভারতের এই র্পূ্বাঞ্চল তাদের জলবিদ্যুতের প্রায় ৪২.৫৪ শতাংশের যোগানদাতা। অরুণাচল প্রদেশ এর মাঝে একক ভাবে প্রায় ৩৪ শতাংশ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে। অরুণাচলের জলবিদ্যুৎ উদপাদনের সক্ষমতা প্রায় ৫০,৩২৮ মেগা ওয়াট। এ অঞ্চলের বিভিন্ন নদীর শাখা প্রশাখা ভারতীয় মোট নদীয় জলের প্রায় ৩৭ শতাংশের আধার।
খনিজ পদার্থের দিক থেকেও এ অঞ্চল সমৃদ্ধ। এ অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর চুনাপাথর এবং ডোলামাইটের মত মূল্যবান খনিজ।
ভারতের মোট চা উৎপাদনের ৫০ শতাংশ উৎপাদন হয় এ অঞ্চলে। ভারতের মোট জ্বালানী তেলের ২০ শতাংশের যোগানও দেয় এ অঞ্চল। ভারতীয় জীব বৈচিত্রের এক তৃতীয়াংশ এখানে বিদ্যমান।
এ অঞ্চলের ভূ–অবস্থান। ভারতের মোট আয়তনের ৭.৯ শতাংশ ভারতের এ অঞ্চল।
রাজ্যগুলির মধ্যে সিকিমের আয়তন সবচেয়ে কম, মাত্র ৭,০৯৬ কিঃ মিঃ। অরুণাচলের আয়তন সবচেয়ে বেশি, ৮৩, ৭৪৩ কিঃ মিঃ। এ অঞ্চলের সীমান্তের ৯৮ শতাংশই আর্ন্তজাতিক সীমান্ত শুধু চিকেন নেক বা শিলুগুড়ি কড়িডোর ব্যতিরেকে। সীমান্ত সংশ্লিষ্ট দেশগুলি হল চীন, মায়ানমার, ভূটান, নেপাল এবং বাংলাদেশ।
ভূ–অবস্থানগত দিক থেকে ভারতের এই র্পূ্বাঞ্চলকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রবেশ দ্বার হিসাবে গণ্য করা হয়। এই সূত্রে এ অঞ্চলের সাথে মায়ানমার, ভিয়েতনাম, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, ফিলিপিন এবং সিঙ্গাপুর সম্পৃক্ত।
এ বিষয়টি ধর্তব্যের মধ্যে রেখে ভারতীয় কৌশল প্রণেতাদের মাঝে এ অঞ্চলের গুরুত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারতীয় উত্তর পর্ূ্বাঞ্চলের সাথে বাংলাদেশের ভূ–সম্পর্ক বাংলাদেশের সাথে এ অঞ্চলের রয়েছে সু দীর্ঘ সীমান্ত সম্পর্ক। আসামের সাথে ২৬৩ কিঃমিঃ মেগালয়ের সাথে ৪৪৩ কিঃমিঃ মিজোরামের সাথে ৮১৮ কিঃমিঃ ত্রিপুরার সাথে ৮৫৬ কিঃ মিঃ এবং পশ্চিমবঙ্গের সাথে ২২১৬ কিঃ মিঃ।
মায়ানমারের সাথে এ অঞ্চলের ভূ– সর্ম্পক। অরুণাচল প্রদেশের সাথে ৫২০ কিঃমিঃ মনিপুরের সাথে ৩৯৮ কিঃমিঃ মিজোরামের সাথে ৫১০ কিঃমিঃ এবং নাগাল্যান্ডের সাথে ২১৫ কিঃমিঃ।
মায়ানমারের কাচিন স্টেট, চিন স্টেট এবং সাগাইং ডিভিশন ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত একই সাথে এ অঞ্চল চীন সন্নিহিত হওয়ায় এবং মায়ানমারের সাথে চীনের সুদীর্ঘ সীমান্ত থাকার কারণে ভারতের কাছে এ অঞ্চল যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তেমনি চীনের কাছেও এ অঞ্চল সমান গুরুত্ব বহন করে।
চীনের সাথে ভারতের ভূ–সম্পর্ক। ভারত এবং চীনের মধ্যে সীমানা প্রায় ৩,৪৮৮ কিঃমিঃ। এটি উত্তর পশ্চিমের কাশ্মীর থেকে শুরু করে পশ্চিমের হিমালয় র্প্বত থেকে ভারত–মায়নমার–চীন ত্রি–সীমান্ত পর্যন্ত। চীন ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানাকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়, পশ্চিম, মধ্য এবং র্পূ্বাঞ্চল।
র্পূ্বাঞ্চলে অরুণাচল এবং সিকিমে উভয় দেশের মাঝে সীমান্ত ১৩২৫ কিঃমিঃ এর মাঝে অরুণাচলের সাথে রয়েছে ১০৭৩ কিঃ মিঃ। ১৯১৩–১৪ সালের সমঝোতা অনুযায়ী ম্যাকমোহন ভারত চীন এর মাঝে সীমানা নির্ধারণ করেন, যা ম্যাকমোহন লাইন হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। চীন এই ম্যাকমোহন লাইনকে মানতে নারাজ। এই সূত্রে চীন ভারতের মাঝে সীমান্ত সংঘাত লেগেই আছে। ১৯৬২ সালের চীন ভারত যুদ্ধ এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
এ অঞ্চলের জনসংখ্যা: মোট জনসংখ্যা ৪ কোটি ৫৪ লক্ষ মাত্র। এই জনসংখ্যার মাঝে সিকিমে সবচেয়ে কম ৬ লক্ষ ১ হাজার ২৮ জন, আর আসামে সবচেয়ে বেশি ৩ কোটি ১২ লক্ষ।
উত্তর র্পূ্বাঞ্চলের বিদ্রোহী তৎপরতা তথা ইনসার্জেন্সী। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা ঘোষনণার পূর্বেই নাগারা তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে। ডঃ ফিজো তার একাডেমিশিয়ান বন্ধু সাকারির বয়ানে এবং রচনায় ‘মিজো ডিক্লারেশন’ এ স্পষ্ট উল্লেখ করেন ‘একজন ভারতীয় যেমন নাগা নন তেমনি একজন নাগাও ভারতীয় নন’। সেই থেকে নাগা হিলস এ বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়া।
ভারতীয় স্বাধীনতার সাথে একাত্ম হতে তৎকালীন মণিপুরের রাজা অস্বীকৃতি জানান। তার দাবী ছিল মণিপুর স্বীয় স্বাধীনতা নিয়ে সগৌরবে ইতিহাসে অবস্থান নেবে। তিনি মণিপুরে এক গনভোটের মাধ্যমে মনিপুর কনস্টিটিউমনাল এ্যাক্ট ১৯৪৭ ঘোষণা করে বসেন।
মণিপুরের রাজার ভারতের সাথে যোগদানের অস্বীকৃতির পরিণতি হিসাবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে কাররুদ্ধ করে। ১৯৪৭ এর ২১ সেপ্টেম্বর কারারুদ্ধ মনিপুরের রাজাকে ভারতে যোগদানের জন্য ‘গবৎমবৎ অমৎববসবহ’ এ সই করতে বাধ্য করা হয়। এরই পরিণতি ১৫ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে জোর করে মনিপুরকে ভারতে যোগদান করানো। সেই থেকে মনিপুরে ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যা সময়ে সময়ে স্তিমিত হয়েছে মাত্র।
লালডেঙ্গা অনেকটা ফিজোর প্রভাবে এবং হাত ধরে স্বতন্ত্র মিজোরামের দাবীতে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠিত করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রম অবহেলার নিদারুণ শিকার আসাম একই সাথে বসতি স্থাপনকারীদের সাথে ভূ এবং সাংস্কৃতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংঘাত এর মাধ্যমে আসামে অস্থিরতার বীজ রোপিত হয়। ১৯৮৯ সালে প্রফুল্ল মোহান্ত, ভৃগু ফুকনদের নেতৃত্বে আসামে প্রবল ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮৫ সালে আসাম চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর পরও আসামে বিদ্রোহের দাবানল থামেনি, বরং পরেশ বড়ূয়া, অনুপ চেটিয়াদের নেতৃত্বে ‘উলফা’র মত সশস্ত্র সংগঠন এক সময় আসামে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানকে একেবারে নড়বড়ে করে তুলেছিল। বাংলাদেশের সহায়তায় ভারত এক সময় সে পরিস্থিতি আপাত সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে বলে প্রতীয়মান।
ত্রিপুরা। অনাবাদি বিস্তীর্ণ ভূমি চাষ এবং সেই সূত্রে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৃটিশরা ত্রিপুরায় তৎকালীন বাংলা সহ ভারতীয় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চাষাবাদে নিয়োজনের জন্য কৃষকদের বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করে। এই সূত্রে ত্রিপুরা ক্রমে বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা অধ্যুষিত হয়ে পড়ে। এই প্রভাব শুধু অর্থনীতির ক্ষেত্রে নয় বরং রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বিস্তার লাভ করে। এরই প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধে ১৯৭০ এর দশকে ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলন্টিয়ার্স (টি এন ভি) অল ত্রিপুরা টাইর্গাস ফ্রন্ট ( এটিটিএফ) এর মত সশস্ত্র সংগঠনের জন্ম হয়।
অরুণাচলের নাগা অধ্যুষিত অঞ্চল তিরাগ এবং চাগলাং ইত্যাদিতে নাগাল্যান্ডের সশস্ত্র সংগ্রামের ঢেউ সময়ে সময়ে আচড়ে পড়েছে। একই সাথে উলফা’ সদস্যদের আশ্রয় উপস্থিতি অরুণাচলকে অস্থির করেছে কখনো কখনো।
ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার তার উত্তর র্পূ্বাঞ্চলের সশস্ত্র সংঘাত রাজ্য নামক প্রেসক্রিপশান এর মাধ্যমে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে কিন্ত্তু এ প্রেসক্রিপশান সেখানে জনগণের মন থেকে বিদ্রোহের বীজ পুরোপুরি নিরাময় বা বিদূরিত করতে পেরেছে তা বলা যাবে না। এর কারণেই ভারতীয় কৌশল প্রণেতাদের মন থেকে এ অঞ্চল নিয়ে আশঙ্কার মেঘ এখনও বিদূরিত হয়নি। (চলবে)।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।