আর দুদিন পরেই আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। ২৩ মার্চ ও আমাদের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিন বাঙালি জাতির অন্যতম পুরোধা পুরুষ জনাব এ কে ফজলুল হক লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন এবং বলাবাহুল্য এ কীর্তির জন্য তাকে শেরে বাঙ্গলা খেতাবে ভূষিত করা হয়।
২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল। পলাশ শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার রক্ত রঙিন প্রকৃতি যখন অবারিত অনাবিল তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার আগে ৭ মার্চ একই লক্ষ্যে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু পুরাজাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত করে তোলেন, এ ঘোষণার পূর্বে সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে নানা সংগ্রামের মাধ্যমে ক্রমশ ধাপে ধাপে স্বাধীনতার পথে ধাবিত করেন। এর মাঝে ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান, ৭০ এর র্ন্বিাচন বাঙালির স্বাধীনতার অভিযাত্রায় একেকটি উজ্জ্বল মাইল ফলক।
বাঙালির স্বাধীনতার এই গৌরবযাত্রায় এদেশের মাটি ও মায়ের সন্তান সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জীবন বাজি রেখে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নেয়। মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম’এর ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ আমিন আহম্মেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম, এর ‘১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন’ মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম এর সৈনিক জীবন, গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর বা পাকিস্তানী মেজর সিদ্দিক সালিকের ‘উইনেস টু সারেন্ডার’ বইগুলি সহ আরো অনেকগুলি বইয়ের পাতায় পাতায় বিধৃত আছে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে আকাঙ্ক্ষা আর আত্মত্যাগের কাহিনি।
ইতিহাসের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলিতে দেশমাতৃকার মুক্তিকামী সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মনমানসিকতা কেমন ছিল এই দুটি ঘটনা তার উজ্জ্বল এক সাক্ষ্য। মেজর জেনারেল আমিন আহম্মেদ চৌধুরী তাঁর বইতে লিখেছেন–
প্রথম ঘটনা: ২ র্মাচ ১৯৭১। কর্নেল মিশ্রি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত সব অফিসারকে ব্রিফ বা ঘটনা অবগত করণে একটি সভা ডাকেন। সভায় যোগ দিতে কনফারেন্স রুমের দিকে যাওয়ার সময় পাকিস্তানী মেজর মেহের কামাল বলে ওঠেন ‘বার্স্টাড শেখ মুজিব ইজ আ ট্রেইটর’ অর্থাৎ শেখ মুজিব বেজন্মা এক বিশ্বাসঘাতক। একথা বলা মাত্র শান্তশিষ্ট বাঙালি ডাক্তার মেজর সিরাজুল ইসলাম মেজর মেহের কামালের প্রায় কলার ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠেন ‘ইউ আর এ বার্স্টাড, ইউ অল আর ট্রেইটরস’ অর্থাৎ তোমরা সব বেজন্মা, তোমরা সব বিশ্বাসঘাতক। অপ্রস্ত্তুত মেজর মেহের কামাল বলেন ‘ক্যায়া হো গিয়া ডক্টর স্যাব, ম্যায় তোড়াই আপকো বল রাহা। মেজর সিরাজুল ইসলাম রাগান্বিত স্বরে তখন বলেন ‘সেভেনটি ফাইভ মিলিয়ন পিউপল ভোটেড টু শেখ মুজিব। ডু ইউ থিং দ্যাট, উই অল আর ট্রেইটরস। উই অল আর বার্স্টাড, নেভার আটার দিস টাইপ অব ওয়ার্ডস অ্যাগেইন ইন ইওর লাইফ টাইম ইফ ইউ ওয়ান্ট টু স্টে উইথ আস’। অর্থাৎ সাড়ে সাত কোটি বাঙালি মুজিবকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছে, তুমি কি মনে কর তারা সবাই বেজন্মা? যদি আমাদের সাথে থাকতে চাও তবে এ ধরনের কথা ভবিষ্যৎ এ আর কখনো বলবে না।
এ সময়ের আরো একটি ছোট্ট ঘটনা সবার মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ক্যাপ্টেন এনাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে কোয়ার্টার গার্ডের সৈন্যদের সাবধান করাতে গিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে তা করেন, এবং বলে উঠেন ‘জিন্নাহ ইজ এ ট্রেইটর’। ক্যাপ্টেন এনাম’এর কোর্ট র্মাশাল শুরু হয় যা আর শেষ হয়নি তার আগেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
দ্বিতীয় ঘটনা: ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাষণ শোনার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসাররা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সমবেত হন। বিশাল ডাইনিং হলের এক পাশে বাঙালি অফিসাররা অন্যপাশে পাকিস্তানী অফিসাররা। টেবিলের মাঝে রাখা রেডিও। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুরু হয়। অল্প কিছুক্ষণ চলার পর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। দু পক্ষের মাঝে চরম উত্তেজনা। উপস্থিত সিনিয়র পাকিস্তানী কর্নেল মিশ্রি হয়ত পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বলে উঠেন ‘বক্তৃতার ভাষা আমি বুঝিনি, তবে রেডিও কাঁপছিল’। বাঙালি অফিসাররা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বেতার কেন্দ্রের পরিচালক জনাব নাজমুল আলমকে ফোন করে জানতে পারেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার পাকিস্তানীরা বন্ধ করে দিয়েছে, তবে বক্তৃতা চলছে এবং তারা তা বাণীবদ্ধ করছেন। ক্যাপ্টেন আজিজ বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের রের্কড সংগ্রহ করে রাত দশটায় তা ই বি আর সি (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার)’র সৈনিকদের শোনান। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর গোপনে সৈনিকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এ বক্তৃতা থেকে কী বোঝা গেল? উত্তরে সবাই বলে ‘দেশকে স্বাধীন করতে হবে’।
ইতিপূর্বে বাঙালি সৈনিকদের মন মানসিকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের, আত্মসম্মানবোধের, গৌরবের বীজ বপন করার দায়িত্বটি সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা যথার্থভাবে পালন করেন। তেমনই একজন ১৯৭১ এ চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদার তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানগামী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে বক্তব্য দেওয়ার এক পর্যায়ে উল্লেখ করেন–
You are proud Bengali Soldiers now you are not going there to polish the shoes of Punjabi Officers. Soon they will be polishing Yours. তোমরা বাঙালি সৈনিকরা যাচ্ছ পাঞ্জাবি অফিসারদের বুট পালিশ করার জন্য নয়, মনে রাখবে অচিরে তারাই তোমাদের বুট পালিশ করবে। পাকিস্তানী মেজর সিদ্দিক সালিক তার বিখ্যাত বই ‘উইনেস টু সারেন্ডার’ এ এটি উল্লেখ করেছেন। তিনি তার বইয়ের ১১ পৃষ্ঠায় ব্রিগেডিয়ার মজুমদার সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘Brig Muzzumder was a stocky little fellow fired with Bengali nationalism. He had direct contact with Mujibur Rahman, which gave him a rare combination of pride and prejudice, pride in Bengali nationalism, prejudice against Pakistan’. ব্রিগেডিয়ার মজুমদার খাটোমতন নীতিবান একজন মানুষ যিনি বাঙালি জাতিয়তাবাদের কঠোর মন্ত্রে দীক্ষিত। তার সাথে মুজিবের সরাসরি যোগাযোগ ছিল যা তার মধ্যে অভাবনীয় এক ধরনের গৌরব আর ঘৃণার সম্মিলন ঘটিয়েছিল। গৌরব বাঙালি জাতীয়তাবাদের আর ঘৃণা পাকিস্তানের প্রতি।
তৎকালীন ক্যাপ্টেন আমিন পরবর্তীতে মেজর জেনারেল এবং বর্তমানে প্রয়াত তার বইতে উল্লেখ করেছেন ব্রিগেডিয়ার মজুমদার বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন জেনারেল এমএজি ওসমানীর মাধ্যমে। প্রয়োজনে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার সংবাদ বাহক হিসাবে জেনারেল ওসমানির কাছে ক্যাপ্টেন আমিনকেও ব্যবহার করেছেন।
ইতিমধ্যে জেনারেল ওসমানির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাঙালি অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মরত অনেক সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে কার্যকর একটি যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। মেজর সিদ্দিক সালিকের ‘উইনেস টু সারেন্ডার’ এর ৬৪ পৃষ্ঠায় এ বিষয়টি স্পষ্ট বিধৃত করা হয়েছে।
১৯৭১ সালে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ বাঙালি জাতির সামনে আসে। প্রকৃতিতে তখন বসন্ত আর বাঙালি জাতির হৃদয় প্রাণে সমস্ত অস্তিত্বে তখন স্বাধীনতার এক উন্মাতাল জাগরণ। লন্ডন থেকে প্রকাশিত, ডেভিড লসকাক এর লেখা ‘পাকিস্তান ক্রাইসিস’ এ যা বর্ণিত হয়েছে এবং সিদ্দিক সালিকের ‘উইনেস টু সারেন্ডার’–এর ৭৫ পৃষ্ঠায় সেই উদ্ধৃতি তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা পাঠকের জন্য এখানে তুলে দিচ্ছি– The gates of hell had been cast open, when the first shot had been fired, the voice of Sheikh Mujib came faintly through a wavelength close to the official Pakistan Radio… ..the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the Peoples Republic of Bangladesh. এর সারর্মম হল ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তান রেডিওর কাছাকাছি এক ওয়েভ লেংথে মুজিবের ক্ষীণ কণ্ঠে পূর্ব পাকিস্তানকে গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসাবে ঘোষণা শুনা গেছে। ‘তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল / হৃদয়ে লাগিল দোলা, জন সমুদ্রে জাগিল জোয়ার’– এই চট্টগ্রামে সেদিন দৃপ্ত কণ্ঠে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অকুতোভয় সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এরই পথ ধরে ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল, জয়দেবপুরে ২য় ইস্ট বেঙ্গল, ব্্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল, ২৮ মার্চ সৈয়দপুরে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল এবং ৩০ মার্চ যশোহর এ ১ম ইস্ট বেঙ্গল মাতৃভূমির মুক্তির রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলে নয়, সামরিক বাহিনীর আইন অনুযায়ী বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সেদিন যারা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তারা এটি জেনেও জীবনের মায়া করেননি। তারা সেদিন তাদের বর্তমানকে উৎসর্গের অভিপ্রায়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য। লক্ষ প্রাণ আর হাজারো মা বোনদের সম্মানের বিনিময়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য এই বাংলাদেশে উদিত হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের এই দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেছেন যারা যুদ্ধ জয়ে বীরের বেশে ফিরে এসেছেন তাদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।