‘‘…there are no winners in …conflicts…There are only victims and the results can be measured only in human terms…their very humanity can be measured only in human terms…. This very humanity is assaulted and violated, and the onslaught leaves the survivors scarred both in mind and soul . ”
নাগা একাডেমেশিয়ান এবং লেখক টেমসুলা আও এর উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি যেমনি সংঘাত সংঘর্ষ, হানাহানি সংহারে উন্মত্ত মানবজাতির জন্য জ্ঞানচক্ষু উন্মেলক তেমনি বেদনাদায়কও বটে। টেমসুলার উদ্ধৃতিটি বাংলা করলে দাঁড়ায়, “..সংঘাত সংঘর্ষে কোন বিজয়ী নাই..এখানে শুধু থাকে শিকার বা ভূক্তভোগী…এখানে ক্ষতি নিরুপিত হতে পারে শুধুমাত্র মানুষের ভোগান্তিতে…মানবিক অবক্ষয়ের বিষয়টিও পরিমাপিত হতে পারে মানুষের প্রতি অবজ্ঞা থেকে…মানবিক মূল্যবোধ এখানে আক্রান্ত হয়, চূর্ণ হয় এবং সংঘাত কেবল বেঁচে থাকা আক্রান্তের হৃদয় মনে রেখে যায় গভীর ক্ষত চিহ্ন”।
এ প্রেক্ষাপটে আমাদের এতদঞ্চলের নানা প্রান্তে বিদ্রোহী তৎপরতা এবং সংঘাত সংঘর্ষপ্রবণ এলাকাগুলির উপর আলোকপাত করার প্রয়াসে আজ মায়ানমারের চিন স্টেট এর উপর দৃষ্টিপাত।
চিন স্টেট মায়ানমারের পশ্চিমাঞ্চালীয় একটি প্রদেশ বা রাজ্য। এ স্টেটের পূর্বে মায়ানমারের সাগাইং এবং ম্যাগওয়ে ডিভিশন, দক্ষিণে মায়ানমারের আরাকান তথা রাখাইন স্টেট, পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং ভারতের মিজোরাম, উত্তরে ভারতের মনিপুর রাজ্য।
চিন স্টেটের জনসংখ্যা ৪৮৮,৮০১ জন। রাজধানী হাককা। ১৯৭৪ সালের ৩ জানুয়ারি স্টেট হিসাবে স্বীকৃতির আগে এটি রাখাইন স্টেট তথা তৎকালীন আরাকানের অংশ ছিল।
চিন স্টেটের আয়তন ৩৬,০১৮.৮ বর্গ কিঃ মিঃ বা ১৩,৯০৬.৯ বর্গ মাইল। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিঃমিঃ ১৩ জন বা প্রতি বর্গ মাইলে ৩৪ জন মাত্র।
এই স্টেটে প্রধানত চিন, বামার, মিজো, খুকি ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর বসবাস।
জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৯১.৫% খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বী। চিন স্টেট আমাদের বান্দরবান হয়ে ভৌগোলিকভাবে নিকটতম হলেও সম্পর্ক এবং ভূ-প্রকৃতির বিচারে দূরবর্তী। আমরা মায়ানমারের এ অঞ্চল সম্পর্কে খুব একটা খবরাখবর রাখি না। এটি আমাদের নীতি কৌশল প্রণেতাদের একধরনের অবহেলাজনিত এবং গুরুত্ব অনুধাবনের সীমাবদ্ধতা।
আজকের এ লেখা এ অঞ্চলটির গুরুত্ব অনুধাবনার্থে আলোচনা। ভারতীয় মিজোরামের মিজো, মায়ানমারে এই চিন স্টেট এবং মনিপুরের গরিষ্ঠ সংখ্যক, বাংলাদেশের বান্দরবান অঞ্চলের বোম বা খুকি চিনরা ‘জো’ জাতি হিসাবেই পরিচিত। এই হিসাবে আমাদের বান্দরবানের কিছু অংশও এই জো জাতির অন্তর্ভুক্ত। এদের জীবন যাত্রা, সংস্কৃতি, ধর্ম বিশ্বাস, আচার আচরণ একই সূত্রে গ্রথিত।
‘তুন খো পাম বাইতে’ নামক একজন এই জো জাতি গোষ্ঠীর হয়ে লড়ার জন্য এবং জো জাতি গোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলকে একিভূত করার জন্য ১৯৬০ সালে চিন লিবারেশন আর্মি গঠন করেছিলেন। একই সময়ে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট মিজোরামের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামে লিপ্ত হয়।
১৯৮৮ সালে চিন স্টেটে চিন ন্যাশনাল আর্মি নামে আরো একটি সশস্ত্র সংগঠনের জন্ম হয়। কয়েক বছর সশস্ত্র কর্মকাণ্ড পরিচালনার পর ২০১২ সালে চিন ন্যাশনাল আর্মি চিন স্টেট সরকারের সাথে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। একই সময়ে অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে মায়ানমার এবং ভারতের ভূ-খণ্ড নিয়ে স্বতন্ত্র খুকি শায়ত্বশাসিত অঞ্চল গঠনের লক্ষ্যে যুদ্ধ করার জন্য খুকি ন্যাশনাল আর্মিও গঠিত হয়।
এর বাইরেও ভারতীয় র্পূ্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্রোহী তৎপরতায় লিপ্ত গোষ্ঠীগুলি মায়ানমারে ঘাঁটি গেড়ে তাদের তৎপরতা পরিচালনা করে এসেছে। এদের মধ্যে ‘জোমি রিভোলুশনারি আর্মি’, ইউনাটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম ‘উলফা’, ন্যাশানাল সোসালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড (এন এস সি এন) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এর মাঝে ‘উলফা’ এবং এন এস সি এন ভারতীয় সামরিক, কূটনৈতিক এবং নানা গোয়েন্দা তৎপরতা আর একই সাথে রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বনের কাছে অনেকটা পরাভূত। ফলে এ দুটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দিক থেকে চিন স্টেট তথা মায়ানমার যে চাপ অনুভব করত তা এখন আর সেরকম নাই। তবে চিন স্টেট এখন অন্যভাবে অন্যদিক থেকে ভূ-রাজনীতির যাতাকলের মুখামুখি।
সম্প্রতি মিজোরাম থেকে র্ন্বিাচিত ভারতীয় রাজ্যসভার এম পি বনলালবেনা মায়ানমারের চিন স্টেটের বিদ্রোহীদের একই নৃতাত্ত্বিক বন্ধনসূত্রে ভারতীয় মিজোরামের সাথে একীভূত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। এ লক্ষ্যে তিনি ক্যাম্প ভিক্টোরিয়াস্থ যেখানে চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদর দপ্তর তাও সফর করেছেন। উল্লেখ্য মিজোরাম, সংঘাতপ্রবণ চিন স্টেটের ৪২০০০ (বিয়াল্লিশ হাজার) শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। এর বাইরে ভারতীয় অরুনাচল, নাগাল্যান্ড, মনিপুর এবং মিজোরামের সাথে ১৬৪৩ কিঃমিঃ সীমান্ত রেখা ধরে ১৬ কিঃমিঃ ফ্রি মুভমেন্ট বা অবাধ চলাচল সুবিধা অঞ্চল রয়েছে। এই অবাধ চলাচল অঞ্চলে সীমান্তের উভয় দিক থেকে মানুষ বিনা পাসপোর্ট/ভিসায় অবাধ যাতায়াত করতে পারে। এতদসত্ত্বেও অতি সম্প্রতি মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদোমার উপস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সেটি হল চিন স্টেটের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির উপস্থিতিতে মিজোরামের সাথে চিন স্টেটের গবৎমবৎ অমৎববসবহঃ বা একীভূতকরণ চুক্তি স্বাক্ষর। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে লালদোমার উপস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তার উত্তর ‘ It is my missionÕ ’ অর্থাৎ এটি আমার লক্ষ্য বা কর্তব্য।
চুক্তি স্বাক্ষরের এ বিষয়টি ভারতের ‘সাউথ ব্লক’কে অনেকটা বিব্রতকর অবস্থায় নিপতিত করেছে। এবিষয়টি মায়ানমারের সাথে তার সম্পর্ককে যেমন ঝুঁকিতে ফেলেছে তেমনি তার অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বকেও এক ধরনের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিজোরাম রাজ্য সরকারকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় জানানো হয়েছে বহির্বিশ্বের কারো সাথে বা কোনো পক্ষের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর রাজ্য সরকারের আওতার বাইরে এটি কেন্দ্রীয় সরকার তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারাধীন।
এখানে উল্লেখ করা প্রণিধানযোগ্য যে ১৯৮৮ সালে শুরু হওয়া ‘জো ল্যান্ড’ এর আন্দোলন শুরু হয়। বিষয়টি ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে আমেরিকার মেরিল্যান্ড স্টেটের মিজো দিবসের এক অনুষ্ঠানে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদোমা মিজোরাম তথা জো ল্যান্ডের স্বাধীনতার বিষয়টি আরো জোরালোভাবে সামনে আনেন। ভারত বাংলাদেশ এবং মায়ানমারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জো জনগোষ্ঠীকে নিয়েই তার জো ল্যান্ডের স্বপ্ন।
৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ আমেরিকার ইন্ডিয়ানাপোলিশে অপর একটি অনুষ্ঠানে লালদোমা স্পষ্ট করে ঘোষণা করেন আমরা একদিন একটি স্বাধীন জো ল্যান্ড গঠন করতে সক্ষম হব। আমাদেরকে জোর করে আলাদা আলাদা করে তিনটি দেশে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। তিনটি রাষ্ট্র বলতে এখানে তিনি বাংলাদেশ, ভারত এবং মায়ানমারকে বুঝিয়েছেন।
এ ধরনের একটি রাষ্ট্র গঠনে পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের কথা বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষমতাচ্যুতির অল্প কিছুদিন আগে একটি বক্তব্যে স্পষ্ট উল্লেখ করেছিলেন।
বাংলাদেশের জন্য আরো উদ্বেগের বিষয় হল বিগত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ মিজোরামের মিমিত জেলায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের চালান আটক হয়। মিমিত জেলা পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী এ অবৈধ অস্ত্রের উৎস মায়ানমারের চিন স্টেট এবং এর গন্তব্য বাংলাদেশের র্পা্বত্য চট্টগ্রাম। উল্লেখ্য মিজোরামের মিমিত জেলার সাথে বাংলাদেশের রয়েছে প্রায় ৫০ কিঃমিঃ সীমান্ত।
মিমিত জেলা পুলিশ তাদের ভাষ্যে আরো উল্লেখ করে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে এ অবৈধ অস্ত্র চালানের সাথে মায়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট জড়িত। মনে রাখতে হবে এই চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, মিজোরামের সাথে চিন স্টেটের ‘ গবৎমবৎ অমৎববসবহঃ ’ বা একীভূতকরণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
ভারতের মিজোরাম বা মায়ানমারের চিন স্টেটকে ঘিরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় বাংলাদেশকে অবিলম্বে সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এটি ভূ-কৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য এক অপরিহার্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।