সমকালের দর্পণ

ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ সমূহ ভারত - বাংলাদেশ চলমান সম্পর্ক -৯

মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | রবিবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:২১ পূর্বাহ্ণ

অরুণাচল। অরুণাচল আমাদের থেকে সদূরে ভারতের র্পূ্বাঞ্চলে চীনের সাথে সম্পৃক্ত। অপূর্ব গিরিশ্রেণী ঘিরে সূর্য তথা অরুন উষালঘ্নে তার প্রভা ছড়ায় বলে শ্রী বিভাবসু দাশ নামক এক ভদ্রলোক ‘নেফা’ বা নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এরিয়া’র নামকরণ করেন অরুণাচল। আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই অঞ্চল ১৯৭২ সালে ভারতীয় ইউনিয়ন টেরেটোরির মর্যাদা লাভ করে। ১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অরুণাচলকে ভারতের একটি প্রদেশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। চীন অরুণাচলকে তিব্বতের অংশ হিসাবে গণ্য করে। এই হিসাবে অরুণাচলকে চীন তার অংশ হিসাবে দাবি করে আসছে। ১৯৬২ সালের চীনভারত যুদ্ধে চীন অরুণাচলের বিরাট এলাকা দখল করে নিয়েছিল, পরবর্তীতে চীন অবশ্য অরুণাচল থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। তবে অরুণাচল নিয়ে চীনভারত এর বিরোধ এখনও বিদ্যমান এবং এটি দিন দিন আরো বেশি সাংঘর্ষিক রূপ নিচ্ছে বলে প্রতীয়মান।

অরুণাচল আমাদের থেকে সদূরে অবস্থিত হলেও অরুনাচলের সাথে আমাদের রয়েছে ভূপ্রাকৃতিক এবং ভূরাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক। এর মাঝে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রথমত আমাদের প্রধান প্রধান নদীর উৎপত্তিস্থল এই অঞ্চলে, দ্বিতীয়ত বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্ত্তু অনেক চাকমা এখন অরুণাচলে বসবাস করে।

এই অরুণাচলে বর্তমানে ভারত এবং চীনের সীমান্ত ম্যাকমোহন লাইন দ্বারা স্বীকৃত হলেও চীন এটি মানে না। চীনের অবস্থান, অরুণাচল তিব্বতের অংশ।

অরুনাচলের পশ্চিম সীমান্তে ভূটান, উত্তরে চীনের স্বশাসিত অঞ্চল তিব্বত, দক্ষিণে ভারতের নাগাল্যান্ড এবং মায়ানমার, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পশ্চিমে আসাম। অরুনাচলের রাজধানী ইটানগর। ৩২,৩৩৩ বর্গমাইল বা ৮৩,৭৪৩ বর্গ কিঃমিঃ জুড়ে অরুণাচলের অবস্থান। ইতিপূর্বে ১৯১২ সালে চীনের ‘কইং’ রাজত্বের অবসান ঘটলে তিব্বতের সেই সময়ের ১৩ তম দালাইলামা চীনের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দিয়ে তিব্বতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পর থেকেই তিব্বতকে ঘিরে চীন এক ধরনের ভূরাজনীতি মোকাবেলা করে যাচ্ছে। এর মাঝে ভূরাজনীতির সে খেলায় ভারতও সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

পরিণতি হিসেবে অরুণাচলকে ঘিরে ভারত চীনের মধ্যে বিরোধের যে দ্বৈরথ তার পিছনে যেমন অরুনাচলের মালিকানার বিষয়টি বিদ্যমান তেমনি তিব্বতের ১৪ তম দালাই লামাকে ভারতের প্রশ্রয়ের বিষয়টিও অন্যতম। ১৯৫০ সালে চীন তিব্বতের উপর তার কর্তৃত্ব ঘোষণা করে তিব্বতকে তার স্বশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করে। দালাই লামা অবস্থা বুঝে ১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং সেই থেকে দালাই লামা পশ্চিমাদের সাথে সুর মিলিয়ে চীন বিরোধী প্রপাগাণ্ডায় লিপ্ত। ফলশ্রুতি দালাই লামা’র শান্তিতে নোবেল প্রাপ্তি। ভারতও দালাই লামা’র এসব কর্মকাণ্ড এবং অর্জনে সহযোগী ভূমিকা রেখে এসেছে।

এক হিসাব অনুযায়ী ভারতআমেরিকা তিব্বতে চীনকে কাবু করতে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬১ এই ৫ বছরে প্রায় ২০,০০০ (বিশ হাজার) তিব্বতিকে গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এরই প্রতিক্রিয়ায় চীনপাকিস্তান ভারতীয় উত্তর পর্ূ্বাঞ্চলে প্রায় ৬,০০০ (ছয় হাজার) নাগা এবং মিজোকে ভারতের বিরুদ্ধে গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রদান করে।

সব মিলিয়ে চীনভারতের সম্পর্ক সেই সময় যেমন টানটান উত্তেজনায় প্রবাহিত হচ্ছিল, বর্তমানেও দিন দিন তার অবনতি ঘটছে। সব মিলিয়ে দুটি দেশ সময়ে সময়ে যুদ্ধের মুখামুখি হচ্ছে, সম্পর্ক উন্নয়ের দিকে মোটেও এগিয়ে যেতে পারছে না।

ভূরাজনীতির এ খেলায় চীন এখন আরো একটি জোরালো নতুন চাল চেলেছে। এ চালের নাম ‘ইয়ারলুঙ জাংবু’ জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ। এ জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান দখল করতে যাচ্ছে। জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে তিব্বতের ইয়াঙশি হিমবাহ থেকে নেমে আসা ‘ইয়ারলুঙ জাংবু’র উৎসমুখে। উল্লেখ্য ‘ইয়ারলুঙ জাংবু’ অরুনাচলে এসে নাম ধারণ করেছে ‘সিয়াং’ আসামে এসে ‘ডিবাং’ ‘লোহিত’ এবং ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করেছে, একই ব্রহ্মপুত্র নামে তা বাংলাদেশে প্রবেশ করে অবশেষে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।

ইয়ারলুঙ জাংবু’ জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চীনের ব্যয় হচ্ছে ১৩৭ বিলিয়ন ডলার। বছরে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ থেকে চীন অনায়াসে তার ৩০০ মিলিয়ন মানুষকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম হবে।

২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ান থিং ট্যাংক তাদের এক গবেষণা পত্রের উল্লেখ করেছে Control over these rivers (in the Tibetian  platu) effectively gives China a choke holds on India’s economy. অর্থাৎ তিব্বত থেকে নেমে আসা বিভিন্ন নদীর উপর চীনের নিয়ন্ত্রণ তাকে ভারতের অর্থনীতির নাভিশ্বাস তোলার অবকাশ সৃষ্টি করে দেবে।

ইয়ারলুঙ জাংবু’ জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে অনেকটা আত্মরক্ষামূলক প্রকল্প হিসাবে ভারত অরুনাচলে সিয়াং নদীতে, অর্থাৎ ‘ইয়ারলুঙ জাংবু’ যখন অরুনাচলে প্রবেশ করেছে সেখানে তার উপর বাঁধ দিয়ে জল বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ভারত এ প্রকল্পের নাম রেখেছে ‘সিয়াং আপার মাল্টিপারপাস প্রজেক্ট’। এ প্রকল্পে ভারত ১.৫ লক্ষ কোটি রুপি ব্যয়ের মাধ্যমে ৯.৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি ধরে রাখার পরিকল্পনা করেছে একই সাথে জল বিদ্যুৎ ও।

ব্রহ্মপুত্র নদীর উজানে চীন এবং ভারতের জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ভূরাজনীতির এই প্রতিযোগিতায় ভাটির দেশ হিসাবে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখোমুখি হবে। এমনিতেই ইতিমধ্যে তিস্তার উজানে ভারতের ১৬টি বাঁধ নির্মাণ বাংলাদেশকে প্রচণ্ড খরার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তিস্তা নিয়ে ভূরাজনীতির পানিও কম ঘোলাটে হয়নি। এই ঘোলাজল বা নোনাজল থেকে বাংলাদেশ এখনও মুক্ত হতে পারেনি। এরই মধ্যে ব্রহ্মপুত্রকে ঘিরে নতুন শঙ্কা। এ বিষয়টি বাংলাদেশকে চীন এবং ভারতের কাছে জোরালোভাবে নজরে আনার এখনই সময়। অবশ্য সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা চীন সফরের সময় ব্রহ্মপুত্রের উৎস মুখে চীনের বাঁধ নির্মাণে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি চীনকে অবহিত করেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।

তিব্বতে যেমন চীন তেমনি অরুনাচলে ভারত ব্রহ্মপুত্রের উৎসে বাঁধ নির্মাণ করছে। চীনভারতের এতে ভূরাজনীতি এবং অর্থনীতি রয়েছে। বাংলাদেশ ভূরাজনীতিতে না জড়িয়েও বিষয়টি নিয়ে ভাটির দেশ হিসাবে তার ন্যায্য অধিকার খর্ব হওয়ার আশঙ্কা এখনই উভয় দেশকে যেমন জানান দেওয়া উচিত তেমনি প্রয়োজনে বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও অবহিতকরণের এখনই সময়।

বাংলাদেশের সাথে অরুনাচলের একটি প্রায় মুচে যাওয়া পথরেখাও রয়েছে। সে পথরেখা বেদনার।

৬০ এর দশকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়। এ নির্মাণের ফলে ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী হাজার হাজার বিশেষ করে চাকমা জনগোষ্ঠী বাস্ত্তুচ্যুত হয়। এই জনগোষ্ঠী শরণার্থী হয়ে অনেকেই পার্শ্ববর্তী ভারতীয় রাজ্য মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণ করে। এই শরণার্থী চাকমাদের অনেকেই জীবিকা এবং নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অরুনাচলে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। অরুনাচলে পৌঁছার পূর্বে এইসব হতভাগ্য শরণার্থীরা আসাম এবং ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আসাম এবং ত্রিপুরা উভয় সরকার চাকমা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে অনীহা প্রকাশ করে এবং তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। বিষয়টি আমলে নিয়ে আসামের তৎকালীন গভর্নর বিঞ্চু শাহী ১০ এপ্রিল ১৯৬৪ সালে আসামের মুখ্য মন্ত্রী বিমলা প্রাসাদ চালিহা’র কাছে লিখিত এক চিঠির মাধ্যমে নিম্নোক্ত প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।

It occurred to me that we may get trouble between the Chakmas and Mizos in the Mizo district. These Chakmas would be quite suitable people to go into the Tirap Division of NEFA where there is easily found vacant land in the area about which you and I have often spoken. আমার কাছে অনুমিত মিজো ডিস্ট্রিট’এ চাকমাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে মিজো এবং চাকমাদের মধ্যে সংকট তৈরী হতে পারে। চাকমাদের নেফা অঞ্চলের টাইর‌্যাপ ডিভিশনে পুনর্বাসন করা যায়, যেখানে প্রচুর অনাবাদি খালি জমি পাওয়া যাবে, এই অঞ্চলে বসবাসের জন্য চাকমারা উপযুক্তও, বিষয়টি নিয়ে আমি আর আপনি অনেক আলোচনাও করেছি’

পরর্বতীতে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর অরুনাচলে শরণার্থী চাকমাদের অনেকেরই আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়। এই সংখ্যা এখন প্রায় তেতাল্লিশ হাজার।

অরুনাচলে আশ্রিত চাকমাদের আবেদনের প্রেক্ষাপটে ৯ জানুয়ারি ১৯৯৬ সালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় সংবিধানের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ এর অনুচ্ছেদ ৫ () () এর বিধান অনুযায়ী শরণার্থী এইসব চাকমাদের নাগরিকত্ব প্রদানের আদেশ প্রদান করেন। এ আদেশ ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখনও পুরাপুরি বাস্তবায়িত করেনি। (চলবে)

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের পুরনো গ্রন্থরাজ্যের উত্থান পতনের ইতিকথা
পরবর্তী নিবন্ধইউরোপীয় সেনাবাহিনী গড়ার আহ্বান জেলেনস্কির