‘রাখাইনকে ঘিরে বৈশ্বিক ভূ–রাজনীতির সম্ভাবনা আছে কিনা? থাকলে সেরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা কি হতে পারে?’ ‘ভবিষ্যৎ এ রোহিঙ্গারা অস্ত্র হাতে তুলে নিলে তখন বাংলাদেশ কি ভূমিকা পালন করবে? বা বাংলাদেশের তখন কি ভূমিকা পালন করা উচিৎ?’
শিরোনামের আমার ইতিপূর্বের লেখায় পাঠকদের অনেক প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়েছি। বাকী ছিল উপরোক্ত দুটি প্রশ্ন। আরাকান বা রাখাইনে চলমান সংঘাতে দুটি পক্ষ। এ দুটি পক্ষের সাথে জড়িত বহু পক্ষ। বহু পাক্ষিক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রাখাইনকে ঘিরে ভূ–রাজনীতির বিষয়টি আলোচনা করা যুক্তি যুক্ত।
এ লেখাটি ধারাবাহিকভাবে লেখা আমার উচিৎ ছিল। তা হলে পাঠকদের মনোসংযোগ বা ধারাবাহিকতায় বিঘ্ন ঘটানোর বিষয়টি সামনে আসত না। সময়ের প্রাসঙ্গিকতার প্রাবল্যে অন্য বিষয় সামনে চলে আসাতে এই লেখাটির ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। এ প্রসঙ্গে পাঠকদের অনেকের অনুযোগ আমাকে কিছুটা হলেও অনুশোচনায় ভুগিয়েছে। তবে যারা অনুযোগ করেছেন তাদের পাঠের প্রতি অনুরাগ দেখে আমি সত্যিই অনুপ্রাণিত।
স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে মায়ানমারে সামরিক শাসন বলবৎ। মধ্যে উ নু আর শা শোয়ে নামে মাত্র একটি গণতান্ত্রিক আবহ ধারণ করে মায়ানমারের দৃশ্যপটে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ অধিষ্ঠানও ছিল অনেকটা সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল নে উইন’ এর ইচ্ছায়। সময়মত অর্থাৎ ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতার মঞ্চে হাজির হন। সেই থেকে আজ অব্দি মায়ানমারে সামরিক শাসন চলে আসছে। উ নু আর শা শোয়ের মত অং সান সুকি’ও ক্ষমতার মঞ্চে এসেছিলেন পুতুল নাচ নাচতে। সামরিক শাসকরা সুতা টেনে ছুড়ে ফেলেন অং সান সুকি’কে। সেই থেকে আবারও পুরোপুরি নির্ভেজাল সামরিক শাসন চলছে মায়ানমারে।
দীর্ঘদিন মায়ানমারে সামরিক শাসন চলার পিছনে এবং সামরিক শাসকদের সর্মথন যোগানোতেও রয়েছে ভূ–রাজনীতি। চীন এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে। চীন–মায়ানমারের মধ্যে সীমান্ত রয়েছে ২,১২৯ কিঃমিঃ। এক্ষেত্রে চীন কখনো চায়নি বা চাইবে না তার এই সুর্দীঘ সীমান্ত জুড়ে বৈরী কোন সরকার বা তার সাথে সাংঘর্ষিক কোন রাজনৈতিক মতবাদে মায়ানমারে একটি সরকার অধিষ্ঠিত হোক। এরই ফলশ্রুতি আমরা জেনারেল নে উইন’র ‘রোড টু সোশালিজম’ এ মায়ানমারে এক অদ্ভুত সামরিক সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি দেখেছি। জেনারেল নে উইন দীর্ঘদিন মায়ানমারে এ শাসন ব্যবস্থা কায়েম রেখে তার কর্তৃত্ব জারি রাখেন। জেনারেল নে উইন তার শাসন ব্যবস্থায় যেমন ছিলেন চূড়ান্ত কর্তৃত্ববাদী তেমনি তার অনেক পদক্ষেপ চূড়ান্ত বিচারে ছিল মানবতা বিরোধী। ‘ফোর্স লেবার’ বা জোরপূর্বক শ্রমদানের মত নিপীড়ন মূলক ব্যবস্থা মায়ানমারে দশকের পর দশক ধরে বিদ্যমান ছিল। ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির নাগরিকত্ব এক কলমের খোঁচায় বিলুপ্ত হয়। ২০১৭ সালে প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে স্বদেশ ভূমি থেকে বিতাড়ন করা হয়, যারা এখনও বাংলাদেশে আশ্রিত থেকে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এ এসমস্ত নিপীড়ন, নির্যাতন এবং নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিশ্ব নীরব থেকেছে, মাঝে মাঝে জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপনে সীমাবদ্ধ থেকেছে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা। মায়ানমার তার গৃহীত নানা উদ্যোগ, দমন পীড়ন, নির্যাতনে বিশ্বকে কখনো খুব একটা ধর্তব্যে আনেনি। এর কারণ মায়ানমার জানে তার পিছনে শক্তি যোগাতে আছে চীন। এখন রাশিয়াও সে আয়োজনে শামিল। সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানমারকে ঘিরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যতগুলি প্রস্তাব উঠেছে তার সবগুলিতেই চীন রাশিয়া তাদের ভেটো প্রয়োগ করেছে। এ ভেটোর পিছনে নিশ্চিতভাবে কাজ করেছে ভূ–রাজনীতি বিশেষ করে চীনের। তিব্বত, অরুনাচল এবং দালাইলামাকে ঘিরে চীন এবং ভারতের রয়েছে দীর্ঘদিনের বৈরীতা। এ দুদেশের বৈরিতার প্রলম্বিত ছায়া এসে পড়েছে মায়ানমারে এবং নিশ্চিতভাবে আরাকানেও। চীন মাল্লাক্কা প্রণালী এবং দক্ষিণ চীন সাগরের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে এর থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশেও পথের সন্ধানে এসেছিল। সোনদিয়ায় চীন গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের মাধ্যমে তার মাল্লাক্কার বিকল্প পথের সন্ধান পেয়েছিল। অনেক দূর আগানোর পরও বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত চীনের এ উদ্যোগ থেকে সরে আসে।
চীন বসে থাকেনি। তারা তাদের উপর প্রায় সবদিক থেকে নির্ভরশীল মায়ামারের রাখাইন স্টেটের চকপিউ’তে তাদের কাঙ্ক্ষিত গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পথ খুঁজে পায়।
চীনের এ উদ্যোগে রাখাইন স্টেটের ভূ–কৌশলগত অবস্থান অনেকগুণ বেড়ে যায়। এটি ভারত, আমেরিকা আর চীনের কাছে অবশ্যম্ভাবিভাবে।
চীনের কাছে রাখাইন রাজ্যের গুরুত্ব বাড়ার পিছনে কারণ তার চকপিউ সমুদ্র বন্দর। এর মাধ্যমে সরাসরি কুনমিং পৌঁছাচ্ছে তার আমদানীকৃত তেল গ্যাস। জ্বালানী যোগানোতে এটি এখন চীনের জন্য তার চতুর্থ বৃহত্তম সরবরাহ লাইন। একইভাবে চকপিউ’কে ঘিরে গড়ে উঠছে শিল্পাঞ্চল। এ শিল্পাঞ্চলকে ঘিরে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্যে চোখ রয়েছে চীনের, একই সাথে তার বেল্ট রোড ইনিয়িশিয়েটিভ’ও।
ভারত দীর্ঘদিন তার শিলিগুড়ি নেক বা চিকেন নেক’এর বিকল্প পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশের উপর দিয়ে সময়ে সময়ে পথের সন্ধান করেছে। ব্যর্থ মনোরথে ভারত সাগর আর নদী পথ কলকাতা – সিটওয়ে – প্লাটওয়া পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ মহা পরিকল্পনার নাম ‘কালাদান মাল্টি মোডাল মাল্টি ট্রানজিট প্রকল্প’ এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর মাধ্যমে ভারত সহজে তার পূর্বাঞ্চলের সাথে মূল ভূখণ্ডের অনায়াস যোগাযোগ স্থাপনে সুযোগ পাবে। এ পথ কলকাতা থেকে রাখাইনের সিটওয়ে তথা পূর্বের আকিয়াব বন্দর হয়ে, এ প্রকল্প চীন খুব সহজভাবে নেবে তার তেমন কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বরং ভারতের মাধ্যমে দক্ষিণ পূর্ব এশিয় অঞ্চলে চীনকে বাগে আনতে প্রচেষ্টারত ভারতের মিত্র এবং ইন্দো প্যাসিফিকে চীনের প্রভাব খর্ব করতে গঠিত ‘কোয়াড’ এর নেতা আমেরিকা ভারতের এই প্রকল্পের সূত্রে চীনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়ে যাবে। চীন বিষয়টা ঠিকই বুঝে নিয়েছে। ফলে আরাকান আর্মির ছায়া এসে পড়েছে এ পথের উপর, যার কারণে এ পথের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন আরাকান আর্মি’র দখলে। ভারত এখানে এখন অনেকটা বিপরীত স্রোতে সাঁতার কাটছে।
সুতরাং রাখাইনকে ঘিরে ভারত–চীনের ভূ–রাজনীতির সংঘাত প্রকাশ্যে দৃশ্যমান। রাখাইন ছাড়াও এ সংঘাত মায়ানমারের সাগাইং ডিভিশন ঘিরেও বিদ্যমান। এ পথ ধরে দীর্ঘদিন ভারতীয় পুর্ব্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা চীনের সাথে সংযোগ এবং সেখান থেকে সহায়তা পেয়ে আসছে। এছাড়াও ১৯৬২ সালের ভারতের উপর চীনের অতর্কিত হামলা এপথ ধরেই ঘটেছিল। এসব বিবেচনায় রেখে এ দুটি দেশ মায়ানমারের উপর তাদের ভূ–রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট থাকবে নিঃসন্দেহে।
এ প্রচেষ্টারই অংশ হিসাবে ভারত মায়ানমার সেনাবাহিনীর মন জয় করতে ১৯৯৫ সালে ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি অব আরাকান’এর মিজোরামের প্রভা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া সদস্যদের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে ‘অপারেশন গোল্ডেন বার্ড’ পরিচালনা করে। এ অপারেশনের মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক বাহিনী উলফা, এন এস সি এন এবং পিল এ গেরিলাদের শীর্ষ স্থানীয় প্রায় ৫০ জন সদস্যকে হত্যার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ গোলা বারুদ এবং অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে। পরবর্তীতে মায়ানমার ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীকে তথ্য দেওয়া ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি অব আরাকান’এর সেই সব সদস্যদের মায়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। গোয়েন্দা ইতিহাসের এ এক নির্মম খেলা। ১৯৯৮ সালে ‘অপারেশ লীচ’ এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় ভারত। এ বছর ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে কারেন ইন্ডিপেডেন্ট আর্মির ১৩ এবং আরাকান আর্মি প্রধান জেনারেল কাইং রাজা সহ ২৭ জন, মোট এই ৪০ জনকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তার আশ্বাসে আন্দামানের ল্যান্ডফল আইল্যান্ডে নিয়ে যায়, সেখানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্নেল গেরওয়ালের নেতৃত্বে ঐ ৪০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এগুলো ছিল মায়ানমার সামরিক বাহিনীর মন জয়ের ভারতীয় কৌশলের জ্বলন্ত প্রমাণ। এ প্রচেষ্টায় ভারত মায়ানমারে নিজেদের অবস্থান সময়ে বেশ পাকাপোক্ত করতেও সমর্থ হয়। জোরেল থা শোয়ে যখন সিনিয়র জেনারেল অর্থাৎ সেনা শাসক তখন তার ডেপুটি জেনারেল মং এর মাধ্যমে ভারত মায়ানমারে তার অবস্থান বেশ মজবুত করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীতে চীন পুনরায় মায়ানমারে তার প্রভাব বলয় পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয় এবং এখন সে প্রভাব অনেকটা অপ্রতিরোধ্য। রাখাইন স্টেটে আরাকান আর্মি’র বর্তমান সাফল্য, শান ন্যাশনাল আর্মি এবং মায়ানমার সেনাবাহিনীর যুদ্ধ বিরতি, এই সুযোগে মায়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক শান স্টেট থেকে তিনটি ব্রিগেড সাগাইং ডিভিশনে ‘রি ডেপ্লয়েড’ এর মাধ্যমে অং সান সুকি’র ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এন এল ডি)’ সমর্থিত বিদ্রোহী গোষ্ঠি পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্স (পি ডি এফ) এর নিয়ন্ত্রণাধীন থাকা সাগাইং ডিভিশন থেকে তাদের বিতাড়ন, এসবই চীনের মায়ানমারে ভূ–রাজনৈতিক সফল কৌশলের কথাই প্রমাণ করে। (চলবে)
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক